ডেমোক্র্যাটরাই যুদ্ধবাজ; সৌদি কি চীনা বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে

আমেরিকা যেসব বড়ো বড়ো সামরিক অভিযান চালিয়েছে বা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তার অধিকাংশই হয়েছে ডেমোক্র্যাট আমলে - ইন্টারনেট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:১৬

যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রাটরা তুলনামূলকভাবে শান্তির কথা বললেও আজ অবধি আমেরিকা যেসব বড়ো বড়ো সামরিক অভিযান চালিয়েছে বা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তার অধিকাংশই হয়েছে ডেমোক্র্যাট আমলে। রিপাবলিকানরা অনেক বেশি আগ্রাসী বক্তব্য রাখলেও তাদের শাসনামলে বরং এরকম ঘটার প্রবণতা কম। বিগত ১শ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর সত্যতা পাওয়া যায়।

ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টরা নির্বাচনের সময় বরাবরই আভ্যন্তরীন ইস্যুগুলোকে নিয়ে কথা বলেন। জনগণকে নৈতিকভাবেও আশাবাদি করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধেই বেশি পারদর্শিতা দেখান। ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট উইড্রো উইলসনের সময়ই আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

উইলসনকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতেও সামরিক অভিযান চালানোর জন্য দায়ী করা হয়। উইলসন তার আমলে হাইতি, নিকারাগুয়া, ডমিনিকান রিপাবলিক এবং মেক্সিকোতেও সৈন্য প্রেরণ করেন। তিনি এ সমর অভিযানগুলো চালিয়েছিলেন গনতন্ত্রকে সুসংহত করার নাম দিয়েই।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্টের আমলে। তিনি ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলীয়। তৎকালীন রিপাবলিকান নেতারা বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে ছিলেন। সে আপত্তিকে অগ্রাহ্য করেই রুজভেল্ট যুদ্ধে অংশ নেন। যদিও ১৯৪১ সালে জাপান পার্ল হার্বারে হামলা চালানোর কারনে রুজভেল্টের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এরপরও রুজভেল্টের সমালোচকরা কোনোভাবেই চাননি, আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধের অযুহাতে ইউরোপের দেশগুলোতে তার তৎপরতা বৃদ্ধি করুক। অথচ এসব কথাকে পাত্তা না দিয়ে রুজভেল্ট রাশিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ওপর চড়াও হন।

রুজভেল্টের পর আমেরিকার মসনদে আসেন হ্যারি ট্রুম্যান। তিনিও একজন ডেমোক্র্যাট। তার নেতৃত্বেই ১৯৫০ সালে কোরিয়ায় কম্যুনিস্ট চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। ট্রুম্যান আমেরিকার যৌথ সীমান্তে প্রতিপক্ষের কোনো রকমের টহলের তীব্র বিরোধী ছিলেন। এসব কর্মকান্ডের কারনে শুরু হয় কোল্ড ওয়ার। মার্কিন কূটনৈতিক জর্জ কেন্নানের প্রস্তাবিত "কনটেন্ট কৌশলের" পক্ষে সমর্থন এবং পরবর্তীতে ইয়ালু নদীর উপর জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থারের সুপারিশ অনুযায়ী চাপ প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণে চীনাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়েছিল।

ট্রুম্যান ডকট্রিনের একটি ঘোষণা ছিলো, বিশ্বের যেখানেই জনগন সংখ্যালঘু সশস্ত্র গ্রুপগুলোর নিপীড়নের মুখে থাকবে কিংবা বাইরের কারো চাপে জনগন যেখানেই বিপর্যস্ত হবে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র জনগনের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। এমন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বহুদেশের নানা ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়েছে, প্ররোচণা দিয়েছে।

ইতিহাসবিদদের মতে ট্রুম্যান যেভাবে বৈদেশিক নীতি ও ঘটনাবলীকে ব্যবহার করে নিজ দেশের রাজনীতিতে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছেন, এমনটা আর কোনো প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে হয়নি।

প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বেইনেস জনসন ছিলেন আরেকজন ডেমোক্রাট দলীয় প্রেসিডেন্ট যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত নেয়ার মাধ্যমে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয় বরং গোটা দুনিয়ার জন্যই একটি খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি তার দেশের যুদ্ধবিরোধী মহলকে দেশপ্রেম না দেখানোর জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। যারা যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালাতেন তাদেরকে তিনি ‘নার্ভাস নেলিস’ বলেও আখ্যায়িত করতেন। তিনি যেনতেন ভাবে শুধু সংঘাত ও সংঘর্ষকে বৃদ্ধিই করতে চেয়েছেন। অথচ নিজের এসব আগ্রাসী পরিকল্পনার বিষয়ে মার্কিন জনগনকেও রীতিমতো অন্ধকারে রেখেছিলেন।

তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিষয়ে জনগণের সাথে এতটাই লুকোচুরি খেলেছিলেন যে পরবর্তী বেশ লম্বা একটি সময়ে জনগন আর সেই অর্থে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর ভরসাই রাখতে পারেনি। জনসন পরিস্থিতিকে সামাল দিতে না পেরে উল্টো ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে বিভক্তই করে ফেলেছিলেন। ফলে ১৯৬৮ সালের যুদ্ধে তিনি আর জয়ী হতে পারেননি। শুধু তাই নয়, জনসনের এসব বেপরোয়া কার্যক্রমের কারণেই ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের রিচার্ড নিক্সন বিপুল ভোট পেয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়ার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ এবং কোল্ড ওয়ার- প্রতিটি যুদ্ধই মানব ইতিহাসে কালিমার ছাপ রেখে গেছে। আর এসব অঘটনের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রাট দলীয় প্রেসিডেন্টরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্ব এখন আরেকটি কোল্ড ওয়ারের আশংকা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এরই মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হলো, জো বাইডেনের হাত দিয়েই কী তাহলে আরেকটি কোল্ড ওয়ারের সূত্রপাত হতে যাচ্ছে?

এবার বাইডেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন এন্টনি ব্লিংকেনকে। তার বাবা মা ছিলেন ইহুদি। তার সৎ দাদা স্যামুয়েল পিাসার ছিলেন হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া একজন ব্যক্তি। কীভাবে তিনি হিটলারের নাৎসী বাহিনী থেকে নিজের জীবনকে বাঁচিয়েছিলেন তার ওপর তিনি ‘অফ ব্লাড এন্ড হোপ নামের একটি স্মৃতিচারণম‚লক বইও লিখেছেন। ওবামা প্রশাসনের আমলে এই ব্লিংকেন ছিলেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার প্রভাবশালী সদস্য। তিনি সে সময় মার্কিন ডেপুটি সেক্রেটারী অব স্টেট হিসেবেও কাজ করেন।

ব্লিংকেনের কর্মতৎপরতার কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া সংকটে বেশি সম্পৃক্ত হয়। ব্লিংকেন লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের পক্ষেও ছিলেন। ২০০৩ সালে জো বাইডেন একজন ডেমোক্র্যাট সিনেটর হয়েও তৎকালীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়রের ইরাক আগ্রাসন নীতিকে সমর্থন করেছিলেন। ব্লিংকেন তখনো জো বাইডেনের টিমে কাজ করেছিলেন। ব্লিংকেন গণতন্ত্রের উত্তম সমর্থক তবে তিনি বিশ্বাস করেন গনতন্ত্রকে সংহত করার জন্য অনেক সময়ই বল প্রয়োগেরও প্রয়োজন হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এবার একটু নজর দেয়া যাক মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের দিকে। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল সাউদ জানিয়েছেন, তারা কাতারের সাথে চলমান বিতর্ককে নিরসন করে দুদেশের মধ্যে দুরত্বকে কমিয়ে আনতে চান। ২০১৭ সালে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমীরাত, বাহরাইন ও মিশর কাতারের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এ চারটি দেশের অভিযোগ ছিল কাতার নিয়মিতভাবে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে প্রশয় দেয়। যদিও কাতার বরাবরই এ অভিযোগ প্রত্যাখান করেছে।

প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধেই  বেশি পারদর্শিতা দেখান। ছবি : ইন্টারনেট
প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধেই বেশি পারদর্শিতা দেখান। ছবি : ইন্টারনেট

 

অন্যদিকে, সৌদি আরবের সাথে চীনের সম্পর্কে কিছু উন্নতির আভাস মিলেছে। চীনের ইউহান নির্ভর একটি বন্ড চালু করার বিষয়েও দু দেশ কাজ শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়েই চীন সৌদি আরামকোতে বিনিয়োগ শুরু করতে যাচ্ছে। সৌদি আরামকো হলো পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পেট্রোলিয়াম কোম্পানী। আরামকো সৌদি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান যেটি করোনা মহামারির সময়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

বিশ্ব তেলের বাজার এতদিন একচেটিয়াভাবেই মার্কিন ডলার আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। এবার যদি এখানে চীনের ইউয়ান চলে আসে তাহলে ডলার আবারো একটি বড়ো আকারের প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। চীনের সাথে সৌদি আরবের বেশ বড়ো অংকের ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। সৌদির তেলের সর্ববৃহৎ ক্রেতাদের মধ্যেও চীন একটি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও চীনের একটি কৌশলী সম্পর্ক বহুবছর ধরেই বিদ্যমান রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার বহু আগে থেকেই চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য যুদ্ধ চলে আসছে। চীন সবসময়ই বিশ্ব মার্কেটে ডলারের একচ্ছত্র প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে আসছে। এ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই চীন নিজেদের অর্থনীতি শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দিেেছ। তারা ক্রমশ স্বাবলম্বী হয়েছে এবং বিশ্বজুড়েও এ পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলো প্রনয়ণ করেছে। ডলার বিশ্বজুড়ে যেভাবে সুপার পাওয়ারের আসনে বসে আছে, চীন তা থেকে নামাতে চাইছে।

সৌদি আরবে সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র । স্টকহোমের ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরবে যত অস্ত্র রফতানি হয় তার মধ্যে ৭৩ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এ বিপুল পরিমান অস্ত্র সৌদি আরবে প্রবেশ করে। সৌদি আরবে নানাভাবে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে, ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরব মানবাধিকার লংঘন করেছে। সাংবাদিক জামাল খাসোগীর হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে মার্কিন রাজনীতিবিদ ও সমরবিশেষজ্ঞরা বরাবরই সৌদি আরবে অস্ত্র রফতানি ও সরবরাহের বিরোধিতা করে আসছেন। জো বাইডেন আগাগোড়াই সৌদি আরবের কট্টর সমালোচক। ২০ জানুয়ারী দায়িত্ব নিলে তিনি সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করবেন বলেই বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।

তবে এরই মধ্যে জি-টোয়েন্টি অনুষ্ঠানের সফল আয়োজন করে সৌদি আরব পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে নতুন করে সখ্যতার এবং তুরস্ক ও কাতারকে এক হাত দেখে নেয়ার ইংগিত দিয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর সৌদি সফর ও ক্রাউন প্রিন্সের সাথে গোপন বৈঠক নিয়েও ব্যপক আলোচনা চলছে। ইসরাইলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিককরণে সংযুক্ত আরব আমীরাত ও বাহরাইন স¤প্রতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার নেপথ্যে সৌদি আরবের সক্রিয় ভূমিকা এখন ওপেন সিক্রেট।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে