ভারত-তুরস্ক মিডিয়া যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্র


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৩:৩৬

ভারতীয় মিডিয়ায় বেশ কিছু দিন ধরে তুরস্ক নিয়ে নানা নেতিবাচক সংবাদ বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। পাকিস্তানের খবরের ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তেমনি তুরস্কের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ভারতের একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভারতের দাবি, তুরস্ক দেশটির মিডিয়াগুলোকে ব্যবহার করে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট প্রচার করার চেষ্টা হচ্ছে। কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরের অসংখ্য স্থানীয় নাগরিক ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে হত্যা ও দমন পীড়ন চালাচ্ছে, তুরস্কের মিডিয়ায় এমন খবর প্রচারিত হওয়ার পর ভারত এ মন্তব্য করল।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ভারতবিরোধী প্রচারণায় সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের মিডিয়াগুলো বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ভারতের বেশি ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে তুরস্কের মিডিয়া হাউজ টিআরটি এবং আনাদুলু এজেন্সির বিরুদ্ধে। ভারত মনে করছে, এ দুই মিডিয়া শুধু ভারতবিরোধী খবরই প্রচার করে না বরং কাশ্মীর ইস্যুতে নানা ধরনের অতিরঞ্জিত খবরও প্রচার করে।

গত বছর ভারত নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নামে নতুন যে আইনটি প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করে, তুরস্কের মিডিয়া তার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছে বলে ভারত মনে করে। তুরস্কের মিডিয়া ছাড়াও বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের বিরাট একটি অংশই মনে করে যে, ভারত মূলত দেশটির মুসলিমদেরকে কোণঠাসা করার জন্যই বিতর্কিত এই আইনটি কার্যকর করার চেষ্টা করছে।

ভারতের সাথে তুরস্কের দীর্ঘদিন যাবত এক ধরনের আন্তরিক দ্বিপাক্ষিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তারপরও তুরস্কের ওপর ভারতের হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার কারণ হলো ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের সাম্প্রতিক হৃদ্যতা। এছাড়া বিগত কয়েক বছরে তুরস্ক যেভাবে মুসলিম বিশ্বের প্রধান একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভারত তাও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। জি নিউজ ইন্ডিয়ার সে খবরে বলা হয়, নব উদ্যমে তুরস্ক আর পাকিস্তানের মধ্যে একটি গাঁটছড়া জমে উঠেছে। আর সে কারণেই তুরস্ক এখন পাকিস্তানের জন্য নিরাপদ স্বর্গ হয়ে উঠেছে। তুরস্ক নানা ধরনের পরোক্ষ কার্যক্রমের মাধ্যমে পাকিস্তানের ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলেও সংবাদে দাবি করা হয়।

জি নিউজ দাবি করেছে, পাকিস্তানের মতো করে তুরস্কও একইভাবে কাশ্মীরে ভারত সরকারের কথিত জুলুমের কথা বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। গত বছর ভারত যখন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল ও কাশ্মীরকে নিজেদের মানচিত্রে দেখানোর পর থেকেই পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মালয়েশিয়া ও তুরস্ককে সাথে নিয়ে পাকিস্তান ওআইসির ওপরও চাপ সৃষ্টি করে, যাতে কাশ্মীরের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেওয়া যায়।

ভারতীয় বেশ কিছু গণমাধ্যম দাবি করছে, তুরস্ক কাশ্মীরিদেরকে উসকানি দেয়ার চেষ্টা করেছে। বিষয়টি শুধু রাজনৈতিকভাবেই আর সীমাবদ্ধ নয়। তুরস্ক সাংস্কৃতিকভাবেও আগ্রাসন চালিয়ে কাশ্মীরের জনগণকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে। জি নিউজ দাবি করছে, তুরস্কের জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল দিরিলিস এরতুগুল এবং বাবা এরই মধ্যে কাশ্মীরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অন্যদিকে, কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী নেতা সাইয়েদ আলী শাহ গিলানীর নাতি রুয়া শাহ সম্প্রতি তুরস্কের টিআরটি চ্যানেলে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব পাওয়ার পর সেখানে কাশ্মীরে ভারতের নির্যাতন প্রসঙ্গে নানা কথা বলেন এবং ভারতবিরোধী অবস্থান পোষণ করেন।

জি নিউজ আরো দাবি করছে, তুরস্ক কাশ্মীরের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদেরকেও নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে তুরস্ক সরকার কাশ্মীরের মজলুম শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষনীয় স্কলারশিপ ও একাডেমিক ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুযোগ চালু করেছে। যা ভারতের প্রশাসনের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত বছরের গোড়ার দিকে পাকিস্তান সফরকালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছিলেন, পাকিস্তানের জন্য কাশ্মীর যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তুরস্কের জন্যেও ঠিক একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং অভ্যুত্থান মোকাবেলায় পাকিস্তান মিত্র দেশ হিসেবে যেভাবে আমাদেরকে সাহায্য করেছিল তা আমরা কখনোই ভুলিনি এবং ভবিষ্যতেও ভুলবো না। এবার আমরা কাশ্মীরের প্রতিও আমাদের দায় শোধ করবো।

জি নিউজ দাবি করছে, তুরস্কের মিডিয়া কাঠামোতে এমন কিছু লোক এখন বসে গেছে যারা একইসঙ্গে পাকিস্তান সমর্থক আবার ভারতের স্বার্থবিরোধী। এমনকী ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কয়েকজন নাগরিকও সেখানে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেছে। তারা পাকিস্তানের ইশারা ও নির্দেশনা মোতাবেকই কাজ করে যাচ্ছে বলেও জি নিউজ দাবি করে। ভারতীয় এ গণমাধ্যমের আশঙ্কা যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে পশ্চিমা নাগরিকেরা কাশ্মীরে ভারতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ভুল বার্তা পাবে।

নিউইয়ক টাইমস একটি পর্যবেক্ষনে জানিয়েছে, জো বাইডেন দায়িত্ব নেয়ার পর ভারত প্রশাসন কাশ্মীর ইস্যুতে নতুন করে চাপের মুখে পড়তে পারে। কাশ্মীর ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে ভারতকে সমর্থন করে যাওয়ায় ভারতের কাশ্মীরবিরোধী কার্যক্রমটি শেষ পর্যন্ত সেভাবে আর আন্তর্জাতিক ফোরামের নজরে আসেনি। তবে, মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাইডেন আসার পর কাশ্মীরে ভারতের নিপীড়নমুলক কার্যক্রম ও মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি ফের আলোচনায় আসতে পারে।

নিউইয়ক টাইমসে প্রকাশিত একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্য সব প্রেসিডেন্টের মতো জো বাইডেনও ভারতের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক জারি রাখতে চায়। একইসঙ্গে বাইডেন ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতিরও উন্নয়নও দেখতে চায়। বিশেষজ্ঞদেরকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি আরো জানায়, বাইডেন প্রশাাসন মোদি সরকারের দমন পীড়ন বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি ভারতীয় প্রশাসনের শত্রুতাসুলভ আচরণের প্রতি এবার হয়তো বিশেষ দৃষ্টি দেবে। এই রিপোর্টে আরো বলা হয় যে, খুব সম্ভবত বাইডেন প্রশাসন ভারতীয় সরকারকে দখলকৃত কাশ্মীরে মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করার জন্য জোর সুপারিশ করবে।

বাইডেন প্রশাসন যদি এরকম কোনো পদক্ষেপ নেয় তাহলে পাকিস্তান এর ভালো ফায়দা পাবে। কারণ কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের অমানবিক কার্যক্রমকে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিতে আনতে চাইছে।

নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস উভয়েই কাশ্মীর ইস্যুতে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার পর থেকেই সেখানে নানা ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ভারত এর পরপরই কাশ্মীরে অতিরিক্ত সংখ্যক সেনা মোতায়েন করেছে। সেখানকার ইন্টারনেট সংযোগ এখনো অস্থিতিশীল। কাশ্মীরে বেসামরিক নাগরিকদের যাতায়াতও এখন অনেকটাই সীমিত করে দেয়া হয়েছে।

বাইডেন তার একটি নির্বাচনী ভাষণে বলেছিলেন , কাশ্মীরে ভারতীয় সরকারের সচেষ্ট হওয়া উচিত যাতে সেখানে জনগনের অধিকারকে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস বলেছিলেন, আমরা কাশ্মীরের শান্তিকামী জনগণকে জানিয়ে দিতে চাই যে, তারা মোটেও নিঃসঙ্গ নয়।

নিউইয়ক টাইমস প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতকে যদি আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের ঘনিষ্ট মিত্র হয়ে উঠতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই বাইডেনের সুপারিশমতো মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ‘দ্য ওয়্যার’ বিশ্লেষনে বলেছে, বাইডেনের বিজয় নতুন করে মোদিকে চাপের মুখে ফেলবে। কারণ ডেমোক্র্যাাট দল এবং এর নেতৃবৃন্দ বরাবরই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে মোদি সরকারের নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘনের সমালোচনা করেছে।

২০১৯ সালের আগষ্ট মাস থেকে কাশ্মীর ইস্যু লাইমলাইটে চলে আসে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদিও ভারতের সরাসরি বিরোধিতা করেনি কিন্তু ভারত যেভাবে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ক্ষুন্ন করে তাও সমর্থন করেনি। বরং অনেকেই ভারতের এসব সিদ্ধান্তকে অ প্রয়োজনীয় ও গায়ে পড়ে ঝগড়া করার মতোই মনে করেছে।

অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নায়ান চান্দা অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, বাইডেন ভারতের কাশ্মীর নীতিকে সমর্থন না করলেও প্রকাশ্যে ভারতকে কাশ্মীরে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার কথা বলবে না। চান্দা মনে করেন আন্তর্জাতিক নীতি কখনো এককেন্দ্রিকভাবে অগ্রসর হয় না।

অনেক বিশ্লেষম অবশ্য মনে করেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আগামীতে ইতিবাচকভাবেও মোড় নিতে পারে। কেননা জো বাইডেন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রথম যে কয়েকটি দেশের সরকার প্রধানের সাথে ফোনে কথা বলেছিলেন তার মধ্যে একজন হলেন ভারতের নরেন্দ্র মোদি।

এ টেলিফোনিক কথোপকথোনে দুই নেতা দু দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, করোনা মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভারত- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করেন। তবে নিউইয়র্ক টাইমস তার প্রতিবেদনে বলছে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আগামী দিনে কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে চীনের ভূমিকার ওপর। কারণ যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু চীনকে নানাভাবে মোকাবিলা ও প্রতিরোধের চেষ্টা করে তাই বাইডেন এসেই হয়তো ভারতকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে বন্ধু হারাতে চাইবেন না। বরং ভারতের সাথে ব্যবসা ও সামরিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করে চীনকে একটি প্রচ্ছন্ন চাপের ওপর রাখার চেষ্টা করবেন।