বাইডেনের আমলে কেমন হবে পাক-মার্কিন সম্পর্ক

মানুষ আশায় বসতি করে। সেই আশা কখনো ফলবতী হয়, কখনো হয় না - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৯ নভেম্বর ২০২০, ১৪:২৮

বহুকাল আগে মার্কিন গণযোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহান ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা বিশ্বগ্রাম কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। আজকের পৃথিবী বাস্তবে তা-ই হয়ে গেছে। এখন ওয়াশিংটনে বৃষ্টি হলে পৃথিবীর অনেক দেশকেই ছাতা মেলতে হয়। আর তাই প্রশ্ন উঠেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন জো বাইডেন। তার আমলে কোনদিকে মোড় নেবে আফগান শান্তি প্রক্রিয়া, আর পাক-মার্কিন সম্পর্কের চেহারাই বা কেমন দাঁড়াবে? আল জাজিরার প্রতিবেদনের আলোকে জানাবো সেই বিশ্লেষণ।

পাকিস্তানীদের কৌতূহলী দৃষ্টি এখন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল এবং কাতারের রাজধানী দোহা-র দিকে। সবার ভাবনা, এক সময় যে-দেশটি ছিল এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলগত মিত্র, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!

পাকিস্তানের দূতিয়ালীতে দোহায় আফগান সরকারের প্রতিনিধি ও আফগান তালিবানের মধ্যে নতুন করে শুরু হয়েছে শান্তি আলোচনা। এতে একটা সমাধানে পৌঁছাতে সব পক্ষই উন্মুখ। তবে ভাষ্যকার ও কর্মকর্তারা বলছেন, পাকিস্তান প্রশ্নে বাইডেন নীতি কেমন হয় তার ওপরই এসব আলোচনার সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করছে।

একজন পাকিস্তানী নিরাপত্তা কর্মকর্তা আল জাজিরাকে বলেছেন , এসব আলাপ-আলোচনার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আফগানিস্তাানে ঐক্য প্রতিষ্ঠা। সেই চেষ্টাই চলছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, আলোচনা ব্যর্থ হোক - এটা আমরা একেবারেই চাই না। কারণ, তেমন কিছু হলে দোষ দেয়া হবে প্রধানত পাকিস্তানকেই। বলা হবে, আলোচনা সফল হওয়ার জন্য পাকিস্তান 'যথেষ্ট' করেনি। মনে রাখতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি বাজার। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হিসাবমতে, গত অর্থবছরেও দু' দেশের আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ছয় দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে তিন দশমিক নয় বিলিয়ন ডলার হচ্ছে পাকিস্তানের রফতানি।

এর বাইরেও আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী এ দেশটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বেসামরিক ও নিরাপত্তা সাহায্য দিয়ে থাকে। মার্কিন সরকারী তথ্যে জানা যায়, গত বছরও তারা পাকিস্তানকে ৬৮৪ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ার অঙ্গীকার করেছিল, যার মধ্যে ৩৬৯ মিলিয়ন ডলার হচ্ছে সামরিক সাহায্য।

পাক-মার্কিন এ সম্পর্ক ২০১৮ সাল থেকে দৃঢ় হতে থাকে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন যখন আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আফগান সরকার ও তালিবানের মধ্যে একটা শান্তিচুক্তি করে দেয়ার অঙ্গীকার করে। কিন্তু কয়েক মাস আগে দু' দেশের এ সুসম্পর্ক কয়েক দশকের মধ্যে নিম্নতম পর্যায়ে নেমে আসে।

একটু পেছনে ফিরে তাকালেই আমরা দেখবো, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথমবারের মতো তার দক্ষিণ এশিয়া নীতি ঘোষণা করেন। সেখানে তিনি চিরাচরিত মার্কিন কায়দায় পাকিস্তানকে তুলাধুনা করেন। তার মুখেও সেই একই গৎ পাকিস্তান তালিবান নেতাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। ট্রাম্প যখন এ অভিযোগ করছেন তখনও পাকিস্তান কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

ট্রাম্পের এ বিবৃতিতে বিপদের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পায় পাকিস্তান। ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে ট্রাম্পের একটি টুইটে তা যেন আরো জোরে শোনা যায়। ওই টুইটে তিনি বলেন, আমেরিকা গত ১৫ বছরে বোকার মতো ৩৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে দিয়েছে পাকিস্তানকে। এর বিনিময়ে তারা আমাদেরকে 'মিথ্যা ও শঠতা' ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। তারা আমাদের নেতাদের বোকা বানিয়েছে।

এ টুইটের পর ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানকে প্রতিশ্রæতি দেয়া এক দশমিক এক বিলিয়ন ডলার নিরাপত্তা সাহায্যও কাটছাঁট করে। এ অর্থ পাওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর, যারা দেশটির ৭৩ বছরের ইতিহাসের প্রায় অর্ধেক সময়ই দেশটি সরাসরি শাসন করেছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের এ কথা ওয়াশিংটনে পাকিস্তানবিরোধীদের কানে মধুর সঙ্গীতের মতো বাজলেও পাকিস্তান পরিষ্কার বুঝতে পারে এর পর কী ঘটতে যাচ্ছে। তারা সতর্ক হয়ে ওঠে।

এদিকে সময়ের সাথে সাথে ট্রাম্প প্রশাসনও বুঝতে পারে, আফগানিস্তানে কোনো রকম শান্তি চুক্তি করতে চাইলে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে তা হবে না। একজন মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, পাক-মার্কিন সম্পর্ক ফের হঠাৎ আবার ভালোর দিকে মোড় নেয়ার একটাই, এবং শুধু একটাই কারণ। তা হলো, ট্রাম্প প্রশাসন তালিবানের সাথে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে এবং তা করতে হলে পাকিস্তানকে তাদের দরকার।

তালিবানের ওপর তাদের ''সীমিত নিয়ন্ত্রণের'' কথা স্বীকার করেও পাকিস্তান তালিবান-মার্কিন আলোচনায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানের এ ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। আলোচনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময় পাকিস্তানে আসেন আফগান সরকারী পক্ষের প্রধান আলোচক আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ, সিনিয়র তালিবান কম্যান্ডার ও আলচক আবদুল গনি বারাদর, হিজব-ই-ইসলামী দলের সাবেক প্রধান গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ার এবং আফগান সরকারের একাধিক প্রতিনিধি দল।

এর ফল হিসেবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন প্রশাসন ও তালিবানের মধ্যে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বলা হয়, আফগানিস্তান থেকে শর্তসাপেক্ষে মার্কিন ও আন্তর্জাতিক বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে এবং সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গত দশকের ক্ষত সারিয়ে পাক-মার্কিন উভয় পক্ষ এখন এক বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে, যা শান্তির সুবাতাস বয়ে আনতে সহায়ক হবে। এদিকে দোহা শান্তি আলোচনা যখন চলছে খুবই ধীর গতিতে, তখন আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্থানে তালিবানরা ফের হামলা চালাতে শুরু করেছে। আর তাতেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, ভঙ্গুর শান্তি প্রক্রিয়াটি না আবার একেবারে বন্ধ হয়ে যায়! পাকিস্তানী কর্মকর্তারা তাদের এ উদ্বেগ চেপে রাখেননি। তারা বলছেন, আফগানিস্তানে সহিংসতা বৃদ্ধি কিংবা আগামী ছয় মাস নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অভ্যন্তরীন বিষয়ে ব্যস্ত থাকা - এ রকম যে কোনো একটা কারণেই যদি দোহা শান্তি আলোচনা ভেঙ্গে যায়, তাহলে এর প্রবল চাপ পড়বে পাকিস্তানের ওপর।

যুক্তরাষ্ট্র যদি তার অভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাহলে শান্তি আলোচনার কি হবে? এমন প্রশ্ন বেশ জোরে সোরো উঠছে। অনেকে মনে করেন, এ ক্ষেত্রে ওই অঞ্চলের দেশগুলোকে সক্রিয় হতে হবে, যাতে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীন দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ব্যাহত না হয়।

পাকিস্তানী কর্মকর্তারা বলছেন, শান্তি আলোচনায় কোনো রকম ব্যর্থতার দায়ভার পাকিস্তান নিতে চায় না। পাকিস্তান চায়, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীন দলগুলোর আলোচনা সফল হোক। আফগান জনগণের ইচ্ছাই জয়ী হোক। আফগান সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার জন্য আমরা যথাসাধ্য করেছি। কারণ, আমরা এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চাই; পাকিস্তাানের স্বার্থেই তা চাই।

পাকিস্তানেও তালিবান গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল এবং তারা সেদেশে সহিংস তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। পাকিস্তানের মাটি থেকে তাদের উৎখাতের লক্ষ্যে একের পর এক সেনা অভিযান চালানোর পর ওই গোষ্ঠীর তৎপরতা এখন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ফলে একটি নিরাপদ দেশ হিসেবে নিজের ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছে পাকিস্তান। এ ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সহায়তাও পাচ্ছে ইসলামাবাদ।

তালিবান ও আফগান ইস্যুতে পাক-মার্কিন সর্ম্পকের উন্নতি ঘটলেও এখন তা দাঁড়িয়েছে বিরাট এক প্রশ্নের মুখে। প্রশ্নটি হলো, বাইডেনের আমলেও কি এটা অব্যাহত থাকবে, নাকি তিনি এর গতি বদলে দেবেন। বেশিরভাগ বিশ্লেষক মনে করেন, এ অঞ্চল নিয়ে ট্রাম্পের করে যাওয়া নীতিই বহাল রাখবেন বাইডেন। টুকটাক কিছু রদবদল করা হলেও হতে পারে।

একজন পাকিস্তানী বিশেষজ্ঞ বলেন, বিরাট কোনো পরিবর্তনের আশাও আমরা করছি না। আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যেতে চায়। বাইডেন এটা আরো পরিস্কারভাবে করবেন। বাইডেনের আছে পররাষ্ট্র বিষয়ক সিনেট কমিটিতে দীর্ঘ দিন কাজ করার অভিজ্ঞতা। এ থেকেই তিনি এ অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্বন্ধে ভালো ধারণা রাখেন। আশা করা যায়, তাঁর আমলে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র দু' দেশের সম্পর্ক আরো ভালো হবে।

আসলেই, মানুষ আশায় বসতি করে। সেই আশা কখনো ফলবতী হয়, কখনো হয় না। আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এ কথাই প্রযোজ্য। বাইডেনের আমলে পাকিস্তানন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ভালো হবে বলেই আশা করছে পাকিস্তান। এ আশাবাদ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে