কতটা ইসরাইল-প্রীতি দেখাবেন বাইডেন

কার্টুনটি এঁকেছেন কার্লুস ল্যাটুফ - মনডোওয়েইস

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:২৯

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নজিরবিহীন দহরম-মহরম গড়ে তুলেছিলেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিনি যা চেয়েছেন ট্রাম্প তাকে তাই দিয়েছেন। এটাই ছিল নেতানিয়াহুর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পুঁজি। কিন্তু জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরও পরিস্থিতি কী একইরকম থাকবে, নাকি বদলে যাবে? অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বাইডেনের নীতি হবে অনেকটাই আলাদা।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরাজয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন ইসরাইলের দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। বাইডেনের বিজয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতির অগ্রাধিকার তালিকা থেকে রাতারাতি কার্যকরভাবেই ইসরাইলের অবনমন ঘটেছে। এতে দুই ধরনের বিপদে পড়েছেন নেতানিয়াহু। প্রথমত বিশ্বমঞ্চে তার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, তিনি ইসরাইলের অপরিহার্য নেতা বলে জনগণের কাছে যে যুক্তি তুলে ধরতেন তাও আর টিকবে না। নেতানিয়াহু তার জনগণকে বলতেন, ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রধান রক্ষাকারী আমেরিকার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দাবি পূরণ করতে হলে তার বিকল্প নেই।

গত চার বছর ট্রাম্প ইসরাইলকে একের পর এক কূটনৈতিক সুবিধা দিয়ে এসেছেন। নেতানিয়াহুর ভূরাজনৈতিক খেলায়ও সমর্থন দিয়েছেন তিনি। ইসরাইলি ভোটাররা এতে নেতানিয়াহুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তবে ট্রাম্পের পাশাপাশি নেতানিয়াহুর সুদিনও বুঝি শেষ হয়ে এলো।

ইসরাইলি নেতার জনসমর্থন কমছে। করোনাভাইরাসের তৃতীয় তরঙ্গ নিয়ে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে তাকে। দুর্নীতির অভিযোগে আগামী বছরের শুরুতেই তার বিচার শুরু হবে। নেতানিয়াহুর বিরোধীরা যেমন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তেমনি তার মিত্ররাও এখন তাকে বিদায় করার সুযোগ খুঁজছেন।

বাইডেনের বিজয় নেতানিয়াহুর জন্য ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। নির্বাচনে বাইডেনের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পরও তাকে অভিনন্দন জানাতে ১২ ঘণ্টা সময় নেন নেতানিয়াহু। টুইটারে তাকে অভিনন্দন জানালেও তা ছিল দৃষ্টিকটু রকমের দায়সারা গোছের। বাইডেনকে অভিনন্দন জানানোর পরপরই ট্রাম্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন নেতানিয়াহু। ইসরাইলের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকমহলে জল্পনা রয়েছে যে নেতানিয়াহু বাইডেনের বেশি প্রশংসা করলে তাতে ট্রাম্প নাখোশ হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারেন।

নেতানিয়াহু ও তার মিত্রদের সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ইসরাইলি বিশ্লেষক শিমরিত মেয়ার মনে করেন, বাইডেনের জয়কে কার্যত অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন নেতানিয়াহু। কারণ বাইডেনের বিজয়ে তার ওপর বিরক্ত ইসরাইলিরা বড় ধরনের স্বস্তি পেয়েছে। কাজেই তার বিজয়কে খাটো করে দেখাতে চেয়েছিলেন । অবশ্য বাইডেনের বিজয়ের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না নেতানিয়াহু ও তার মিত্ররা। ভোটের কিছুদিন আগেও মন্ত্রিসভায় দীর্ঘ আলোচনা শেষে উপসংহারে পৌছানো হয় যে, ট্রাম্পের পরাজয়ের কোনো সম্ভাবনাই নাই। বাইডেনের বিজয়ের পূর্বাভাস দেওয়া বিশ্লেষকদের ইডিয়ট বলেও মন্তব্য করা হয় নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই ইসরাইল পরিবর্তনটা টের পাবে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘাতে একতরফা সমর্থন পাবে না ইসরাইল। তবে সবচেয়ে বড়কথা হলো ইসরাইল নিয়ে আসলে খুব একটা মাথা ঘামানোর সময়ই পাবেন না বাইডেন। করোনা মহামারি সামাল দেওয়া এবং বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তাকে ব্যস্ত থাকতে হবে।

আমেরিকার সমাজের গভীর বিভাজন দূর করার জন্যও তাকে প্রচুর শ্রম দিতে হবে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাইডেনের অগ্রাধিকার হবে চীন ও রাশিয়া, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং ট্রান্স আটলান্টিক জোটের মধ্যে ট্রাম্পের সৃষ্ট ক্ষত সারানো।

তবে ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হবে ইরান। বাইডেন ইরানের সঙ্গে কূটনীতির পথ খোলা রাখার কথা বলেছেন। ইরান শর্ত মানলে পরমাণু চুক্তিতে ফেরার কথাও বলেছেন তিনি। নেতানিয়াহু এই চুক্তির ঘোর বিরোধী। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে সাক্ষরিত এই চুক্তিটি বাতিল করেন ট্রাম্প। এতে উল্লাসে ফেটে পড়েছিলেন নেতানিয়াহু।

ইরান ইতোমধ্যেই বলেছে যে তারা চুক্তির শর্ত মেনে চলতে চায়। এতে বিপদ দেখছে ইসরাইল। দেশটির একজন মন্ত্রী হুঙ্কার দিয়েছেন যে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে ফেরা হলো দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। ট্রাম্প ইসরাইলের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। তবে বাইডেন চান ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে কিছুটা হলেও ভারসাম্যমূলক নীতি। যদিও বাইডেনও ইসরাইলের গোড়া সমর্থক।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, মরক্কো, ওমান কিংবা সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলে বাইডেন প্রশাসন বলবে তোমরা ইসরাইলের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে দাবি আদায় করে নাও। বাইডেন মনে করেন ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে নেতানিয়াহুর আপোসমীমাংসা সম্ভব।

ট্রাম্প আন্তর্জাতিক বিরোধিতার মুখেই তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছেন। বাইডেন প্রশাসন এটা সরাবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে বাইডেন ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক মিশন পুনরায় চালুর সুযোগ দেবেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য আবার আর্থিক সহায়তা পুনরায় চালু করবেন। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষেও বাইডেন সমর্থন জানাবেন। নেতানিয়াহু এর ঘোর বিরোধী।

পশ্চিমতীরে ইহুদি বসতি স্থাপনে নেতানিয়াহুর পদক্ষেপের বিরোধিতা করবে বাইডেন প্রশাসন। বাইডেনের জয়ে ফিলিস্তিনিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও তারা খুব খুশি নন। কারণ আমেরিকার ইহুদি লবি এতোটই শক্তিধর যে সব প্রশাসনই ইসরাইলের স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে বাধ্য হয়। ফিলিস্তিনের কর্মকর্তা হানান আশরাওই বলেন, আমেরিকার নীতি সবসসময়ই ইসরাইলের পক্ষে থাকবে। আমি মনে করি না যে বাইডেন আমাদের রক্ষা করবেন।

বাইডেনও ইসরাইলের বড় পৃষ্ঠপোষক। তবে ট্রাম্প আমিরাত ও বাইরাইনের মত দেশকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে যেভাবে বাধ্য করেছেন সেটা করবেন না বাইডেন। আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট থাকলে নেতানিয়াহু বিপাকে পড়েন। বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামার সময়ও তিনি চাপে ছিলেন। তবে নেতানিয়াহু এখন নিজ দেশেও দুর্বল হয়ে পড়েছেন।

ট্রাম্পের সঙ্গে তার দৃষ্টিকটূ মাখামাখিকে বাইডেনও হয়তো ভালোভাবে নেবেন না। তিনি নেতানিয়াহুকে উচিত শিক্ষা দিতে পারেন। এমনও হতে পারে ক্ষমতায় বসার পর বাইডেন নেতানিয়াহুকে বাদ দিয়ে তার প্রতিদ্ব›দ্বী ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গ্রানৎজ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাবি আশকেনাজিকে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের জন্য হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। এতে নেতানিয়াহুকে অপমান করা হবে।

নেতানিয়াহু এর আগেও ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ওবামার সময় ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি সাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাতে তিনি ওবামার বিদেশনীতির বড় সবচেয়ে সাফল্যের তীব্র সমালোচনা করেন। তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন সেই অধিবেশনে যোগ দেননি।

ওবামার পুরোটা সময়ই নেতানিয়াহুকে ভীষণ চাপে রাখা হয়েছে। তবে তখনও হোয়াইট হাউসে ইসরাইলের বড় সমর্থক ছিলেন বাইডেন। কিন্তু সেই বাইডেনকেই ইসরাইলের নেতানিয়াহু সমর্থক গণমাধ্যমগুলো এখন বামঘেষা ডেমোক্র্যাটদের হাতে বন্দি বলে দেখানো হচ্ছে।

ডেমোক্র্যাট দলের বামঘেষা নেতারা পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপনের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে। তবে গত পাচ দশক ধরেই বাইডেন ইসরাইলপন্থী হিসেবে সুপরিচিত। এরপরও নেতানিয়াহুকে তিনি ভালোভাবে নেবেন না বলেই মনে হচ্ছে।

ইসরাইলের সাবেক মন্ত্রী এবং গবেষক নিমরড নভিক বলেছেন, বাইডেন হয়তো ধীরে ধীরে নেতানিয়াহুকে কোণঠাসা করে ফেলবেন। বাইডেন তাকে বলবেন, মাখামাখির দিন শেষ। আমি তোমার সঙ্গে লড়াই করতে চাই না। তবে আমি চাই পরিস্থিতি শান্ত করতে। তুমি আমায় সাহায্য কর। অবৈধ বসতির কথা ভুলে যাও। একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবা না। আমি তোমার সাহায্য চাই। ধসে পড়ার আগে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বাচাতে আর বিস্ফোরণের আগে গাজাকে শান্ত করতে চাই। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ইরান নিয়ে আলোচনায় তোমাকে রাখব।

অনেক ইসরাইলিও নেতানিয়াহুর আচরণে ক্ষুব্ধ। তাদেরই একজন ইউরি ইয়াকব বলেন, নেতানিয়াহু দাবি করতেন আমেরিকা তার পকেটে। সেই চাপাবাজির দিন শেষ।

আশার কথা হলো ডেমোক্র্যাট দলে এখন অনেক বামঘেষা নেতার উত্থান ঘটেছে যারা ইসরাইলকে আর ব্ল্যাঙ্ক চেক দেওয়ার পক্ষে নন। পররাষ্ট্রনীতিতে তারা এখন উচ্চকণ্ঠ। ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পেতে লড়াই করা বার্নি স্যান্ডার্স তাদের অন্যতম। এছাড়া আছেন চার নারীর জোট স্কোয়াড। ফিলিস্তিনিদের অধিকারের জন্য লড়ছেন তারাও।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে