অস্ত্র কেনা নিয়ে বেকায়দায় আরব আমিরাত, সিপিইসি নিয়ে জটিলতায় ইমরান

পাকিস্তান এ প্রকল্প এবং এর সফলতা নিয়ে খুবই আশাবাদি - দ্যা ইকোনোমিক টাইমস

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:১২

আরব আমিরাতের কাছে ২৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি বন্ধে তিনজন মার্কিন সিনেটর নতুন প্রস্তাব আনার ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান, ড্রোন এবং অন্যন্য সমরাস্ত্র বিক্রি করতে এই চুক্তি করেছিলো। সংযুক্ত আরব আমীরাত ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ায় এবং ইসরাইলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পুরস্কার হিসেবে ট্রাম্প এ পুরস্কারটি আমীরাতকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি এখন বদলে যেতে শুরু করেছে।

ইসরাইল কখনোই চায় না যে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশ আধুনিক বিমান বা যুদ্ধাস্ত্রে এগিয়ে যাক, কিন্তু তারাও আমীরাতের স্বীকৃতি পাওয়ার লোভে এটুকু ছাড় দিতে রাজি হয়েছিল।

ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর বব মেনেন্দেজ, ক্রীস মারফি এবং রিপাবলিক্যান সিনেটর র‌্যান্ড পল- এ তিন সিনেটর একাট্টা হয়ে মোট ৪টি আলাদা আলাদা প্রস্তাব নিয়ে আসবেন যাতে আমীরাতের কাছে ট্রাম্পের রিপার ড্রোন, এফ-থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান, এয়ার টু এয়ার মিসাইল এবং অন্যন্য সমরাস্ত্র বিক্রির পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেয়া যায়। এর মধ্যে ক্রীস মারফি একটি বিবৃতিতে বলেন, এর আগের বার দুদেশের মধ্যে যে অস্ত্র বিক্রির ঘটনা ঘটেছিল তখন আমীরাত চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে ইসরাইলের সাথে আমীরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখি। তবে, কোনো সমঝোতা বা কুটনৈতিক সম্পর্কের বিনিময়ে অস্ত্রের চালান সরবরাহ করা কিংবা নতুন করে অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়াকে সমর্থন করি না।

ট্রাম্প প্রশাসন আমীরাতের কাছে অস্ত্র বিক্রি নিয়ে তাড়াহুড়ো করায় কংগ্রেস সদস্যরা সমালোচনাও করছেন। তারা আশংকা করছেন, আমীরাতের কাছে উন্নত এসব অস্ত্র গেলে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে যেতে পারে। তারা এমন আশংকা করছেন যে, সংযুক্ত আরব আমীরাতের কাছে আধুনিক অস্ত্র বিক্রি করলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে করা ইসরাইলের একটি চুক্তিও লংঘিত হবে। বহু বছর আগেই ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি করেছে , যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের এমন কোনো দেশের কাছে এ জাতীয় কোনো অস্ত্র বিক্রি করতে পারবে না- যাতে সংশ্লিষ্ট দেশটি ইসরাইলের চেয়ে সামরিকভাবে অগ্রসর হয়ে যায়।

মার্কিন সিনেটররা আরো আশংকা করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে অস্ত্রগুলো কেনা হচ্ছে তা দিয়ে হয়তো ইয়েমেনের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নতুন করে হামলা চালানো হবে। ইয়েমেনের জাতিগত সহিংসতাকে এ শতকের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে।

ক্রীস মারফি তার বিবৃতিতে বলেন, আমীরাত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপ‚র্ণ একটি নিরাপত্তা অংশীদার। তবে, তাদের সা¤প্রতিক কার্যক্রম দেখে ধারণা করা যায়, তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করেও এ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করতে পারে। আমীরাত এর আগেও মার্কিনীদের সাথে সাক্ষরিত চুক্তি অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রæপের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে। লিবিয়া ও ইয়েমেনের ক্ষেত্রেও তারা আন্তর্জাতিক আইন মানেনি।

মানবাধিকার সংস্থা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানিয়েছে যাতে তারা এমন কারো কাছে অস্ত্র সরবরাহ না করে যেগুলো সংঘাত ও সহিংসতায় ব্যবহৃত হতে পারে।

আমীরাতের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করলে ইয়েমেনের ঝুঁকির মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। যদিও এসব আপত্তিকে অগ্রাহ্য করেই ট্রাম্প প্রশাসন কংগ্রেসকে আমীরাতের কাছে অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী সংযুক্ত আরব আমীরাতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এ চুক্তির আওতায় আছে ৫০টি এফ-থার্টি ফাইভ স্টেলথ যুদ্ধবিমান, ১৮টি এমকিউ-নাইন রিপার ড্রোনস এবং ১০ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র, যার মধ্যে রয়েছে বিপুল পরিমান এম- এইটি টু ডাম্ব বোমা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন সিনেটরদের এসব তৎপরতার কারণে অস্ত্র বিক্রির এ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। তবে গোটা প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এবার নজর দেয়া যাক উপমহাদেশের দিকে। পাকিস্তানের সাথে সিপিইসি করিডোর স্থাপনে চীনের দ্বিধা বাড়ছে। পাকিস্তানের সাথে এ করিডোর স্থাপনে ৬২ বিলিয়ন ডলারের একটি উচ্চাকাংখী চুক্তি কার্যকর রয়েছে। তবে, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে অস্থিরতা, ব্যাপক দুর্নীতি এবং করোনা মহামারির কারণে অনেকগুলো প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় চীন বর্তমানে সংশয়ে পড়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

যেসব এলাকার মধ্য দিয়ে এ করিডোরটি যাবে তার মধ্যে একটি হলো বেলুচিস্তান। এরই মধ্যে বেলুচিস্তানে কয়েকবার উগ্রপন্থী কয়েকটি সংস্থার কর্মীরা প্রকল্প এলাকায় হামলা চালিয়েছে। এ সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন থেকেই এই প্রদেশে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে। বালুচ গোষ্ঠীগুলো দাবি করছে যে, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তান প্রদেশ চীনের "সম্প্রসারণমুখী" এবং নিপীড়ক" নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাদের মতে সিপিইসির মতো প্রকল্পগুলো হাতে নেয়া হয় তাদেরকে দমিয়ে রাখার জন্য।

অতীত হামলার অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, বালুচিস্তানের এসব উগ্রবাদী সংগঠনগুলো সে স্থানগুলোকেই আক্রমনের জন্য বেছে নেয়, যেগুলো চীনের স্বার্থে খুবই প্রয়োজনীয়। এর আগে গোয়াদার বন্দরে হামলা করা হয়েছিল। এর আগে পাকিস্তানের স্টক এক্সচেঞ্জেও তারাই হামলা চালিয়েছিল। পাকিস্তান একটি চীনা কনসোর্টিয়ামের কাছে স্টকের ৪০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করায় স্টক এক্সচেঞ্জের ওপর তাদের এ আক্রোশ তৈরি হয়। এরপর থেকেই চীনের চলমান প্রকল্প এলাকায় এবং পাকিস্তানে কর্মরত চীনা কর্মকর্তাদের ওপর পাকিস্তানি প্রশাসন নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেয়।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এসব হামলার ঘটনা বেইজিং ও ইসলামাবাদকে সিপিইসি করিডোরের ভবিষ্যতের বিষয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তবে পাকিস্তান এ প্রকল্প এবং এর সফলতা নিয়ে খুবই আশাবাদি। এরই মধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সিপিইসি করিডোরের ওপর ভিত্তি করে এ অঞ্চলে একটি মেগা প্রকল্প চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন। পাকিস্তান সিপিইসি প্রকল্পের প্রথম অংশটি বাস্তবায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ সুবিধা চেয়েছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার আরেকটি কারন হচ্ছে ইসলামাবাদ এক শতাংশ সুদের হারের শর্তে যে ঋন চেয়েছে। এখনো পর্যন্ত কোনো চীনা ব্যাংক সে বিষয়ে সম্মত হয়নি। চীনা সরকার পাকিস্তানকে জানিয়েছে যদি তারা ঋণ প্রদানও করে তাহলেও সুদের হার এক শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি হবে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বেইজিং একটু ধীর গতিতে এগুচ্ছে কারণ তারা দেরিতে হলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায়। একবার চুক্তি করার পর তারা সেখান থেকে পিছিয়ে আসতে চায় না।

ইমরান খান রাজনৈতিকভাবেও একটু চাপে পড়ে গেছেন। তার দেশের ১১টি বিরোধী দল একত্রিত হয়ে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম নামে একটি জোট গঠন করেছে। বিরোধী এসব দলগুলো ইমরান খানকে সেনাবাহিনীর পুতুল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং সেইসাথে তারা চীনের বিশাল বিনিয়োগকে যথাযথভাবে কাজে না লাগানোর ব্যর্থতার জন্যেও ইমরানকে দায়ী করেছে।

পিডিএম এরই মধ্যে সিপিইসি প্রকল্পের বর্তমান চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল আসীম সালিম বাজওয়াকে সরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। বাজওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, তিনি অফশোর একাউন্টে বড়ো ধরনের সম্পদ গড়ে তুলেছেন।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সিপিইসি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে চেয়ারপার্সনকে আইনী জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ায় তার ইমেজ সংকটের মুখে পড়ছে এবং তিনিও বিতর্কিতভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করার সুযোগ পাচ্ছেন।

এভাবে পাকিস্তানের ভেতর থেকে সিপিইসি নিয়ে অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন। পশ্চিমা আরো কিছু দেশও পাকিস্তানের চীন নির্ভরতা এবং চীনের অর্থায়নে এ প্রকল্প নিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে সরব হলেও পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোও সিপিইসি প্রকল্পের ক্ষতি চায় না। চীন এ বিনিয়োগ প্রকল্প থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিক তাও তারা চায় না। আপাতত ধীরে হলেও বিশ্লেকরা আশা করছেন, করোনার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই চীন পুরোদমে সিপিইসি প্রকল্প বাস্তবায়নে নেমে পড়বে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে