বাইডেন প্রশাসনে মুসলিম ও ভারতীয়রা কতটা প্রভাব রাখবেন


  • মোতালেব জামালী
  • ২৩ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:১৮

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের আগেই জো বাইডেন তার মন্ত্রিসভা ও হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের তালিকা প্রায় চূড়ান্ত করেন। এতে দক্ষিণ এশিয়ান ও আমেরিকান বেশ কয়েকজন মুসলমানকে স্থান দেওয়া হয়েছে। সে কারণে অনেকেই তার এই মন্ত্রিসভাকে দেশটির ইতিহাসের বহুমুখী একটি মন্ত্রিসভা হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।

বাইডেনের রানিং মেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস অর্ধেক কৃষাঙ্গ এবং অর্ধেক ভারতীয়। প্রশাসনের শীর্ষ পদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে কেবলমাত্র কমলা হ্যারিসকেই নেওয়া হয়নি। বরং পেন্টাগনের প্রধান হবেন একজন কালো, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দফতরের নেতৃত্ব দেবেন একজন ল্যাটিন আমেরিকান, ক্যাবিনেট সেক্রেটারিও একজন মার্কিন কৃষাঙ্গ, পরিবহনমন্ত্রীও একজন কালো। প্রশাসনের অনেক শীর্ষ পদে ইন্ডিয়ান আমেরিকান ও মুসলমানদের নেওয়া হয়েছে।

প্রশাসনের বিভিন্ন পদে অন্তত ২০ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ১৩ জন নারী। এদের মধ্যে নীরা ট্যান্ডেন ও ড. বিবেক মূতিকে খুবই উচুপদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নীরা ট্যান্ডেন সব সময়ই টুইটার ব্যবহার করেন। তিনি ডেমোক্রেট দল সমর্থিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেস এর প্রধান। তাকে হোয়াইট হাউস অফিস অব ম্যানেজমেন্ট এন্ড বাজেট বা ওএমবির পরিচালক পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ড. বিবেক মূর্তিকে সার্জন জেনারেল পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।

বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ও তিনি এই দফতরে কাজ করেছেন। তিনি জো বাইডেনের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত পরামর্শক দলের কো-চেয়ার ছিলেন। ধারনা করা হচ্ছে তিনি বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।

জো বাইডেন তার প্রশাসনে এমন দু’জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নারীকে বেছে নিয়েছেন যাদের পূর্ব পুরুষ কাশ্মিরের বাসিন্দা ছিলেন। এদের একজন হচ্ছেন সামিরা ফাজিলি অন্যজন হচ্ছেন আয়শা শাহ। যাদের নিয়ে সাধারন কাশ্মীরীরা গর্ব অনুভব করেন।

কম্যুনিটি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ সামিরা ফাজিলিকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের এনইসির উপ পরচালক পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তিনি এর আগে হোয়াইট হাউসের এই কাউন্সিলের সিনিয়র পলিসি এডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। হায়াইট হাউসে ফাজিলির নিয়োগে উল্লসিত কাশ্মিরের শ্রীনগরে তার আত্মীয়-স্বজনরা। তার চাচা রউফ ফাজিলি সামিরার এই নিয়োগকে কাশ্মিরের জন্য ‘গর্বের মুহুর্ত’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যদিও কাশ্মিরে সামিরার জন্ম হয়নি, তার পরিবার ১৯৭০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়, তার পরও সে কাশ্মিরের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক অনুভব করে। এই উপত্যকার জন্য তার গভীর ভালবাসা রয়েছে।

আয়শা শাহকে হোয়াইট হাউসের ডিজিটাল ষ্ট্র্যাটেজি অফিসের পার্টনারশীপ ম্যাানেজার পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিনি ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এডভাইজার ছিলেন।

এনইসিতে আরো একজন ভারতীয় মার্কিনী মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি হলেন ভারত রামমূর্তি। তিনি সাবেক সিনেটর ওয়ারেন এলিজাবেথের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনিও এখন এনইসি তে উপ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

খ্যাতিমান কূটনীতিক উজরা জেয়া গনতন্ত্র, মানবাধিকার ও জননিরাপত্তা বিষয়ক উপমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। আরব বসন্তের সময় তিনি ওবাম প্রশাসনের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ছিলেন। এর আগে তিনি ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতেও দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের ইতিহাসে এই প্রথম একজন অ-ভারতীয় দক্ষিণ এশিয়ান বাইডেন প্রশাসনে স্থান পাচ্ছেন। তিনি হলেন পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত মার্কিনী আলী জাইদি। তিনি জাতীয় আবহাওয়া বিষয়ক ডেপুটি এডভাইজারের দায়িত্ব পেয়েছেন। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত মার্কিনী রোহিনী কোসুগলু ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের অভ্যন্তরীণ নীতি বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করবেন।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক জাইন সিদ্দিকী হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তার বাড়ী ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলায়। হোয়াইট হাউসে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়ায় তার এলাকর মানুষ উল্লসিত।

জো বাইডেন প্রথম আরব-আমেরিকান হিসেবে রীমা দোদিন কে গত নভেম্বরেই হোয়াইট হাউসের আইন প্রনয়ন বিষয়ক উপ পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দেন। ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত দোদিন গত ১৫ বছর ধরেই জো বাইডেনের টীমের সাথে সম্পৃক্ত থেকে ব্যাপক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দফতর জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে তিনজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত মার্কিনীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে তরুন ছাবরাকে প্রযুক্তি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক করা হয়েছে। সুমনা গুহ কে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক ও শান্তি কালাথিলকে গনতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বয়কারি হিসেবেনিয়োগ দেয়া হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজের জন্য যাদেরকে বাছাই করা হয়ছে তাদের মধ্যেও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীদের আধিক্য রয়েছে। বিনয় রেড্ডিকে বাইডেনের ভাষন লেখা বিভাগের পরিচালক করা হয়েছে। তিনি বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের নির্বাচনী প্রচারনাকলে তাদের ভাষণ লেখার ক্ষেত্রে সিনিয়র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন।

বেদান্ত প্যটেল প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সহকারি প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি হবেন হোয়াইট হাউসের প্রেস উইংয়ে কাজ করা ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি। নাগরিক অধিকার বিষয়ক আইনজীবি ভানিতা গুপ্ত বিচার বিভাগে সহযোগি এটর্নী জেনারেল হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন।

ফার্স্ট লেডি ড. জিল বাইডেনের টীমেও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত তিনজন মার্কিন নারী মনোনয়ণ পেয়েছেন। এদের মধ্যে মালা আদিগা ফার্ষ্ট লেডির দফতরের পলিসি ডাইরেক্টর ও গারিমা ভার্মা ডিজিটাল ডাইরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। অন্যদিকে সাবরিনা সিং ফার্ষ্ট লেডির ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারির দয়িত্ব পালন করবেন।

জো বাইডেন তার নির্বাচনী প্রচারনাকালে বার বার একটা কথা বলেছেন যে, তিনি এমন একটা সরকার গঠন করতে চান যেখানে দেশের বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন ঘটবে। ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকরা যা দেখতে চান কিংবা তাদের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তার প্রতিফলন তিনি ঘটাতে চান। যদি তিনি না করতে পারেন তাহলে তার রাজনৈতিক ইমেজই নষ্ট হবে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, তার মন্ত্রিসভা হবে আমরিকার ইতিহাসের যে কোন মন্ত্রিসভার চেয়ে অধিকতর প্রতিনিধিত্বমূলক। নির্বাচনী প্রচারনাকালে তিনি বলেছিলেন, তার মন্ত্রিসভায় তিনি দক্ষিণ এশীয় মার্কিনীদের বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীদের অগ্রাধিকার দেবেন।

গত বছর ভারতের জাতীয় দিবস উপলক্ষে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীদের এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীদের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া অব্যাহত রাখবো যাতে আমাদের দু’টি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যায়। আমি আমার পুরো রাজনৈতিক জীবনেও এটা করার চেষ্টা করেছি।’

গত বছর জুলাই মাসে মুসলিম-আমেরিকান ভোটারদের এক সমাবেশে বলেন, তিনি তার মন্ত্রিসভায় মুসলমানদের রাখতে বদ্ধপরিকর। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই মুসলিম প্রধান দেশগুলোর নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেও ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বাইডেনের অতীত ঘাটলে দেখা যায়, সিনেটর, সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির চেয়ারমান ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সব সময়ই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীদের সমর্থন করেছেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরও পক্ষপাতি। তার মতে, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জনগোষ্ঠি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ কাঠামোকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সব সময়ই সহানুভূতিশীল।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী আচরণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সারা দেশে বেড়ে যায় হেট ক্রাইম। বাইডেন এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে পুরো দেশে আবারো ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চান। সে জন্যই তিনি বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চল ও জাতি-গোষ্ঠি থেকে লোক নিয়ে তার মন্ত্রিসভা ও প্রশাসন সাজাচ্ছেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রশাসন দিয়ে বাইডেন কতটা বিশ্ব রাজনীতিতে কতটা স্থিতিশীলতা প্রতিষ্টা করতে পারবেন তা এখন দেখার বিষয়।