এশিয়ায় আমেরিকাকে টপকে বাড়ছে চীনের প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্র বুঝতেই পারছে না, চীনকে সামরিক দিক থেকে দাবিয়ে রাখতে চাইলে সেই সাথে অর্থনৈতিকভাবেও তাকে মোকাবেলা করতে হবে - ইন্টারনেট

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১৫ নভেম্বর ২০২০, ১৫:১৪

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল এশিয়া। অঞ্চলটিকে ঘিরে তাই বিশ্বরাজনীতির মোড়লদের তৎপরতাও সবচেয়ে বেশি। একসময় এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগীতা ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। ধীরে ধীরে চীন বিশ্বরাজনীতির বড় খেলোয়াড় হয়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্রকে এখন মোকাবেলা করতে হচ্ছে চীনা প্রভাব। যদিও তাতে খুব বেশি সফলতা দেখাতে পারছে না ওয়াশিংটন। কিভাবে ক্রমশ যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চীন তার প্রভাব বাড়াচ্ছে এশিয়া অঞ্চলে তাই নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।

এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কয়েক দশকের পুরনো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেটি অনেকটাই এক তরফা হয়ে উঠেছিল। যদিও সেই অবস্থার অবসান হয়েছে গত এক দশকে। এখন এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্চ জানাচ্ছে চীন। যার ফলে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে এশিয়ার ভ‚রাজনৈতিক সমীকরণ। অনেক মার্কিন মিত্রও এখন হয়ে উঠছে চীনপন্থী। যেটি ওয়াশিংটনের জন্য হয়ে উঠছে অস্বস্তিকর। আর দুই পরাশক্তির অর্থনৈতিক ও সামারিক প্রভাব বিস্তারের চাপে পিষ্ঠ হচ্ছে এশিয়া।

বেইজিং ক্রমশই এশিয়া অঞ্চলে প্রভাবের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সাথে ব্যবধান কমিয়ে আনছে। এই অঞ্চলে দেশ দুটির রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা ও প্রভাবের পুনর্বিন্যাস ফুটে উঠছে। অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক লোয়ি ইনস্টিটিউটের এক র‌্যাঙ্কিংয়ে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র এখনো এশিয়ায় প্রভাব প্রতিপত্তির দিক থেকে শীর্ষে থাকলেও গত তিন বছর ধরে চীন দ্রæতই ব্যবধান কমিয়ে আনছে তাদের সাথে।

সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিকসহ মোট আটটি ক্যাটাগরির ভিত্তিতে সূচকটি করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে গত দুই বছরের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পড়তির দিকে। চীনের প্রভাব কখনো বাড়ছে, কখনো বা আগের বছরের অবস্থানেই থাকছে। যে কারণে দুটি দেশের মধ্যে ব্যবধান কমে আসছে।

২০১৮ সালে এই সূচকটি প্রথমবার প্রকাশ করা হয়। সে বছর সবগুলো ক্যাটাগরিতে এগিয়ে ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সাথে তাদের ব্যবধান ছিলো ১০ পয়েন্টের; কিন্তু ২০২০ সালে সেই ব্যবধান কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ বছর করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে বিশ্বব্যবস্থার সবকিছুই ওলটপালট হয়েছে, আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব নিকাশও সেই সাথে অনেক বদলে গেছে। তা সত্তে¡ও এ বছর এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠিকই বেড়েছে। যার কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদাসীনতাও হতে পারে বলে মনে করেন লোয়ি ইনস্টিটিউটের গবেষক হারভে লেমিয়েইউ।

এই গবেষক মনে করেন,এশিয়ার রাজনীতি যখন বিশ^ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসছিল তখন কোভিড নাইটিন মহামারি সেই পথ থেকে কিছুটা হলেও বিচ্যুত করেছে। এই মহামারি স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছে যে,এই অঞ্চলের দেশগুলো যতদিন না অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে ততদিন মৌলিক উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের জায়গাগুলোতে তারা বেশ দুর্বলই থাকবে। আর এই সুযোগটিই নিয়েছে চীন। তারা প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে বানিয়েছে প্রধান হাতিয়ার।

এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মূলত সামরিক। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরাইল, সৌদি আরব, কাতারসহ অনেক দেশেই আছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এই দেশগুলোর প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভ‚মিকা রয়েছে। কিন্তু চীন হেটেছে ভিন্ন পথে। তারা প্রথমে অর্থনৈতিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কোথাও বিরাট অঙ্কের ঋণ দিয়েছে, কোন দেশে করেছে হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ।

আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যেসব দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে দ্রæত সেসব দেশকে কাছে টেনে নিয়েছে। শ্রীলঙ্কাকে বড় ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি দিয়েছে বেইজিং। নেপালকে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট সরকার। সে জন্য যা লাগে দিতে প্রস্তুত তারা। ভারতের অবরোধের সময় নেপালকে তারা টিকে থাকতে সহযোগিতা করেছে। ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দীর্ঘদিনের মার্কিন মিত্রদের সাথেও সম্পর্ক জোড়দারে বাড়িয়ে দিয়েছে অর্থনৈতি সহযোগিতার হাত।

ইন্দোনেশিয়ায় ২০১৯ সালে চীন বিনিয়োগ করেছে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থে শুরু হয়েছে ২ হাজার ১৩০টি নতুন প্রকল্প। আবার গত ৭ দশকের সম্পর্ক ভুলে ফিলিপাইন এখন অনেকটাই চীনমুখী। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিরোধ থাকলেও সেটিকে এক পাশে রেখে বাণিজ্য সহযোগিতা বৃদ্ধিতে একমত হয়েছে বেইজিং ও ম্যানিলা।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন পাকিস্তানকে দূরে ঠেলে দিয়ে ভারতকে কাছে টেনেছে, তখনই পাকিস্তানের প্রতি আরো বেশি আন্তরিক হয়েছে চীন। পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক করিডোরেও যুক্ত করেছে তারা। যে কারণে পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক এখন অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। একই সাথে সামরিক দিকটিকেও অবহেলা করেনি চীন। আফগানিস্তানের যুদ্ধ অবসানে তারা নাগ গলাচ্ছে, কাশ্মির ইস্যুতে কথা বলছে। মালদ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য একটি দ্বীপ লিজ নিয়েছে। কম্বোডিয়ায় চীনা সামিরক ঘাটি হবে এমন গুঞ্জন কয়েক মাস ধরেই শোনা যাচ্ছে। এমনিক একটি নৌ ঘাঁটিতে থাকা মার্কিন স্থাপনা ভেঙে ফেলেছে কম্বোডিয়ান সরকার। এসব উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট যে চীন কতটা আটঘাট বেধে নেমেছে এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলার লক্ষ্যে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে মোকাবেলা করতে চীন যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে পরোক্ষভাবে সেগুলোও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যাচ্ছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নয়া দিল্লিকে মোকাবেলার লক্ষ্যে ভারতের সীমান্তবর্তী দেশগুলোকে বিনোয়াগ ও বাণিজ্যের সূতোয় বেধে ফেলছে বেইজিং। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় এখন চীনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

এশিয়ার রাজনীতিতে চীনের উত্থান কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের পতন কোনটিই অনিবার্য ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র যে এ অঞ্চলে প্রভাব হারিয়েছে তার প্রধান কারণ হতে পারে আঞ্চলিক নেতৃত্বদানে তার সামর্থের ঘাটতি। লোয়ি ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক প্রভাব সূচকে একটি বড় উপাদান হচ্ছে পাওয়ার গ্যাপ অর্থাৎ দেশগুলোর ক্ষমতা চর্চার সব উপাদান প্রয়োগের ব্যর্থতা ও আঞ্চলিক প্রভাব। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্কোর মাত্র ২ দশমিক ৪। আর এর জন্য দায়ী হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা বাণিজ্য নীতি ও মিত্রদের প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট বোঝাগুলো ঘাড়ে নিতে না চাওয়া।

যেমন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা দিতে ট্রাম্প প্রশাসন বাড়তি অর্থ খরচ করতে চাননি। যে কারণে ওয়াশিংটনের ওপর অনেকটাই হতাশ হয়েছে এশিয়ার মার্কিন মিত্র দেশগুলো। কেউ কেউ অবশ্য চীন বিষয়ে ট্রাম্পের নীতিকে স্বাগত জানিয়েছে। ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশগুলোর ক্ষেত্রেই ইতিবাচক হয়ে দেখা দেয়নি।

গত চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুগে এশিয়া বিষয়ে গৃহীত নীতিগুলোই এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাবের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্র সড়ে এলেও হয়তো সেটি তাদের জন্য খারাপ হবে না। কারণ এসব সিদ্ধান্ত যতটা ছিলো রাজনৈতিক তারও চেয়ে বেশি ছিলো কাঠামোগত।
চীনের অনেক প্রতিবেশী দেশ বেইজিংয়ের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। এবং কেউ কেউ তো চীনকে হুমকিও মনে করে। তবে তারা সবাই যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র তা নয়;এই দেশগুলোকেও যুক্তরাষ্ট্র কাছে টানতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন বলেই মনে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, চীনকে মোকাবেলা করতে হলে এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্ব আরো জোরদার করতে হবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী র্মাক এসপার সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও অংশীদারিত্বের নেটওয়ার্ক আমাদের এমন কিছু সুবিধা এনে দিয়েছে যার সাথে তাল মেলাতে পারছে না প্রতিদ্ব›দ্বীরা। তার কথাটি হয়তো সত্যি; কিন্তু চীন যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করছে সেটিও ওয়াশিংটনের জন্য মাথা ব্যথার বড় কারণ।

মার্ক এসপারের এই চিন্তা থেকেই ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে নিরাপত্তা ইস্যুতে সংলাপ করেছে ওয়াশিংটন। এছাড়া ভারতের সাথে আরো কয়েকটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক। কারণ এই দেশগুলো চীনের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেমন তার সব কিছুতেই নিরাপত্তা বা সামরিক শক্তির বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়, চীন তার উল্টো। তারা বাণিজ্যিক বিষয়গুলোকে সামনে রেখে এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশাপাশি চীন আরো অনেকগুলো ফ্রন্টে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করছে।

লোয়ি ইনস্টিটিউটের গবেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতেই পারছে না, চীনকে সামরিক দিক থেকে দাবিয়ে রাখতে চাইলে সেই সাথে অর্থনৈতিকভাবেও তাকে মোকাবেলা করতে হবে। মিত্রদের শুধু নিরাপত্তা নয়, অর্থেরও প্রয়োজন আছে। আর এই জায়গাটিতেই ওয়াশিংটন মার খেয়ে যাচ্ছে বেইজিংয়ের পলিসির কাছে। আর এজন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নেতৃত্ব।  নতুন প্রেসিডেন্ট এলে তার নীতি কেমন হবে সেটিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বাইডেন এসেই ট্রাম্পের সব সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলবেন সেটিও মনে করা ভুল।

এক্ষেত্রে চীন অবশ্য পুরোপুরিই নির্ভার। দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শি জিনপিং নিশ্চিতভাবেই আরো অনেক দিন থাকবেন ক্ষমতায়। কমিউনিস্ট পার্টিতে শি জিনপিং এখন শুধু নেতাই নন, তার মতবাদ দলটির আদর্শ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সহসাই কোন পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই। এলেও সেটি হবে শুধুমাত্র চীনা প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে