চীনকে ঘায়েল করতে ভারতকে কাজে লাগাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২০ জানুয়ারি ২০২১, ১৩:৪২

ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে প্রণীত মার্কিন পররাষ্ট্র ও সামরিক কর্মকৌশল ফাঁস হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য এভাবে ফাঁস করে দেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। এ অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয় হলো- পশ্চিম ও মধ্য প্রশান্ত অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে চীনের পাশাপাশি উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিও পরিষ্কার হয়ে গেছে।

চীনের সামরিক প্রভাব ও শক্তিকে খর্ব করার জন্যই ভারতকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল মার্কিন নীতিনির্ধারকরা। ফাঁস এই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় তার মিত্র দেশগুলোকে কীভাবে চীন ও উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে ব্যবহার করবে সেই চিত্রও পরিষ্কার হয়ে গেছে।

বিগত ৩ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল একচ্ছত্রভাবে প্রশান্ত –ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশল ও নীতিমালা প্রণয়নে কাজ করছে। ২০১৮ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা কৌশল চূড়ান্ত করার কয়েক দিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশান্ত-ভারতীয় অঞ্চলের জন্য এ কৌশল অনুমোদন করেন।

প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকায় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিকভাবে মার্কিনী প্রভাব বিস্তার করা, কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতির এক তৃতীয়াংশ এ অঞ্চলকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। মিত্রদেশগুলোর আস্থা অর্জন করা এবং এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বাড়ানো।

এই প্রতিবেদন থেকে ধারণা পাওয়া যায়, এই অঞ্চলে চীনকেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রধান হুমকি হিসেবে মনে করছে। চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্যকে দমিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার মতো করে একটি নতুন উদার অর্থনৈতিক কর্মপন্থা নিয়ে এ অঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছে। তারা আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নতির কথা বলে মিত্রদেশগুলোকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছে। প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয় যে, চীন আগামীতে আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে সুবিধা হাসিল করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে যা দুই দেশকে আবারও পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।

চীন ঠিক কীভাবে এ অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে তা নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন ক্রমাগতভাবে ডিজিটাল নজরদারি, তথ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে ক্ষুন্ন করছে। চীনের এসব ডিজিটাল কার্যক্রমের পাশাপাশি চীনের পারমাণবিক কার্যক্রম, লং রেঞ্জ ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল তৈরিতে চীনের সক্ষমতা এবং চীনের নৌ বাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

২০২০ সালে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিল যাতে দেখা যায় চীনা সেনাবাহিনী কীভাবে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমান ঘাটিতে হামলা চালিয়েছিল।

মার্কিনীরা মনে করে, তারা চীনের ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন বা প্রথম দ্বীপ শৃংখলটি মোকাবেলা করতে সক্ষম। যদিও ফাস্ট আইল্যান্ড চেইনের আকাশপথ ও নৌপথে চীনের শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপ, জাপান, তাইওয়ান, ফিলিপিনস, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মধ্য দিয়েও প্রশান্ত মহাসাগরের জলরাশি চলে গিয়েছে। চীন দীর্ঘদিন থেকে এ নৌ অঞ্চলের কর্তৃত্ব দাবি করে আসছে। মার্কিনীরা শুধু ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন নয় বরং এর বাহিরে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্যন্য অঞ্চলেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছে।

দক্ষিণ চীন সাগর ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সামরিক কর্মকান্ড বিগত কয়েক বছরে অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন ও তার মিত্র দেশগুলোও কিছু তৎপরতা চালালেও চীনের কার্যক্রমগুলো অনেক বেশি দৃশ্যমান।

ট্রাম্প প্রশাসনের এ আঞ্চলিক কৌশলের প্রভাবে সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তাইওয়ানের সাথে বড়ো আকারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আরেক দফা ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্প গত ৪ বছরে তাইওয়ানের সাথে শুধু অস্ত্র চুক্তিই করেননি বরং তাইওয়ানের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নানাভাবে সহায়তা করেছেন এবং কুটনৈতিক সম্পর্ককেও জোরদার করেছেন।

এবার আসা যাক যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর কোরিয়া বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে। চীনকে সামরিকভাবে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উত্তর কোরিয়ার এখন আলাদা গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। উত্তর কোরিয়া ২০১৭ সালে বেশ কয়েকটি মিসাইল উৎক্ষেপণ করে যার মধ্যে একটি জাপানের ওপর দিয়ে চলে যায়। এ ঘটনাকে জাপান ও তার মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। এই মিসাইল উৎক্ষেপনের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া মিসাইল প্রযুক্তিতে তার শক্তিমত্তারও ইংগিত দেয়।

মার্কিন রণকৌশল সংক্রান্ত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর কোরিয়া ক্রমাগতভাবে মার্কিনীদের মিত্রদেশ দক্ষিণ কোরিয়াকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। উত্তর কোরিয়ার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকায় তাদের এ জাতীয় কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্র ও এর সকল মিত্রদেশের জন্য হুমকি বলেও মন্তব্য করা হয়।

ফাঁস হওয়া মার্কিন এসব নথিপত্র অনুসন্ধান করে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি পর্যায়ে উত্তর কোরিয়ার ওপর পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের কথাও ভেবেছিল। কিন্তু এসব কিছু থেমে যায় যখন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন। দক্ষিন কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথেও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট বৈঠক করেন। এরপরই দুদেশের মধ্যকার বরফ গলতে শুরু করে। উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন চলে আসে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য জাপান ও দক্ষিন কোরিয়াকে কাজে লাগানোর সুনির্দিষ্ট কৌশলও প্রনয়ন করে। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর কোরিয়া বিষয়ক পরিকল্পনার মধ্যে ছিল এর পারমাণবিক সক্ষমতাকে খর্ব করে দেয়া এবং সাইবার ও জীবানু অস্ত্র অকার্যকর করে দেয়া।

যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে জানিয়েও দিয়েছে যে, উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার শাসনের বিষয়ে তাদের কোনো আপত্তিও থাকবে না যদি তারা নিজেদের পারমাণবিক কার্যক্রমকে বন্ধ করে দেয়। আর উত্তর কোরিয়াকে এ কাজে রাজি করানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর অর্থনৈতিক, কুটনৈতিক, সামরিক ও আইনগত চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। এ কৌশলপত্র অনুযায়ী সমঝোতা বা আলাপ আলোচনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকা শেষ অপশন।

মিত্র দেশ হিসেবে এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছে ভারত। বিশেষ করে ভারত, জাপান, অস্ট্রোলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে যে আঞ্চলিক জোটটি সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত হয়েছে তাকে চীনের আঞ্চলিক আধিপত্য মোকাবেলায় সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করছে।

এ প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের সাথে ভারতের দীর্ঘ সীমানা থাকলেও সীমান্ত উস্কানি মোকাবেলায় ভারত যথেষ্ট সক্ষম। যদিও লাদাখে গত বছর চীন ও ভারতের মধ্যে যে সংঘাত হয়, তাতে ভারত যেভাবে পরাস্ত হয় তা মার্কিন এ রিপোর্টের যথার্থতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে পাকিস্তানের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। যদিও পাকিস্তানের সাথে চীনের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালেই ভারতের প্রতিরক্ষাখাত শক্তিশালী করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ অঞ্চলে ভারতকে মার্কিন প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের প্রধান অংশীদার হিসেবেও গণ্য করা হয়।

বলা হয়, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে যত বেশি সক্ষমতা অর্জন করবে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদেশগুলো ততটাই উপকৃত হবে। ভারতকে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র খুব শীঘ্রই ভারত মহাসাগরে একটি নেী ঘাটি তৈরি করবে বলেও জানানো হয়। তেমনটা হলে, প্রশান্ত মহাসাগরের নিকটবর্তী অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি হবে। পাশাপাশি দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র লংরেঞ্জ মিসাইল উৎক্ষেপণ করার মতো কাঠামো তৈরি করবে। যা চীনের ক্রমবর্ধমান মিসাইল শক্তিমত্তাকে ভালোভাবেই চ্যালেঞ্জ করা যাবে বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে।

কাগজে কলমে যতই পরিকল্পনা থাকুক না কেন, বিগত ৩ বছরের বাস্তবতা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্রের এসব পরিকল্পনার অধিকাংশই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। চীন এখনও সফলভাবেই এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভুত হচ্ছে।