চুপিসারে ইতিহাস গড়লেন কয়েকজন মার্কিন মুসলিম

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ এবং বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আইনসভা নির্বাচনে আমেরিকানরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১২ নভেম্বর ২০২০, ২০:৪৯

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এবারের নির্বাচন ঘটেছে অভুতপূর্ব সব ঘটনা। নানা দিক দিয়ে হয়ে উঠেছে নজিরবিহীন। কৌতুহল, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যেই একেবারে চুপিসারে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ক'জন আমেরিকান মুসলিম।

যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে একাধিক মুসলিম প্রার্থীর বিজয় বেশ বিস্ময়কর। কেননা, যতই আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার ধূয়া তোলা হোক, আমেরিকার অকারণ 'ইসলামভীতি' তো এখন আর লুকানো কিছু নয়। কমিউনিজমের পতনের পর তারা ঘোষণা দিয়ে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। আফগানিস্তান থেকে ইয়েমেন, ইরাক থেকে লিবিয়া - গোটা মুসলিম দুনিয়া এর জ্বলন্ত সাক্ষ্য। এমন অবস্থার মধ্যে যখন খবর আসে যে খোদ মার্কিন দেশেই বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে একজন-দু'জন করে মুসলিম সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন, তখন পুরো ব্যাপারটিকেই কেমন যেন অবাস্তব, অবিশ্বাস্য মনে হয়।

অবশ্য এর মানে এই নয় যে, এর ফলে কোনো-এক অজানা ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের জয়জয়কার হবে। বরং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পারফরম্যান্স দেখে ইসলাম ও মুসলিমদের পুঞ্জিভূত ভুল ধারণা ও আক্রমণাত্মক মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে, সেটাই হবে বড় অর্জন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ এবং বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আইনসভা নির্বাচনে আমেরিকান জনগন তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন। এতে বেশ ক'জন মুসলিম প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যের আইনসভায়ও তারা জায়গা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তারা গড়েছেন নতুন ইতিহাস। জানা যাক তাদের কয়েকজনের কথা।

ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যের ডিস্ট্রিক্ট ৮৮ থেকে গত প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন মৌরিন টারনার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রকাশ্য নন-বাইনারি মুসলিম, যিনি সেদেশের কোনো অঙ্গরাজ্যের আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হলেন। নির্বাচনে ২৭ বছর বয়সী মৌরিন শতকরা ৭১ ভাগ ভোট পেয়ে তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী কেলি বার্লিনকে হারিয়ে দেন। তিনি ক্রিমিন্যাল জাস্টিস রিফর্ম আন্দোলেনের একজন সক্রিয় কর্মী। নির্বাচিত হওয়ার পর এক টুইট বার্তায় তিনি তাঁকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করায় জনগণকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। বলেন, আজ রাতটা আমার মনটা অন্যরকম এক অনুভূতিতে ভরপুর।

ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের সিনেটে নির্বাচিত হয়েছেন আরেক মুসলিম প্রার্থী। প্যালেস্টাইনী বংশোদ্ভূত এ সিনেটরের নাম নাম ফ্যাডি কদৌরা। ওই রাজ্যের ইতিহাসে তিনিই প্রথম মুসলিম সিনেটর। ৪৪ বছর বয়সী এই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে হারিয়ে দেন তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি ফেইসবুকে একটি বিবৃতি দিয়ে নিজের বিজয়বার্তা ঘোষণা করেন। বিবৃতিতে তিনি ভোটের ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ এবং কঠোর পরিশ্রমের অঙ্গীকার করেন। তিনি লিখেন, ''উই ডিড ইট! লাখো ভোটার আমার প্রতি যে আস্থা রেখেন, তার মর্যাদা রক্ষায় আমি কঠোর পরিশ্রম করে যাবো; এমনকি যারা আমাকে ভোট দেননি তাদের জন্যও।

কদৌরা বলেন, সিনেটর হিসেবে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্ষুদ্র ব্যবসার উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দিকে দিকে বিশেষ নজর দেবেন।

ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাট পার্টির টিকেটে নির্বাচিত হয়েছেন মদিনাহ উইলসন-অ্যাল্টন। ওই অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি পরিষদে তার আগে কোনো মুসলিম নির্বাচিত হননি। তিনি পেয়েছেন ৭১ শতাংশ ভোট। এই মুসলিম নারী তাঁর নির্বাচনী প্রচারকালে শিক্ষা খাতে আরো বেশি বরাদ্দ দেয়ার পক্ষে কাজ করবেন বলে অঙ্গীকার করেন, যাতে সকল শিশু গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ পায়। তিনি আরো বলেন, নির্বাচিত হলে তিনি কর্পোরেট ওয়েলফেয়ারের অবসান, ২০৫০ সালের শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি অর্জনের ব্যবস্থা এবং রাজ্যবাসীর জন্য একটি প্রগতিশীল করব্যবস্থা চালুর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ইমান জোদেহ। প্যালেস্টাইনী বংশোদ্ভুত এই ফার্স্ট জেনারেশন আমেরিকান নারী ওই রাজ্যের প্রতিনিধি পরিষদের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম সদস্য। পেশায় শিক্ষাবিদ এই নারী বরাবরই রাজ্যের মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার।

ইমান এক টুইট বার্তায় তার জয়ের খবর সবাইকে জানান এবং নিজ এলাকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পারায় গর্ব প্রকাশ করেন। টুইটারে তিনি লিখেন, আমেরিকান স্বপ্নকে সকলের জন্য বাস্তবে রূপায়িত করার লক্ষ্যে আমি কাজ করে যাবো। এবার আমার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার পালা।

উইসকন্সিন অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন সামবা বালদেহ। তিনিই ওই রাজ্য প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদের প্রথম মুসলিম সদস্য। তিনি শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পেয়েছেন।
সামবা মূলত গাম্বিয়া থেকে আসা এক অভিবাসী। তিনি কখনোই তাঁর ছেলেবেলার কথা জানাতে সংকোচ বোধ করেন না। ওই সময় তার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটতো গৃহপালিত পশুপাল দেখাশোনা করে। তিনি তাঁর যাযাবর মা-বাবাকেও তাঁদের কাজে সাহায্য করতেন।

নির্বাচনী প্রচারকালে তিনি জানান যে তার সবচাইতে বড় অগ্রাধিকার সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু পরিবর্তন ও শক্তিশালী অর্থনীতি। এছাড়া তাঁর অন্যান্য ইস্যু ছিল ক্রিমিন্যাল জাস্টিস রিফর্ম, নারী অধিকার, আবাসন ও শিক্ষা।
নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত জোহরান কাওয়ামে মামদানি। তিনি ইন্ডিয়ান-উগান্ডান নিউ ইয়র্কার। নির্বাচনী প্রচারকালে তিনি বলেন, আমি লড়ছি সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, শিশু পরিচর্যা এবং সকলের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আমি চাই, দাম দেয়ার সামর্থ্য থাক আর না-ই থাক, নিউ ইয়র্কের সকল মানুষ যেন আবাসন পায়।
তিনি বলেন, আমার সবচাইতে বড় লক্ষ্য হলো, আবাসনকে সকলের আওতার মধ্যে নিয়ে আসা। আমাদের আবাসনব্যবস্থা মানুষের সাধ্যের বাইরে এবং এর বিল পরিশোধ করাও অসম্ভব। এর কারণ হলো, বড় বর বাড়িওয়ালা ও কর্পোরেশনগুলোর অনেক বেশি ক্ষমতা। হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার কাজে আমি আমার প্রতিবেশীদের সাহায্য করতে চাই।

এবার বলা যাক নিদা আলমের কথা। ২৬ বছর বয়সী এই নারী নর্থ ক্যারোলিনা কাউন্টি কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ওই কমিশনে তিনিই প্রথম মুসলিম। তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল জবাবদিহিতা, উচ্চ মানের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া।

মিশিগান প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন ইয়েমেনী-আমেরিকান নারী আয়েশা। আগামী বছর জানুয়ারী মাসে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। তাঁরও অগ্রাধিকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, অভিবাসী জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসা ইত্যাদি। এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন ইস্যু তো আছেই।

আয়েশা বলেন, আমার মা-বাবা ইয়েমেন থেকে এখানে এসেছিলেন এবং এই এলাকায় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে তুলেছেন। এই শ্রেণীটি আমাদের শিক্ষা দিয়েছে কঠোর পরিশ্রমী হতে, উপকারের প্রতিদান দিতে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে। এখানে আমাদের দরকার সহযোগিত াপরায়ন ও প্রগতিশীল নেতৃত্ব।

এবার আসা যাক ওমর ফাতেহর কথায়। তিনি একজন সোমালিয়ান ভিন্নমতাবলম্বী। এবার তিনি ৮৯ শতাংশ ভোট পেয়ে মিনেসোটা স্টেট সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। মিনেসোটা মহানগরীতে ব্যাপক সমাজকর্ম চালিয়ে ওমর ফাতেহ পরিচিত ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এটাই তাঁকে নির্বাচনে সিংহভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ী হতে সাহায্য করে।এটাও একটা দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। এ থেকে গণতান্ত্রিক বিশ্বের অনেক কিছু শেখার আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মুসলিম নারী কংগ্রেস উইম্যান ইলহান ওমর দ্বিতীয়বার মিনেসোটার ৫ম কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট মিনিয়াপোলিস থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। ৩৮ বছরের ওমর হারিয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী আফ্রিকান আমেরিকান ব্যবসায়ী ল্যাসি জনসনকে। বার্তা সংস্থা এপির তথ্য অনুসারে, ৯৯ শতাংশ ভোট গণনার পর ওমর পেয়েছেন ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রথম দুই মুসলিম নারী কংগ্রেস সদস্যের একজন ইলহান ওমর। শিশু বয়সে চার বছর কেনিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে ছিলেন তিনি। পরে শরণার্থী হিসেবে নিজ দেশ সোমালিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। হিজাব পরা আইন প্রণেতা হিসেবে তিনিই প্রথম মার্কিন কংগ্রেসে ঢোকার ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

ইলহান ওমর ডেমোক্র্যাট পার্টির তথাকথিত ‘স্কোয়াড’-এর সদস্য। এই স্কোয়াডে চারজন প্রগতিশীল নারী কংগ্রেস উইম্যান রয়েছেন। ইসরায়েলবিরোধী ও ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করে বেশ আলোচনায় ছিলেন ইলহান ওমর। তিনি নিয়মিত ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের তোপের মুখে পড়েছেন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে