সামরিক ড্রোন রফতানিতে শীর্ষে চলে আসছে চীন

চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল এবং বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে - ইউএএস ভিশন

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:৪৩

চীন মাত্র কয়েক বছর আগেও নানা দেশ থেকে উন্নত অস্ত্র নিজ দেশে আমদানি করতো। অথচ সময়ের ব্যবধানে চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল এবং বৃহত্তম অস্ত্র রফতানি কারক দেশে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে মনুষ্যবিহীন আকাশযান বা ইউএভির মতো সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র চীন এখন পাকিস্তানসহ আরো বেশ কিছু দেশে নিয়মিত রফতানি করছে। শুধু ইউএভি নয়, চীন এখন বিরতিহীনভাবে বিশ্বের নানা দেশে এসল্ট রাইফেল, এমুনিশন, যুদ্ধবিমান এবং সাবমেরিনও রফতানি করছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেক্সাসের এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয় চীনের ড্রোন রফতানির ওপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। ফরেন এফেয়ার্স ম্যাগাজিনে এই গবেষনার তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল অবধি মোট ১৮টি দেশ সশস্ত্র ড্রোন সংগ্রহ করেছে আর এর মধ্যে ১১টি দেশই এ ড্রোনগুলো সংগ্রহ করেছে চীন থেকে। ২০১১ সালের আগে মাত্র ৩টি দেশের কাছে উন্নতমানের ড্রেন ছিল। এ তিনটি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইসরাইল।

পরবর্তী সময়ে ড্রোনের আমদানি, রফতানি ও উন্নয়ন ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসাথে ড্রোন শিল্পে নতুন সরবরাহকারী দেশ হিসেবে চীনের আবির্ভাব ঘটেছে। ২০১১ সালের পর থেকে চীন সংযুক্ত আরব আমীরাত ও পাকিস্তানসহ বেশ কিছু দেশের সাথে ইউএভি ড্রোন বিক্রি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। এরপর থেকে ইউএভি রফতানি মার্কেটে চীনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। ২০১১ সালের মধ্যে যে ১১টি দেশ চীন থেকে ইউএভি ড্রোন কিনেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমীরাত, মিশর এবং উজবেকিস্তান।

অথচ এ সময়ে ফ্রান্স ছাড়া আর কোনো দেশেই যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদিত ড্রোন বিক্রি করতে পারেনি। তবে প্রিডেটর জাতীয় ড্রোন বিক্রির ব্যাপারে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আলাপ আলোচনা চলছে। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গবেষণাপত্রে বলা হয় চীন ড্রোন রফতানি বাজারে প্রভাব বিস্তার করার পর অগনাতান্ত্রিক সরকার দ্বারা পরিচালিত দেশগুলো বরং গনতান্ত্রিক দেশগুলোর তুলনায় ৪ গুন বেশি পরিমাণে ড্রোন সংগ্রহ করেছে।

এবার আসা যাক, তাইওয়ান প্রসঙ্গে। চীনের একজন সামরিক বিশ্লেষক দাবি করেছেন, তাইওয়ান প্রনালীতে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে কর্মকান্ড চালাচ্ছে তা যদি অব্যহত থাকে তাহলে নতুন করে এ অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশংকা আছে। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির আওতাধীন একাডেমী অব মিলিটারি সাইন্সের সেন্টার ফর চায়না-আমেরিকা ডিফেন্স রিলেশন্স এর ফেলো ঝোও বোও মনে করেন , চীন তাইওয়ানের সাথে এখুনি যুদ্ধ করতে চায় না। কারণ তাইওয়ানের জনগনকে চীন নিজেদের লোক বলেই মনে করে। আন্ত:সম্পর্কিত এই সম্পর্কের বিষয়ে চীনের মেইনল্যান্ড এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। আর সেভাবে বিষয়টির ফায়সালাও হবে না। বরং তাইপের সাথে ওয়াশিংটন ও বেইজিং এর আগামী দিনের সম্পর্কের মধ্য দিয়েই এ বিষয়টি নির্ধারিত হবে ।

