ডিজিটাল যুদ্ধে তুরস্কের বড় জয়


  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৪৮

ভূরাজনীতিতে একের পর এক সাফল্য নিয়ে বারবার শিরোনাম হচ্ছে তুরস্ক। রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নামটি এখন চৌকষ নেতৃত্বের সমার্থক। বিশ্বের তথাকথিক মোড়লদের আড়াল করে তিনি আলোচনায় আসছেন অত্যাধুনিক সমর প্রযুক্তি ও কৌশল নিয়ে। স্থল-পানি-আকাশ- সবখানেই স্বকীয়তা নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে এগোচ্ছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। এবার তিনি সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন ডিজিটাল যুদ্ধে জয়লাভ করে। দুইশ কোটি মানুষের অ্যাপলিকেশন ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ বর্জন করে তিনি এবং তার দেশ এখন ব্যবহার করছেন নিজেদের অ্যাপ ‘বিআইপি’ বা ‘বিপ’।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার কার্যালয়ে মার্কিন অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য তিনি এর পরিবর্তে তুরস্কের অ্যাপ ‘বিআইপি’ ব্যবহার করছেন।

হোয়াটসঅ্যাপের নতুন নিয়মের ফলে গোপনীয় তথ্য ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে যোগাযোগ মাধ্যমটি বর্জন করেছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় এবং দেশটির সামরিক বাহিনী। এখন থেকে বার্তা আদান-প্রদানের জন্য তারা স্থানীয় তুর্কি মেসেজিং অ্যাপটি ব্যবহার করবেন।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তুর্কি মোবাইল নেটওয়ার্ক জায়ান্ট তুর্কসেলের ‘বিআইপি’ অ্যাপের মাধ্যমে এখন থেকে সাংবাদিকদের খবরাখবর জানাবে দেশটির গণমাধ্যম কার্যালয়।

হোয়াটসঅ্যাপের নতুন নিয়মে কী রয়েছে? যে কারণে তুরস্ক অ্যাপটি বয়কট করতে বাধ্য হলো?

অ্যাপটি সম্প্রতি জানিয়েছে, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জারসহ তাদের অ্যাপগুলোর মধ্যে যোগাযোগ নম্বর ও প্রোফাইল তথ্যের আদান-প্রদান আরও বাড়বে। তবে বার্তাগুলো এনক্রিপটেড থাকবে বলে জানিয়েছেন তারা। সেক্ষেত্রে ক্লাউড স্টোরেজ বা অনলাইনে বার্তাগুলোর ব্যাকআপ থাকবে। সব ব্যবহারকারীকে নতুন নিয়মে সম্মতি জানাতে হবে, নইলে অ্যাকাউন্ট বাতিল করতে হবে।

যেহেতু ব্যাকআপে থাকা বার্তাগুলো পাওয়া যাবে, তাই এনক্রিপশনে কোনো লাভ হবে না বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা। হোয়াটসঅ্যাপের নতুন সিদ্ধান্তে তাই সন্দেহ হয় তুরস্কের। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সরকার কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তথ্য পাচার হবেÑ এ সন্দেহে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন নীতিমালা স্থগিত করে তুরস্ক। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করার পর এ সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এক বিবৃতিতে তুরস্ক জানায়, সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপ অনেক ব্যবহারকারীকে ফেসবুকের সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করে নেওয়ার জন্য নতুন গোপনীয়তা বিধিতে সম্মত হতে বাধ্য করে। শর্ত না মানলে অ্যাপটি ব্যবহার করা যাবে না বলেও জানায় হোয়াটসঅ্যাপ।

বার্তা সংস্থা আনাদোলুর খবরে বলা হয়, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্যবহারকারীরা নতুন নিয়ম গ্রহণ করলেও হোয়াটসঅ্যাপকে তথ্য শেয়ার স্থগিত করে রাখবে। ফেসবুককেও ডেটা শেয়ারিং স্থগিত করতে হবে এবং সব ব্যবহারকারীর কাছে পদক্ষেপ ঘোষণা করতে হবে।

তুরস্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচালনার যে আইন রয়েছে, তা লঙ্ঘন করায় নভেম্বরে ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামসহ বৈশ্বিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১০ মিলিয়ন লিরা জরিমানা করেছিল তুরস্ক, যা মার্কিন মুদ্রায় প্রায় ১২ লাখ ডলার।

এদিকে, হোয়াটসঅ্যাপের নতুন নিরাপত্তা নিয়মের বিরুদ্ধে দেশটির সরকারের তদন্ত শুরুর পর ‘বিআইপি’ অ্যাপসের গ্রাহক রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। তদন্ত শুরুর মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ অ্যাপ ডাউনলোড হয়েছে ১২ লাখ বার। আনাদোলু জানায়, বর্তমানে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে ৫ কোটি। শুধু তুরস্ক নয়, হোয়াটসঅ্যাপের বিরুদ্ধে তুর্কি পদক্ষেপের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বের ব্যবহারকারীদের মধ্যে। বর্তমানে ১৯২টি দেশে এ অ্যাপের গ্রাহক রয়েছে।

এ অ্যাপের স্বকীয়তা হলো- এতে ‘ডিসঅ্যাপিয়ার মেসেজ’ অপশন রয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ছাড়াই মেসেজ পাঠাতে পারেন। প্রেরক যে সময় নির্ধারণ করে দেন, এ সময়ের পর প্রাপকের ডিভাইস থেকে বার্তাগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়।

এতে রয়েছে ইমার্জেন্সি বাটন। যার মাধ্যমে আগে থেকে নির্ধারিত ১০ জনের কাছে লোকেশন এবং অবস্থা শেয়ার করা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এর ব্যবহার হয়ে থাকে। এর ইমার্জেন্সি ফিচারের মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশের মতো জরুরি ফোনের ভাণ্ডারেও প্রবেশ করা যায়।

ইনস্ট্যান্ট মেসেজিংয়ের সময় এর অনুবাদ ফিচারের মাধ্যমে ১০৬টি আলাদা ভাষায় ব্যবহারকারীরা চ্যাট করতে পারেন।

প্রযুক্তিতে তুরস্কের ভূমিকা সবসময় অগ্রণী। তবে, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দেশটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেয় তাদের বৈশ্বিক স্বপ্নকে সামনে রেখে। দেশটি দেখেছে, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো ডিজিটাল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাচ্ছে, পৃথিবীতে দিন দিন তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বে ‘ডিজিটাল উপনিবেশবাদের’ উন্মেষ ঘটেছে।

এ প্রেক্ষাপটে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি বলেন, এখান থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। ডিজিটাল বিপ্লব না হলে তুরস্ককে অন্যায়ের শিকার হতে হবে এবং দেশটিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হবে।

এ সপ্তাহে হোয়াটসঅ্যাপ প্রাইভেসি পলিসিতে বাধ্যতামূলক আপডেট আনলে তুরস্কের ব্যবহারকারীরা তাদের প্রেসিডেন্টের মনোভাবকে সম্মান দেখিয়ে ‘ডিলিটিং হোয়াটসঅ্যাপ’ হ্যাশট্যাগ নিয়ে টুইটারে সক্রিয় হন। হোয়াটসঅ্যাপের বিরুদ্ধে এক লাখেরও বেশি পোস্ট শেয়ার হয় তুরস্কে। তারা স্থানীয় মেসেজিং অ্যাপগুলোর দিকে আগ্রহী হন।

তুরস্কে মেসেজিংয়ের বিভিন্ন অ্যাপ থাকলেও বিআইপি, দেদি, সিগনাল এবং টেলিগ্রাম ডাউনলোড হয় বেশি।

‘হ্যালো টু প্রাইভেসি’ স্লোগান নিয়ে ২০১৪ সালে শুরু হয়েছিল মেসেজিং সার্ভিস ‘সিগনাল’-এর কার্যক্রম। এখন হোয়াটসঅ্যাপের পরিবর্তে এ অ্যাপের জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘দ্য সিগনাল ফাউন্ডেশন’-এর ডেভেলপ করা অ্যাপটি ২০১৯ সালে তুরস্কে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

অ্যাপ স্টোরগুলোতে যখন হোয়াটসঅ্যাপ ক্ষমতা হারাচ্ছে, তখন দেশটিতে ব্যবহারকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় ‘টেলিগ্রাম’। ২০১৩ সালে দুই রাশিয়ান ভাই কম্পিউটার প্রোগ্রামার পাভেল দুরোভ এবং নিকোলাই দুরোভ মিলে এ অ্যাপটি বানিয়েছিলেন। এর সদর দফতর লন্ডনে।

অনেক ব্যবহারকারী মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর হোয়াটসঅ্যাপ বলছে, ‘ইউরোপীয় অঞ্চলের’ ব্যবহারকারীদের তথ্য ফেইসবুকের সঙ্গে শেয়ার হবে না। এ আপডেটের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।

অ্যাপটির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ইউরোপীয় অঞ্চল বলতে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কথা বলেছেন। কেউ কেউ এ অবস্থানকে দ্বৈতনীতি হিসেবে আখ্যা দেন। হোয়াটসঅ্যাপ হয়তো তথ্য নিরাপত্তা আইনের অধীনে ইইউ দেশগুলোর শাস্তির মুখে পড়বে, এ ভয়ে তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে।

শুধু তুরস্ক নয়, হোয়াটসঅ্যাপের নতুন নীতি নিয়ে শোরগোল ওঠে যায় বিশ্বে। এ প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা পুরো বজায় থাকবে বলে আশ্বাস দেন হোয়াটসঅ্যাপ প্রধান। তিনি জানান, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীদের তথ্য ফেইসবুককে দেওয়ার মতো বিষয়ে নীতিতে কোনো বদল হচ্ছে না।

পরপর বেশ কয়েকটি টুইট করে হোয়াটসঅ্যাপের প্রধান উইল ক্যাথকার্ট জানান, ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংক্রান্ত নীতিতে আমরা যে বদল আনার কথা ঘোষণা করেছি, সে বিষয়ে গত কয়েকদিন ধরে বহু আলোচনা হচ্ছে। ফলে এ প্রেক্ষাপটে কয়েকটি কথা জানাতে চাই। হোয়াটসঅ্যাপ গোটা বিশ্বে ২০০ কোটি মানুষের ব্যক্তিগত আলাপ গোপন রাখার বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে দায়বদ্ধ। আপনাদের প্রত্যেকেরই গোপন কথা রয়েছে। এবং প্রিয়জনের সঙ্গে যে কথাবার্তার আদানপ্রদান করছেন অথবা হোয়াটসঅ্যাপে কল করে যে কথাবার্তা বলছেন, সেটি নিশ্চিতভাবে আপনাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এ বিষয়ে আমাদের নীতিতে কোনরকম বদল আসছে না।’

তিনি আরো জানান, ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’-এর ফলে আমরা আপনাদের ব্যক্তিগত কোনো মেসেজ বা কল দেখতে অথবা জানতে পারি না। ফেইসবুকও এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাচ্ছে না। আমরা সারা বিশ্বে এই প্রযুক্তি বজায় রাখার বিষয়ে একান্তভাবে দায়বদ্ধ।’
হোয়াটসঅ্যাপ প্রধান আরও বলেন, ‘আমরা স্বচ্ছ থাকার জন্য মূলত নীতিতে কয়েকটি বদল এনেছি। বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়টি মানুষের সামনে আরও ভালোভাবে তুলে ধরার জন্য নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা গত অক্টোবরেই বিষয়টি জানিয়েছিলাম। এর ফলে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেই বাণিজ্য সংক্রান্ত বার্তা আদান-প্রদান করা যাবে। বাণিজ্যসংক্রান্ত কথোপকথনের জন্যই আমরা আপডেট করেছি’।

সন্দেহ-সংশয়ের আবর্তে থাকা বিষয়টি নিয়ে অনেক প্রতিবাদ হচ্ছে। বলা হচ্ছে, হয়তো হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীদের গোপনীয় তথ্য ফেইসবুকের কাছে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে সমস্যা বাড়বে। সঙ্গত কারণেই হোয়াটসঅ্যাপ প্রধানের এ বক্তব্যের পরও আশ্বস্ত হতে পারছেন না ব্যবহারকারীরা।

একটি রাষ্ট্র কিংবা সরকার এ সন্দেহের দোলাচলে চলতে পারে না। তাই, বিশ্বের অন্যান্য ব্যবহারকারীর মতো তুরস্কের ব্যবহারকারীরাও হোয়াটসঅ্যাপ প্রধানের বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারেননি। আশ্বস্ত হতে পারেননি এরদোয়ানও। এ ঘটনায় দেশটির যে বড় অর্জন হয়েছে, তা হলো, তাদের নিজস্ব অ্যাপ ‘বিআইপি’ ব্যবহারে দেশটির সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। সঙ্গে, সারা বিশ্বে মেসেজিং অ্যাপ ও ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল পরিষেবা নেওয়া মানুষেরা জানতে পেরেছেন, তুরস্কের ‘বিআইপি’তে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষিত হবে।

সবাই জেনেছে, বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমের স্মার্টফোনে হোয়াটসঅ্যাপ যেমন ব্যবহার করা যায়, ‘বিআইপি’ দিয়েও তা সম্ভব। শুধু চ্যাটই নয়, এর মাধ্যমে বেশ ভালোভাবেই ছবি আদান-প্রদান, ভিডিও ও অডিও বার্তাও আদান-প্রদান করা যায়। অ্যাপলের আইওএস, ব্ল্যাকবেরি, অ্যান্ড্রয়েড, সিমবিয়ান ও উইন্ডোজ ফোনে ব্যবহার করা যায় মেসেঞ্জারটি।

রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, সমরকৌশল, সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্যে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন এরদোয়ান, একইভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে তার এ প্রাপ্তিকে বড় জয় হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।