ভারতে মুসলিম নির্যাতনের নতুন হাতিয়ার হিসেবে ‘লাভ জিহাদ’ আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এরইমধ্যে বিজেপি-শাসিত উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, কর্নাটক, উত্তরাখন্ড ও হরিয়ানা রাজ্যে এই বিতর্কিত আইনটি পাশ করা হয়েছে। আরও কয়েকটি রাজ্যে আইনটি পাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই আইন নিয়ে শুধু ভারতে নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এই আইনে মুসলমানদের সাথে হিন্দুু নারীদের বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইন লঙ্ঘনকারী মুসলমানদেরকে সর্ব্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ভারতের অনেক হিন্দু বিশ্লেষকও বিতর্কিত এই আইনটিকে ভিত্তিহীন অভিযোগ করে মুসলিম নির্যাতনের নতুন একটি হাতিয়ার হিসেবে অভিহিত করেছেন। তারা এটিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপির একটি ঘৃণ্য যড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই মনে করছেন না।
‘লাভ জিহাদ’ আইন প্রণয়নের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ভারতের মুসলমানরা হিন্দু নারীদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে তাদেরকে বিয়ে করছে ও জোর করে মুসলমান বানাচ্ছে। এটা রোধ করতেই ‘লাভ জিহাদ’ আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। যাতে এ ধরনের বিয়ে বন্ধ করা যায়।
প্রেম করে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করার কারণে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলমান যুবকরা নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন রাজ্যে এধরনের বেশ কিছু বিয়ে আদালত অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করে দিয়েছে। এই আইনটি নিয়ে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বিতর্কিত এই আইনটি স্থগিত করার জন্য গত ৬ জানুয়ারি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হলেও আদালত তা গ্রহন করেনি। আইনটি বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নানা নির্যাতন-নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার ভারতের মুসলমানদেরকে আরও খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।
ভারতে আন্তঃধর্মীয় বিয়ে ও ধর্মান্তরের ঘটনা খুবই কম। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। এরমধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা ১৯ কোটি ৫০ লাখের মতো। উত্তরপ্রদেশে গত বছর ২৮ নভেম্বর ‘লাভ জিহাদ’ আইনটি পাশ করার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে ৮৬ জন মুসলমান যুবকের বিরুদ্ধে এই আইনে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৯ জনের বিরুদ্ধেই হিন্দু নারীকে প্রলোভন দিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগে ৫৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
আইনটি পাশ করার কয়েকদিন পরেই গত ২ ডিসেম্বর পুলিশ উত্তর প্রদেশের রাজধানী লখনৌতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়ে সেটি পণ্ড করে দেয়। হিন্দু নারী রাইনা গুপ্ত ও মুসলিম যুবক মোহাম্মদ আসিফের মধ্যে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। দুই পরিবারেরও এতে সম্মতি ছিল। পাত্র-পাত্রী কারোরই অন্য ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কোনো চাপ ছিল না। কিন্তু বিয়েটি হতে দিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন।
গত ডিসেম্বরের মধ্যভাগে উত্তর প্রদেশের বিজনুর জেলায় এক মুসলিম তরুনকে পুলিশ গ্রেফতার করে ‘লাভ জিহাদ’ আইনে। হিন্দু তরুনীর বাবা থানায় অভিযোগ করেন যে, তার মেয়েকে মুসলিম ছেলেটি প্রেমের ফাঁদে ফেলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করছে। ছেলে ও মেয়েটি একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে একদল উগ্র হিন্দু তাদের উপর হামলা করে। পরে তাদেরকে আটক করে থানায় দেয়া হয়।
পুলিশ মুসলিম ছেলেটির বিরুদ্ধে ধর্মান্তর বিরোধী আইন ও অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের করে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ২০১২ সালের যৌন নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষা আইনেও অভিযোগ আনে। আরেকটি ঘটনায় একজন হিন্দু নারীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহনে চাপ সৃষ্টি করার অভিযোগে ওয়াইস আহমদ নামে এক মুসলমানকে ১৪ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করে আদালত। পরে ঐ হিন্দু নারীর একজন হিন্দুর সাথে বিয়ে হয়। ওয়াইস আহমদ বলেছেন, ঐ হিন্দু নারীর সাথে তার কোন যোগাযোগই ছিল না।
যেসব মুসলিম যুবক হিন্দু নারীদেরকে বিয়ে করতে চান শুধু তাদেরকেই নয়, যেসব মুসলমান অনেক আগে হিন্দু নারীদেরকে বিয়ে করেছেন তাদেরকেও ধর্মান্তর বিরোধী নতুন এই আইনে নানা ভাবে হয়রানী করা হচ্ছে। গত মাসের শেষের দিকে ২২ বছর বয়সী হিন্দু যুবতী মুসকান ও তার মুসলিম স্বামী রশীদ উত্তর প্রদেশের মোরাদাবাদ শহরে যান তাদের বিয়ে নিবন্ধন করার জন্য। কিন্তু সেখান থেকে রশিদকে কারাগারে ও হিন্দু যুবতীটিকে সরকারি শেল্টার হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এই দম্পতির গর্ভে গর্ভে তিন মাসের সন্তান ছিল। কিন্তু টানা-হেচড়া ও মানসিক চাপের কারণে মেয়েটির গর্ভপাত হয়ে যায়। পরে আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, এই দম্পতি আইনের কোন লঙ্ঘন করেনি এবং তাদেরকে একত্রে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে তাদের ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। বিজেপি নেতারা বলে আসছেন যে, ধর্মান্তর বিরোধী আইনটি বিশেষ কোন ধর্মের মানুষকে টার্গেট করে করা হয়নি। শুধু মাত্র ‘আন্তঃধর্মীয় বিয়ে’ থেকে নারীদেরকে রক্ষার জন্যই আইনটি পাশ করা হয়েছে।
এই আইনটি প্রনয়নের পর থেকে যে সব ঘটনা ঘটছে তাতে দেখা যাচ্ছে, নববিবাহিত দম্পতি এবং নিরপরাধ মুসলিম পুরুষ ও কিশোরদেরকে নানাভাবে হয়রানী ও নিপীড়ন করাই আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে। আইনটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের চেতনাকেও হেয় করছে। নারীদেরকে বঞ্চিত করছে তাদের স্বাধীনভাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে।
উত্তরপ্রদেশের মুজাফ্ফরনগরে এক হিন্দু নারীর সাথে সম্পর্ক করে তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টার অভিযোগে আটক করে পুলিশ। রাজ্যের এলাহাবাদ হাইকোর্ট নাদিবকে মুক্তির নির্দেশ দিয়ে বলে যে, নাদিব ও সেই হিন্দু নারী দু’জনই প্রাপ্ত বয়স্ক। তাদের মৌলিক অধিকার রয়েছে নিজেদের প্রাইভেসি রক্ষা করে চলার। তাদের এই সম্পর্কের পরিণতি কি দাড়াবে সেটাও তারা ভালো করে জানে।
আদালতের রায়ে আরও বলা হয়, ভারতের সংবিধানের ২৫ ধারা অনুযায়ী দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই বিবেকের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন ভাবে নিজের ধর্ম পালন ও প্রচার করার অধিকার রয়েছে।
‘লাভ জিহাদ’ কনসেপ্ট বা আইনটি ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন কোন ষড়যন্ত্র নয়। উনবিংশ শতাব্দী থেকেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ও গ্রুপগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে আসছে। অনেক আগে থেকেই তারা অভিযোগ করে আসছে যে, ভারতের মুসলমানরা হিন্দু নারীদেরকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তর করার জন্য তৎপর রয়েছে। তারা হিন্দু নারীদের গর্ভে মুসলিম সন্তান জন্ম দিতে চায়। এভাবেই তারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের জনসংখ্যার চিত্র বদলে দিতে চায়।
তাদের এই দাবিটি বর্তমানে আরও জোরালো হয়েছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা ভারতের মুসলমানদের কোনঠাসা করার উদ্যোগ জোরদার করেছে। এর মাধ্যমে তারা ধর্মনিরপেক্ষ গনতান্ত্রিক ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। ২০১৮ সালে ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে শোরগোল বিজেপি ও তার মিত্র দল এবং সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচীর অংশে পরিণত হয়।
ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ কেরালায় আন্তঃধর্মীয় বিয়ে নিয়ে তদন্ত করে। এর অংশ হিসেবে তারা বেশ কিছু অভিযোগ যাচাই করে দেখে। তদন্তের ফল যে রকম আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, বাস্তবে তার কিছুই পাওয়া যায়নি। সেখানে হিন্দু নারীদের জোর করে ধর্মান্তরের কোন প্রমানই পায়নি তদন্ত সংস্থা। উত্তরপ্রদেশের কানপুরেও একই ধরনের তদন্ত করে সংস্থাটি। কিন্তু সেখানেও অভিযোগের কোন সত্যতা পায়নি তারা।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু নারীদের জোর করে ধর্মান্তরের অভিযোগের কোন প্রমান না থাকা সত্ত্বেও উগ্রপন্থি হিন্দু গ্রুপগুলো রাজ্য প্রশাসনের সহযোগিতায় আন্তঃধর্মীয় বিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে আসছে। ভারতের ১৯৫৪ সালের স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিভিন্ন ধর্মের প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারীর মধ্যে বিয়ের সুস্পষ্ট আইনগত বিধান রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নানা অযুহাতে এ ধরনের বিয়ে নিবন্ধন করতে চায় না। অনেক সময় নিবন্ধন করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ পাত্র-পাত্রীর নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট সম্প্রতি আন্তঃধর্মীয় বিয়ে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে। রায়ে আদালত আন্তঃধর্মীয় বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করার সরকারি নিয়ম বাতিল করে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, এই নিয়ম মানুষের প্রাইভেসিতে আগ্রাসন চালানোর সমতুল্য। এই নিয়মের কারণে উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলো হস্তক্ষেপের সুযোগ পায় এবং তারা মেয়েটিকে তার বাবা-মার কাছে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়।
ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ধর্মান্তরবিরোধী আইন করার ফলে বিজেপি মুসলমান ছেলেদেরকে আইনগতভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করার রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। এখন উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলো আন্তঃধর্মীয় বিয়ে ভাঙার জন্য পুলিশের সাথে প্রকাশ্যেই মাঠে নেমে পড়েছে। এর মাধ্যমে তারা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের অবমাননা এবং মুসলিম পুরুষ ও ছেলেদেরকে কারাগারে পাঠানোর সুযোগ পেয়ে গেছে।
মুসলিমবিরোধী নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাশ করে ভোটাধিকার হরণ, তিন তালাক আইন ও ধর্মান্তর বিরোধী আইনসহ নানা আইন করে বিজেপি ভারতের মুসলমানদেরকে নির্মূল করতে চায়। এ ব্যাপারে তারা রাখঢাক করছে না। বিজেপি ভারতের মুসলমানদের কন্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চায়। এ ক্ষেত্রে ধর্মান্তরবিরোধী তাদের একটি নতুন অস্ত্র মাত্র।