সাউথ চায়না পোস্ট সম্প্রতি একটি কলাম প্রকাশ করে যা লিখেছেন সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, সিএসআইএস চায়না পাওয়ার প্রোজেক্টেও পরিচালক ও সিনিয়র উপদেষ্টা বনি গ্লেসার এবং একই প্রতিষ্ঠানের চায়না স্ট্রাডিজ বিভাগের ফ্রিম্যান চেয়ার জুডি ব্ল্যানচেটে। তবে ঝোও এ কলামের বেশ সমালোচনা করেন। উক্ত কলামে গ্লেসার ও ব্ল্যানচেটে দাবি করেন যে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সংঘাত চলছে তা কখনোই যুদ্ধে রূপ নেবে না কারণ ট্রাম্প বা শি জিন পিং-কোনো সরকারই এ মুহুর্তে সামরিক কোনো পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছে না। তারা বলেন, চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাত তখুনি অনিবার্য হয়ে যাবে যদি চীন তাইওয়ানে আক্রমন করে। তবে তেমনটি করলে শি জিন পিং এর অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে এবং তিনি দেশকে এগিয়ে নিতে যে সব পরিকল্পনা নিয়েছেন তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অন্যদিকে, ঝোও বলেন, তাইওয়ানে হামলার বিষয়ে বেইজিং হয়তো অনেক পরেই চিন্তাভাবনা করবে। তবে তারও আগে ওয়াশিংটনের কার্যক্রমের পরিণতিতেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠার চেষ্টা করছে তবে বাস্তবতা হলো তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন তার পূর্বসরী মা ইং জিউ এর তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন মানসিকতার আর বর্তমান প্রেসিডেন্ট চীনের সাথে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনেও আন্তরিক।

উল্লেখ্য, বেইজিং সবসময়ই তাইওয়ানকে তারই একটি খন্ডিত অংশ হিসেবে গণ্য করে এবং তারা মনে করে তাইওয়ানকে অবশ্যই চীনের মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত হতে হবে। এমনকী তার জন্য জোর প্রয়োগ করতেও বেইজিং এর নীতিগত অবস্থান রয়েছে। চীন ২০০৫ সালে একটি বিচ্ছেদ-বিরোধী চুক্তি অনুমোদন করে যাতে বলা হয়েছে যে, তাইওয়ান যদি কখনো স্বাধীনতা ঘোষণা করে তাহলে চীন তাইওয়ানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টানাপোড়েন চলতি বছর অনেকটাই বেড়েছে। বেইজিং তাইওয়ানের আশপাশের এলাকায় তার সামরিক মহড়া ও অন্যন্য তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। তাইওয়ানের সমুদ্র উপকূলে মার্কিন নৌ যান প্রেরণ এবং মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘন ঘন তাইওয়ান সফরেরও তীব্র সমালোচনা করেছে চীন। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সাউথ চায়না সিতে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েছে। এ সমুদ্রে চীনের আধিপত্য অবশ্য অনেকটাই বেশি। গত জুলাই মাসে এ বিতর্কিত সমুদ্রসীমায় যুক্তরাষ্ট্র দুটো ক্যারিয়ার পাঠিয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় আগস্ট মাসেই চীন আবার এ এলাকায় দুটো মিসাইলের সফল পরীক্ষন চালায়। মূলত এ মিসাইল নিক্ষেপের মাধ্যমে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে এক ধরনের সতর্কবার্তা জানিয়ে দিয়েছে।

গেলো অক্টোবরে দুই দেশ একটি জরুরি আলোচনায় অংশ নেয়। কারণ তখন ধারণা করা হয়েছিল যে, দক্ষিন চীন সমুদ্র এলাকায় চীনের আধিপত্যকে ধ্বংস করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র হয়তো যেকোনো সময় হামলাও করে বসতে পারে। গ্লেসার ও ব্ল্যানচেটে তাদের কলামে দাবি করেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরও সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করবেন- এমনটা কল্পনাও করা যায় না। এখন যদি তিনি এ জাতীয় কোনো সিদ্ধান্ত নিতেও চান তাহলেও তার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ এবং জয়েন্ট চীফ অব স্টাফরাই হয়তো তাতে সমর্থন দেবেন না। তারা আরো বলেন, বাইডেনের নতুন প্রশাসন ক্ষমতায় বসে সম্ভবত বেইজিং এর সাথে নতুন করে আলোচনায় বসবে এবং দু দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝেও হয়তো আবার যোগাযোগ স্থাপিত হবে।

এ দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে ঝোও বলেন, এটা ঠিক যে, সাউথ চায়না সিকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন বা বেইজিং কেউই এখুনি যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তবে এ এলাকায় দুর্ঘটনাঘটিত সংঘাতের ঝুঁকি সবসময়ই রয়েই যায়। যুদ্ধ দু দেশই এড়াতে চায়। তবে একটি যুদ্ধমুক্ত পরিবেশ তখুনি তৈরি করা যাবে যখন দুদেশ একইসাথে আন্তরিকতার সাথে এ বিষয়ে চেষ্টা করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বর্তমানে ঐ এলাকায় উস্কানিম‚লক কার্যক্রম চালাচ্ছে তা যদি অব্যহত রাখে এবং সবসময়ই যদি বেইজিংকে আক্রমনাত্মকভাবে সমালোচনা করে তাহলে বেইজিং একা একা বন্ধুত্ব ধরে রাখতে পারবে না। ঝোও বলেন, ট্রাম্পের আমলে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে বৈরিতা করেছে তার প্রতিক্রিয়ায় চীনের সামরিক তৎপরতা না বাড়িয়ে কোনো উপায় ছিল না। গত চার বছরে মার্কিন ও চীনা প্রশাসন এবং দু দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ক অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সাউথ চায়না সিতে একটি বিতর্কিত সমুদ্র এলাকাকে ফিলিপাইন নিজেদের বলে দাবি করে। চীনও উক্ত এলাকাকে নিজের বলে দাবি করেছে। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল চীনের এ দাবিকে খারিজ করে দেয়। এ প্রেক্ষিতে ঝোও আরো মনে করেন জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিলেও এ টানাপোড়েন অব্যহত থাকবে। কারণ বাইডেন এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের সেই রায় মেনে চলার ইংগিত দিয়েছেন। চীন তার দেশের একটি আভ্যন্তরিন বিষয়ে দ‚রবর্তী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এ নাক গলানোকে কখনোই ভালোভাবে নিবে না। কারণ চীন মনে করে সাউথ চায়না সমুদ্র নিয়ে যদি কোনো বিতর্ক থেকেই থাকে তা দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো মিলে আলাপ আলোচনা করে ঠিক করে নিলেই বেশি ভালো হয়। এখানে যুক্তরাষ্ট্র বা বাহিরের কোনো দেশের এসে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।

চীন থেকে এবার আসা যাক ভারতীয় উপমহাদেশের চালচিত্রে। চীনের সাথে পূর্ব লাদাখে ভারতের উত্তেজনাপূর্ন সম্পর্ক চলছে বেশ কয়েক মাস ধরেই। এ অবস্থার মাঝেই অতি সম্প্রতি ভারতীয় নৌ বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার প্রত্যাশামতো নবম পি-এইট আই লম্বা সমুদ্রসীমা নির্নায়ক এবং এন্টি সাবমেরিন এয়ারক্রাফট হাতে পেয়েছে। ২০১৬ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১ বিলিয়ন ডলারের যে বিশাল চুক্তি পেয়েছিল তার অংশ হিসেবেই নতুন এ সমরাস্ত্র ভারত লাভ করলো।

ভারত এরকম ৮টি বিমানের জন্য প্রথম দফায় চুক্তি করেছিল ২০০৯ সালে। এখন আবার আরো ৬টি পিএইট আই পাওয়ার জন্য ভারত প্রশাসন মার্কিন সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ বিমানটি গোয়ার আইএনএস হানসায় অবতরণ করেছে। একই ধরনের বিমান বর্তমানে ভারত লাদাখে এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও টহলদারির কাজে ব্যবহার করছে। ২০১৭ সালে এ জাতীয় আরেকটি বিমানকে ডোকলামেও মোতায়েন করা হয়।

চীনের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে ভারতীয় নৌ বাহিনী এখন পুরোপুরি সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ভারত তার গোটা পশ্চিমা ও পূর্ব ডিভিশনের নৌ বহরগুলোকেই ভারতীয় মহাসাগরে সক্রিয় টহলদারিতে ব্যস্ত রেখেছে। সর্বশেষ যে পিএইট আই যুদ্ধবিমানটি ভারত পেলো তা গত জুলাইতেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কাছে আসতে কিছুটা বিলম্ব হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভারত একই ধরনের আরো ৩টি বিমান পাবে যা ২০২১ সালের মধ্যে ভারতে চলে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে