নেপালে নিয়ে নতুন করে চীন-ভারত প্রতিযোগিতা


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১১ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৪৪

নেপালে কয়েক সপ্তাহের অচলাবস্থার পর প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি আবার তৎপর হয়ে উঠেছেন। তিনি কালাপানিসহ ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা কয়েকটি স্থান নেপালকে বুঝিয়ে দিতে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নয়াদিল্লি পাঠাচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, নেপাল নিয়ে ভারতের দুঃস্বপ্ন কাটছেই না। এদিকে চীনও নেপালে তার কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

তিন বছর আগে নেপালের দুটি কমিউনিস্ট পাটির জোট যখন ক্ষমতা আসে তখন তা চীনের জন্য একটি বড় ভূরাজনৈতিক বিজয় ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে কোণঠাসা করতে সেটা ছিল বেইজিংয়ের আরেক সাফল্য। তবে গত মাসে দুই কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে চীন বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়।

প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলার শুনানি শুরু হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। ধারণা করা হচ্ছে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট হয়তো সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত দিতে পারে। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করছেন, নেপালে যে নতুন একটি রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা হয়েছে, আদালতের রায়ে তার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

রায় অলির পক্ষে গেলে তাতে চীনের সুবিধা হবে। আর বিপক্ষে গেলেও ভারতের নিটকতম প্রতিবেশী নেপালকে নিয়ে নয়াদিল্লির দুঃস্বপ্নের ইতি ঘটবে না। প্রধানমন্ত্রী অলি নেপালিদের মধ্যে ভারত বিরোধী যে মনোভাব জাগিয়ে দিয়েছেন সেটা আর শেষ হওয়ার নয়। তবে ভারত ও চীনের রশি টানাটানিতে দরিদ্র দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দূর-অস্ত বলেই মনে হচ্ছে।

কাঠমান্ডুতে সিনিয়র সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক কমল দেব ভট্টরাই মনে করেন, নেপালের ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে মোড় নেবে এখনই তা বলা মুশকিল, কিন্তু নেপাল যে আবারো নতুন একটি অস্থিতিশীল রাজনীতির আবর্তে পড়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আদালত যে রায়ই দিক না কেন তাতে এই সঙ্কটের সুরাহা হবে বলে মনে হয় না।

সুপ্রিম কোর্ট যদি প্রধানমন্ত্রীর অলির সিদ্ধান্তের পক্ষে রায় দেয়, তাহলে তার নিজের দল নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টির একটি অংশ এবং প্রধান বিরোধী দলগুলো হয়তো মধ্যবর্তী নির্বাচন বয়কট করবে। আর যদি সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে মি অলির বিরুদ্ধে তার নিজের দলের একটি অংশই হয়তো অনাস্থা প্রস্তাব এনে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করবে। সুতরাং রায় যেটাই হোক হোক না কেন সঙ্কট তাতে মিটবে না বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

নেপালের নতুন এই রাজনৈতিক সঙ্কটের মূলে রয়েছে ক্ষমতাসীন নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টির দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব যা সাম্প্রতিক সময়ে চরমে পৌঁছেছে। বাস্তবতা হচ্ছে নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে গেছে। মীমাংসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে সঙ্কটের আশু মীমাংসাও এখন সম্ভব নয়।

নেপালের প্রধান যে দুই মাওবাদী দল সশস্ত্র আন্দোলন করে রাজতন্ত্র উৎখাত করেছিল এবং পরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, তারাই এখন পরস্পরের বৈরি হয়ে উঠেছে।

২০১৭ পার্লামেন্ট নির্বাচনে কে পি অলির দল সিপিএন-ইউএমএল এবং পুস্পা প্রচন্দ কমল দাহালের সিপিএন একটি নির্বাচনী মোর্চা তৈরি করে।

২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে অলির দল সবচেয়ে বেশি ১২১টি আসন জিতলে পুষ্পা দাহালের সমর্থন নিয়ে তিনি সরকার গঠন করেন।পরপরই মূলত চীনের চেষ্টায় এই দুই মাওবাদী দল একত্রিত হয়ে নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিএন) নামে অভিন্ন দল তৈরি করে।

অলি এবং প্রচন্ডের মধ্যে তখন চুক্তি হয় দলে এবং সরকারে তাদের ক্ষমতা সমানভাবে ভাগাভাগি হবে। কিন্তু প্রচন্ড বেশ কিছুদিন ধরে অভিযোগ করছেন যে অলি তার কথা রাখেননি, এবং দলে ও সরকারে একচ্ছত্র প্রাধান্য তৈরির চেষ্টা করছেন। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা দাহাল এবং তার অনুগতরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই প্রধানমন্ত্রী অলি সংসদ ভেঙ্গে দিয়েছেন।

সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার বিরুদ্ধে গত কয়েকদিন ধরে রাজধানী কাঠমান্ডু ছাড়াও নেপালের অন্যত্র হাজার হাজার মানুষ মিছিল সমাবেশ করছে। রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা বা নেপালকে আবারো হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার পক্ষের দল এবং গোষ্ঠীগুলোও এই সুযোগে সরব হয়েছে। তারাও এখন নতুন করে বিক্ষোভ জমায়েত করছে।

নেপালে এই অস্থিরতার দিকে নেপালিদের যতটা নজর তাদের যতটা উদ্বেগ, প্রতিবেশী দুই জায়ান্ট চীন এবং ভারতের নজর-আগ্রহ তার বেশি ছাড়া কম নয়। মূলত তিব্বতের কারণে চীনের কাছে নেপালের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। ভারতের সাথে চীনের ক্রমবর্ধমান বৈরিতার প্রেক্ষাপটে সেই গুরুত্ব আরও বেড়েছে।

পঞ্চাশের দশকের পর তিব্বতের বিদ্রোহীরা নেপালে আশ্রয় নিয়ে বহু বছর ধরে চীন বিরোধী তৎপরতা চালিয়েছে। চীন কোনোভাবেই চায় না নেপালের ভূমি আর কখনো চীন বিরোধী তৎপরতার জন্য ব্যবহার করা হোক। গত বছরগুলোতে চীন যেভাবে নেপালে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে, কোনোভাবেই তা তারা নষ্ট করতে তারা চাইবে না।

নেপালে নতুন অবকাঠামোর প্রায় সবগুলোই এখন চীনের টাকায় হচ্ছে। সে কারণেই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী উপ মন্ত্রী গুও ইঝাও গত ২৭ ডিসেম্বর কাঠমান্ডুতে এসে কম্যুনিস্ট পার্টির দুই বিরোধী পক্ষের মধ্যে মীমাংসার চেষ্টা করেন।

চীনা কম্যুনিস্ট পাটির এই নেতাই ২০১৭ সালে নেপালের মাওবাদী দুই দলের মধ্যে ঐক্য তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু এ দফায় বিরোধ মেটাতে কোনো সাফল্য তিনি পেয়েছেন বলে কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টিতে এই ভাঙন চীনের জন্য বড় একটি ধাক্কা।

চীনই দুটো মাওবাদী দলকে একত্রিত করে ক্ষমতা নিতে সাহায্য করেছিল। এটা চীনের জন্য বড় একটি রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সাফল্য ছিল। কম্যুনিস্ট পার্টি ক্ষমতা নেওয়ায় গত ক'বছরে নেপালে প্রাধান্য বিস্তারে অনেক সুবিধা চীনের হয়েছে। দলে ভাঙনে সেই সাফল্য অনেকটাই হুমকিতে পড়বে।

তবে, কম্যুনিস্ট পার্টি ক্ষমতা হারালে যে দল বা জোট পরবর্তীতে নেপালের ক্ষমতায় আসুক তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করবে চীন । চীনের সরকার এখন যতটা বাস্তববাদী ততটা আদর্শিক নয়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় তারা যে কোনো সরকারের সাথে সম্পর্কে প্রস্তুত। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও তারা একই কৌশল গ্রহন করছে।

নেপালের নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে দিল্লিতে নরেন্দে মোদির সরকার নিশ্চুপ, কিন্তু ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টিতে ফাটলে ভারত যে খুশী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিরাপত্তা ছাড়াও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দিকে দিয়ে প্রতিবেশী দেশটির গুরুত্ব ভারতের কাছে অনেক। গত কয়েক বছরে তার সাথে সম্পর্ক ক্রমেই নষ্ট হয়েছে। এবং সেই সাথে, ভারতের বৈরি একটি দেশের সাথে নেপালের সম্পর্ক ক্রমে উষ্ণ হয়েছে।

নেপালের নতুন যে মানচিত্র সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কে পি অলির সরকার সেখানে ভারত নিয়ন্ত্রিত বেশ বড় একটি এলাকাকে নেপালের অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে চরম নাখোশ ভারত। কিন্তু এ নিয়ে পিছু হটার পাত্র নন অলি। তিনি সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারিও বলেছেন, ভারতের কাছ থেকে কালাপানি, লিপুলেখ ও লিম্পিয়াধুরা ফেরত নেবে তার সরকার। এ ইস্যুতে আলোচনার জন্য তিনি নেপালি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতে পাঠাচ্ছেন।

প্রশ্ন উঠছে, নেপালে কে পি অলির সরকার ক্ষমতা হারালে বা কম্যুনিস্টরা ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও কি নেপাল থেকে চীনকে পাততাড়ি গোটাতে হবে? কাঠমান্ডুর বিশ্লেষক কমল দেব ভট্টরাই বলেন, তেমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সে কারণেই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদল নেপালের প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলে গেছে।

সন্দেহ নেই চীন নেপালের ক্ষমতায় কম্যুনিস্টদের চায় এবং চাইবে, কিন্তু বিরোধী নেপালি কংগ্রেসের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ, এ কথাও বলা যাবে না। কাঠমান্ডুর ক্ষমতায় এখন যারাই আসুন, চীনের লম্বা পকেট অগ্রাহ্য করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হবে।

মনে রাখতেহবে নেপালকে চীন আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত নেপালকে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। ভারত থেকে বছরে নেপাল আমদানি করে ৮০০ কোটি ডলারের পণ্য। বিপরীতে ভারতে রফতানি করে মাত্র ১০০ কোটি ডলারের। ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী দেশগুলো সবসময়ই অভিযোগ করে যে নানা ধরনের অশুল্ক বাধা দিয়ে প্রতিবেশী দেশের পণ্যের প্রবেশ ঠেকিয়ে দেয় নয়াদিল্লি। ভারতের এ ধরনের মনোভাবই প্রতিবেশি দেশগুলোতে তাকে অজনপ্রিয় করে তুলেছে। হিন্দুপ্রধান নেপালও কোনো ব্যতিক্রম নয়। তাই নেপালেও ভারতবিরোধী মনোভাবও তুঙ্গে। যা প্রধানমন্ত্রীর অলির একটি রাজনৈতিক শক্তি।

নেপালের এই ভারতবিরোধী মনোভাব নয়াদিল্লিকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়াবে। একারণেই একসময় ভারতের ঘনিষ্টতম দেশটিকে আর হয়তো কখনোই নিজের মত করে পাবে না নয়াদিল্লি।