তুরস্কের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে

তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা - সাটারস্টক

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:১৫

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প ও সামরিক খাত সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানপ্রেসিডেন্সি অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও তার প্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হচ্ছে, রাশিয়া থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনার কারণে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন।

কাউন্টারিং আমেরিকাস অ্যাডভাইসারিজ থ্রু স্যাংশন অ্যাক্ট বা কাটসা আইনের অধীনে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়া থেকে মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনার জন্য নিষেধাজ্ঞা পেল তুরস্ক। রাশিয়া থেকে তুরস্কের এস-ফোর হান্ড্রেড কেনার বিষয়টি শুরু থেকেই ছিল আলোচিত। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধ সত্ত্বেও তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে, আর এর জন্য কারণ হিসেবে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প কোন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি করতে রাজি হয়নি। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথ বিনিয়োগে এফ-থার্টিফাইভ ফাইটার জেট প্রকল্পেরও অংশীদার ছিলো তুরস্ক।

যুক্তরাষ্ট্র বলেছে তাদের উদ্বেগ হচ্ছে একই সাথে এস- ফোর হান্ড্রেড ও এফ-থার্টিফাইভ চালানো হলে পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটারটির ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে পারে রুশ অস্ত্রটি। যার মাধ্যমে এই ফাইটারের প্রযুক্তি রাশিয়ার হাতে যাওয়ার আশঙ্কা করেন ওয়াশিংটনের মিলিটারি ইঞ্জিনিয়াররা। আর সেটি হলে রাশিয়া সহজেই এই ফাইটারকে মোকাবেলার কোন প্রযুক্তি প্রস্তুত করে ফেলতে পারবে।

যদিও তুরস্ক বারবারই বলেছে তারা একই নেটওয়ার্কে এফ-থার্টিফাইভ ও এস-ফোর হান্ড্রেড চালাবে না। দুটোর জন্য পৃথক প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করবে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করা যায়নি। সিনেট আর্মড সার্ভিস কমিটির শুনানিতে মার্কিন সেনাবাহিনীর জেনারেল কার্টিস স্কাপারট্টি ছাড়াও, ইউরোপীয়ান কমান্ডের কমান্ডার, ন্যাটো সুপ্রিম অ্যালাইড কমান্ডারসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তুরস্কের কাছে এফ-থার্টিফাইভ বিক্রি না করার সুপারিশ করেন।

যদিও আকাশপ্রতিরক্ষা বিষয়ে তুরস্কের প্রথম পছন্দ ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেম; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেথনের নীতির সাথে তুরস্কের প্রত্যাশা মেলেনি। দাম, ডেলিভারির তারিখ ছাড়াও আরো কিছু বিষয়ে দেখা দেয় সমস্যা। বিশেষ করে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও পরবর্তীতে যৌথ উৎপাদানের বিষয়ে তুরস্ককে হতাশ করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও যুক্তরাষ্ট্র ১৭ মাস সময় ক্ষেপণ করে।

বিকল্প হিসেবে তুরস্ককে এফডি-টু থাউডেজন্ট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম সবরাহের প্রস্তাব দেয় চীন; কিন্তু বেইজিংও তাদের সমরাস্ত্রের প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। তুরস্কের চাওয়া ছিলো- যে দেশ থেকেই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনা হবে, সেখান থেকে সেটির প্রযুক্তিও আমদানি করার। কারণ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরবর্তীতে নিজেরাই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমকে আরো উন্নত করা যাবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েব এরদোয়ান ২০২৩ সালের মধ্যে তার দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে আনার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটি বাস্তবায়ন করতে এই প্রযুক্তি হাতে পাওয়া জরুরি ছিলো।

আরেকটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে- এর আগে কয়েক দফায় তুরস্কের মার্কিন ঘাঁটি থেকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেয় ওয়াশিংটন। ২০১৫ সালে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় মোতায়েনকৃত কয়েকটি প্যাট্রিয়ট প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তীতে ইনসিরলিক বিমান ঘাঁটির প্যাট্রিয়ট ব্যটারিগুলোও সরিয়ে নেয়া হয়। এর ফলে তুরস্কের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে বড় ধরনের গ্যাপ তৈরি হয়। এর সুযোগ নিয়েই ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে সিরিয়ার ভূখন্ড থেকে ১২৭টি রকেট, কামান ও মর্টার ছোড়া হয় তুরস্কের অভ্যন্তরে। এতে ৭ তুর্কি নাগরিক নিহত ও ১২৫ জন আহত হয়। তুরস্কের জন্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনা কেন জরুরী ছিল- সেটি যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই হামলা।

তুরস্কের ভৌগলিক অবস্থান এমন একটি জায়গায় যার আশপাশে কয়েকটি দেশ এখন যুদ্ধক্ষেত্র। যেটি তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে যে কোন সময়। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই তুরস্কের সমর বিশেষজ্ঞ ও নীতি নির্ধারকরা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার জন্য মরিয়া চেষ্টা করেন । কিন্তু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বনিবনা না হওয়ায় বাধ্য হয়েই তারা দারস্থ হন রাশিয়ার।

মস্কো তুরস্কের সব শর্ত মেনেই এস-ফোর হান্ড্রেড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করতে রাজি হয়। এছাড়া প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র শুধু আত্মরক্ষামূলক হলেও এস-ফোর হান্ড্রেড দিয়ে শত্রুর হামলা ঠেকানোর পাশাপাশি হামলা চালানোও যায়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তুরস্ক এ বিষয়ে চ‚ড়ান্ত চুক্তি করে মস্কোর সাথে। অগ্রিম মূল্য পরিশোধও করে সর্বাধূনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম পাওয়ার জন্য।

এরপরই শুরু হয় পশ্চিমাদের সাথে তুরস্কের ইদুর বিড়াল খেলা। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখা যায় ন্যাটোর কর্মকর্তাদের মাঝেও। ন্যাটোর গণমাধ্যম কর্মকর্তা দায়লান হোয়াইট তুর্কি গণমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডের কাছে এই ইস্যুতে ন্যাটোর অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ মনে করেন ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর নিজস্ব প্রতিরক্ষা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে। তিনি এমনও বলেছেন যে, নিজস্ব প্রতিরক্ষা সমস্যার সমাধানে তুরস্ক নিশ্চয়ই বালুতে মাথাগুজে থাকবে না; কিন্তু মুখে এসব বললেও যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের সময় চুপ করেই থাকছে তারা।

তুর্কি বিশ্লেষক হাসান ইমরান মনে করেন , তুরস্কের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ চেক রিপাবলিক, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া কিংবা স্লোভাকিয়ার মতো নতুন ন্যাটো সদস্যদের ঝুঁকিতে ফেলবে। বিশেষ করে যারা রাশিয়ার সমরাস্ত্র ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ন্যাটো জোটের পরিবেশকেও ক্ষতিগ্রস্থ করছে বলে মনে করেন তিনি।

ন্যাটোর আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র গ্রিসও রাশিয়ার তৈরি এস-থ্রি হান্ড্রেড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি তারা যুক্তরাষ্ট্রের মাঝারি পাল্লার প্যাট্রিয়ট মিসাইলও ব্যবহার করছে; কিন্ত এর কোনটিতেই ক্ষুব্ধ হওয়া তো দূরের কথা, আপত্তিও নেই যুক্তরাষ্ট্রের। যে কারণেই প্রশ্ন আসে যে, তুরস্কের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নিষেধাজ্ঞার পেছনে কি অন্য কোন কারণ আছে?

তা বুঝতে আমাদের তাকাতে হবে পেছনের দিকে। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশের ন্যাশনাল ডিফেন্স অথরাইজেশন অ্যাক্টে স্বাক্ষর করলে সেটি আইনে পরিণত হয়। এই আইনের মাধ্যমেই তুরস্কের কাছে ১০০ এফ-থার্টিফাইভ স্টেলথ ফাইটার জেট সরবরাহের বিষয়টি পিছিয়ে দেয়া হয়।

কাগজে কলমে পিছিয়ে দেয়া বলা হলেও তখনই আসলে তুরস্ককে এফ-থার্টিফাইভ প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া হয়্। এফ-থার্টিফাইভ খুবই ব্যয় বহুল একটি প্রকল্প। এর প্রতিটি ফাইটারের নির্মাণ খরচ ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি মার্কিন ডলার। এত বিশাল প্রকল্পের খরচ যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়, যে কারণে ৩৫ দেশের যৌথ বিনিয়োগে শুরু হয় প্রকল্পটি। যার মধ্যে ছিলো তুরস্কও।

তুরস্কের ওপর এবারের নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে হয়তো ভবিষ্যতের এস-ফোর হান্ড্রেড কেনার কথাই বলা হবে। তবে গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে তুরস্কে গৃহবন্দী হয়ে বিচারের অপেক্ষায় থাকা আমেরিকান ধর্ম জাযক এন্ড্রু বার্নসনের মুক্তির জন্য তুরস্কের ওপর আরো আগেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিযেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ওই যাজককে মুক্তি দিয়েছে তুরস্ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইভানজেলিক খ্রিস্টানদের বিশাল ভোট ব্যাঙ্কের দিকে নজর রেখেই বার্নসনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া ওয়াশিংটন।

তুরস্কে গুপ্তচরবৃত্তি ও সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে বিচারের অপেক্ষায় থাকা বার্নসনের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ইস্যুর তালিকায় স্থান পায় প্রায় দেড় বছর পর । ওয়াশিংটন ভিত্তিক ব্রæকিংস ইনস্টিটিউটশনের বিশ্লেষক কেমাল কিরিসকি বলেছেন, মার্কিন কংগ্রেস ও তাদের প্রশাসন ইভানজেলিক ভোট ব্যাংকের বিষয়ে সব সময় স্পর্শকাতর। ট্রাম্পের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজ ব্যক্তি ইভানজেলিক খ্রিস্টান। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক সিআইএ প্রধান মাইক পম্পেও, আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন দূত স্যাম ব্রাউনব্যাক ইভানজেলিক খ্রিস্টান।

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো আমান্ডা স্নোয়াট মনে করেন, ইভানজেলিকদের সমর্থন অক্ষুন্ন রাখতেই ট্রাম্পের রিপাবলিকান প্রশাসন এ বিষয়ে কঠোর ছিল। তিনি বলেন,বার্নসনের বিষয়টিতে রিপালিকানদের মধ্যে থাকা ইভানজেলিকরা সোচ্চার ছিলো- কারণ একটি মুসলিম দেশে বন্দীছিলো একজন খ্রিস্টান যাজক। দেখে মনে হয়েছে, মাইক পেন্স বিষয়টিকে শুরু থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন।

অতীতে রিপাকলিকানদের বিজয়ে ইভানজেলিকদের ভোট ব্যাংকের বড় ভূমিকা ছিলো। প্রথমবার তুরস্ককে এফ থার্টিফাইভ ফাইটার সরবরাহ পিছিয়ে দেয়া এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স অথরাইজেশন অ্যাক্ট পাস করা- দুটি ঘটনার নেপথ্যেই ছিলো ইভানজেলিক খ্রিস্টানদের মনজয় করার চেষ্টা। তুরস্কের ওপর এবারের অবরোধ আরোপ নিয়ে খুব সক্রিয় ছিলেন সিনেটর ক্রিস ভ্যান, মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বরাবরই স্বোচ্চার তিনি। খ্রিস্টানদের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত ইন ডিফেন্স অব ক্রিশ্চিয়ান্স সংগঠনেরও সমর্থক এই নেতা।

সম্প্রতি আরেক সিনেটর জেমস ল্যাঙ্কফোর্ডের সাথে যৌথভাবে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি চিঠি লিখে তুরস্ককে এফ-থার্টিফাইভ প্রকল্প থেকে পুরোপুরি বাদ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। সিনেটর হওয়ার আগে জেমস ল্যাঙ্কফোর্ডও ওকলাহোমায় কাজ করেছেন ইভানজেলিকদের হয়ে। তাই যাজক এন্ড্রু বার্নসনকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে তুরস্কে বিচারের মুখোমুখী করার সাথে এবারের অবরোধের সম্পর্ক থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে