আমেরিকার জিপিএসকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে চীনের নেভিগেশন সিস্টেম

চায়না নেভিগেশন সিস্টেম - এপি

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:০০

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্তিত নেভিগেশন সিস্টেম গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস ক্রমাগতভাবে চীনের বেইডোও স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেমের কাছে আধিপত্য হারাচ্ছে। নিকেই এশিয়ার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি মার্কিন স্যাটেলাইট রিসিভার কোম্পানি ট্রিম্বল জানিয়েছে, বিশ্বের ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ১৬৫ দেশেই জিপিএস এর তুলনায় বেইডোও স্যাটেলাইট দিয়ে বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যাচ্ছে।

চীনের ৩০টি বেইডোও স্যাটেলাইট ক্রমাগতভাবে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবাতে সিগনাল পাঠাতে পারে যা পরিমানের দিক থেকে মার্কিন জিপিএস এর তুলায় প্রায় দ্বিগুন। ইথিওপিয়ায় নেভিগেশন সিস্টেমটির নাম ডেলিভার আদ্দিস যা ইতোমধ্যেই সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই সিস্টেম ব্যবহার করে যেকোনো হোম ডেলিভারি সার্ভিস অনেক বেশি নিখুঁতভাবে তার কাস্টমারকে সনাক্ত করতে ও সেবা প্রদান করতে পারে। আর ডেলিভার আদ্দিস সেবাটি পরিচালিত হয় চীনা স্যাটেলাইট টেকনোলোজি বেইডোও এর ওপর ভিত্তি করে। চীনারা প্রাথমিকভাবে এ নেভিগেশন সিস্টেমটি বানিয়েছিল সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য।

ক্রেতার স্মার্টফোনের লোকেশনটিকে নেভিগেশন সিস্টেমের মাধ্যমে সনাক্ত করে তার কাছে চাহিদা মতো পন্য সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে লোকজন ঘর থেকে কম বের হওয়ায় ঘরে বসেই হোম ডেলিভারি সার্ভিসগুলোর সেবা নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। কিন্তু চীনের নেভিগেশন সিস্টেমের এ আধিপত্য বিশ্বজুড়ে ডাটা সংগ্রহে সক্ষমতাকে আরো একবার প্রমাণ করলো।

১৯৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের মাধ্যমে জিপিএস পদ্ধতি চালু করে। অন্যদিকে, চীন চলতি বছরের জুন মাসে বেইডোও স্যাটেলাইটের কার্যক্রম সম্পন্ন করে। তবে তারা এ বিষয়ে কাজ শুরু করে ১৯৮০ সাল থেকে। বেইজিং এর উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি নেভিগেশন সিস্টেম তৈরি করা যা আরো বেশি নিখুঁত সার্ভিস দেবে কিন্তু ব্যয়ের দিক থেকেও সাশ্রয়ী হবে।

জিপিএস এর আবিস্কার হয়েছিল সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে মিসাইলের গতিপথ নির্ণয় এবং সেনাদের অবস্থান সনাক্ত করতে এরকম একটি নেভিগেশনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বেইজিং অতি সম্প্রতি যে স্যাটেলাইট সিস্টেমটি চালু করেছে তার ফলে নিজস্ব সামরিক সক্ষমতাই শুধু বৃদ্ধি পায়নি বরং সাইবার স্পেসকে মার্কিনীদের একচেটিয়া আধিপত্যকেও চীনের এ প্রযুক্তি রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

চীন স্বয়ংসম্পুর্ন এবং স্বনির্ভর গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম বা জিএনএসএস এর প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভব করে তাইওয়ান প্রনালী নিয়ে তৃতীয় দফা সংকটের সময়। সে সময় তাইওয়ান স্বাধীনতা অর্জন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা শুরু করলে তাদেরকে হুমকি দেয়ার জন্য চীন তাইওয়ান লক্ষ্য করে তিনটি মিসাইল নিক্ষেপ করে। কিন্তু ভালো নেভিগেশন না থাকায় চীনের এ মিসাইল গুলো লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত যেতেই পারেনি। চীনের ছোড়া প্রথম মিসাইলটি তাইওয়ানের কিলুং সামরিক ঘাটি থেকে ১৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে থাকতেই বিধ্বস্ত হয়। আর বাকি দুটো মিসাইল ছোড়ার পর এক রকম নিখোঁজই হয়ে যায়।

চীন দাবি করছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জিপিএস সিগনালকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। যাতে চীন তাদের প্রয়োজনে মিসাইল ছোড়ার সময় কোনো সুবিধা না পায় এবং লক্ষ্যবস্তু পর্যন্ত মিসাইলগুলো যেন যেতে না পারে। এরপর থেকে চীন ১৯৯৬ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে বেইডোও আবিস্কারের জন্য কাজ শুরু করে।
তথ্য ও ডাটা পাওয়ার জন্য পরাশক্তি দেশগুলোর এই লড়াই তা শুধু পৃথিবীর চারপাশের কক্ষপথকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এমন নয়। এ লড়াই সাগরের ওপরে এমনকী সাগরের তলদেশেও বিস্তৃত হয়। চীনের শিল্প ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে ইনফরমেশন সিল্ক রোড, বেইডোও এবং ফাইভ জি নেটওয়ার্ক অনেকগুলো দেশের কাছে বিক্রি করেছে। চীনের এ প্রযুক্তিগুলো বিশ্ববাসীর সামনে একচেটিয়া মার্কিন প্রযুক্তির শক্তিশালী বিকল্প হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে।

চীনের তথ্য ও ডাটার কাঠামোগুলোর কেবল চলে গেছে সাগরের নীচ দিয়ে। আর সাগরের নীচের কেবল সম্প্রসারণে চীনই এখন পর্যন্ত সেরা। নিকেই এশিয়ার একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা চীনের ৩৪টি সরকারী জাহাজ মেরিন ট্রাফিক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে দেখেছে। স্বয়ংক্রিয় সনাক্তকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে নৌযানগুলোর গতিপথকে সনাক্ত করা যায়।

চীনা সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিয়াং ইয়াং হং জিরো ওয়ান হঠাৎ করেই গুয়ামের উত্তর পূর্ব উপকূলে গিয়েছিলো। সেখানে মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি ঘাটি আছে। কিন্তু চীনের এ জাহাজকে সনাক্ত করতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, চীন তার গবেষণা জাহাজকে এ অঞ্চলে গোপনে পাঠিয়েছিল যাতে সামরিক তথ্য পেতে পারে। বিশেষ করে, ভবিষ্যতে যে সাবমেরিনগুলোর ব্যবহার চীন শুরু করতে যাচ্ছে তাদের গতিপথ নির্ধারণ করাও এর উদ্দেশ্য হতে পারে। জিয়াং ইয়াং হং জিরো ওয়ান নামক জাহাজটি শুধু গুয়ামেই নয় বরং নর্থান মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জেও বেশ কয়েকদিন যাতায়াত করেছে বলে জানা গেছে।
চীন লাদাখ সীমান্তে এমন কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কৌশল নিয়েছে যা ভবিষ্যতে সেখানে ভারতের কার্যক্রমকে ব্যহত করতে পারে। ভারত করোনায় সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ একটি দেশ। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতেই নয়, ভারতের অর্থনীতি এখন চরম গতিতে মন্দার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এরই মধ্যে চীনের সাথে সীমান্ত নিয়েও ভারতের মাঝে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা বাড়ছে।

গত জুনে পূর্ব লাদাখে ভারতীয় ও চীনা সেনারা বড়ো আকারে সংঘাতে লিপ্ত হন যাতে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয় এবং আরো বেশ কয়েকজন আহত হয়। চীনা সেনাবাহিনীতেও বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

জুন মাসের এ সংঘর্ষের পর থেকে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা ও টানাপোড়েন বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝেই এক পক্ষ অপর পক্ষকে যেন তাদের সমর সক্ষমতার জানান দেয়ার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে দুটো দেশই লাইন অব এ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসিতে বড়ো আকারের সেনা জমায়েত করে এবং ভারী সমরাস্ত্রও মোতায়েন করে।

সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের সাথে চীন এখন ঠিক সে কৌশলটাই অবলম্বন করেছে যা স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিল। চীন চাইছে, ভারত তার বিরুদ্ধে নিজেদেরকে সংহত করার অভিপ্রায় থেকে আরো দামী দামী অস্ত্র ক্রয় করুক এবং সামরিক খাতেও বাজেট বৃদ্ধি করুক। তাহলে ভারতের বিদ্যমান ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি আরো বেশি চাপের মুখে পড়ে যাবে।

ভারত ও চীনের সেনা কর্মকর্তারা লাদাখ সীমান্ত নিয়ে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকদফা আলোচনায় বসেছেন। তবে সীমান্ত নিয়ে তারা কোনো সমঝোতায় আসতে পারেনি। অন্যদিকে, পরিস্থিতিকে সামাল দিতে নয়াদিল্লী এরই মাঝে ইসরাইল, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যয়বহুল অস্ত্র কেনার অর্ডার দিয়ে রেখেছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রোলিয়া একজোট হয়ে সম্প্রতি ভারত মহাসাগরে একটি যৌথ মহড়া চালিয়েছে। এ ঘটনায় বেইজিং যথেষ্ট কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। একই সাথে চীনের সাথে টানাপোড়েন ছিল এমন অনেক দেশের সাথেই বেইজিং নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে।

ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বেসিক এক্সচেঞ্জ এন্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট বা বেকা কার্যকর হতে শুরু করেছে। এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে ভারত আমেরিকার অনেক প্রযুক্তিই ব্যবহার করার সুযোগ পাবে- যার মধ্যে আছে ভূস্থানিক ইন্টেলিজেন্স যা ব্যবহার করে শত্রু অবস্থানকে নিখুঁতভাবে সনাক্ত করে তার ওপর আক্রমন চালানো সম্ভব হবে। পাশাপাশি টহল ও নজরদারি কার্যক্রমও উন্নত হবে।

চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়াগুলো অবশ্য বলছে, বর্তমান মোদি সরকার ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একরকম বন্ধক দিয়েই এসব সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে। যদিও চীনের কাছে ভারতের এসব কার্যক্রম মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। চীনের ভাবনা মতোই ভারত অগ্রসর হচ্ছে। চীন চাইছে ভারত যেন তার জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করার উদ্যেগগুলো থেকে সরে আসে। দারিদ্র বিমোচনের মতো পদক্ষেপ থেকে ভারত সরকারকে সরিয়ে নিয়ে এসে চীনা প্রশাসন ভারতকে বেইজিং এর সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য উসকানি দিচ্ছে। ভারতীয় বিমান, সেনা ও পদাতিক বাহিনীতে আধুনিকায়নের নামে নয়াদিল্লী এরই মাঝে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে এবং আরো অর্থ ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে