ইসরাইলের সাথে চুক্তি করে কী পাবে সুদান

যে সুদান দশকের পর দশক ইসরাইলের বিরোধিতা করে এসেছে, এ চুক্তি সেই সুদানকে কী দেবে! - তাঘরিব নিউজ ডটকম

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১২ নভেম্বর ২০২০, ১৩:৩৩

মার্কিন নির্বাচনের আগে দুই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর মধ্যে যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় তাতে বরাবরই প্রাধান্য পেয়ে থাকে পররাষ্ট্রনীতি। বিস্ময়করভাবে এবার তার ব্যত্যয় ঘটেছে। পররাষ্ট্রনীতিকে ছাপিয়ে এবার শীর্ষে উঠে এসেছে করোনা অতিমারী। বিতর্ক অনুষ্ঠানে যা-ই হোক, পররাষ্ট্রনীতির কথা কিন্তু ঠিকই মাথায় রেখেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইসরাইল ও সুদানকে দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা প্রদানকে ট্রাম্পের নির্বাচনী কৌশলেরই একটা অংশ বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সুদানের প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লাহ হামদক-কে দু'পাশে রেখে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে দু'দেশের সমঝোতার ঘোষণাটি দেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেন, ইসরাইল ও সুদান উভয় দেশই শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়েছে।
এ সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার স্বভাবমাফিক কৌতুক করতেও ছাড়েননি। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ''আপনার কি মনে হয় যে ঘুমকাতুরে জো এ চুক্তি করতে পারতেন? ''ঘুমকাতুরে জো'' বলতে ট্রাম্প তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকেই বুঝিয়েছেন।

এমন একটা বেমক্কা প্রশ্নে নেতানিয়াহু স্পষ্টতই বিব্রত ও বিরক্ত হন। কারণ, এ প্রশ্নের সাথে জড়িয়ে মার্কিন নির্বাচনের গন্ধ। ওই নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকতে চান নেতানিয়াহু। তাই তিনি ঈষৎ অসন্তুষ্ট গলায় জবাব দেন, আমি আপনাকে যে কথাটা বলতে পারি তা হলো, শান্তি প্রতিষ্ঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে-কারো সাহায্যই আমরা সাদরে মেনে নেব।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর এমন জবাবের কারণ হলো, ইসরাইলের কাছে এটা অনেক বড় ইস্যু। এটা ওই অঞ্চলের বদলে যাওয়ারই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সুদান-ইসরাইল সমঝোতার পূর্ণ বিবরণ এখনও পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গেছে তাও ভাসা ভাসা। তারা একে অন্যের দেশে দূতাবাস খুলবে কি না, তা-ও এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ইসরাইলী সূত্র মিডিয়াকে বলেন, এ বিষয়ে সুদান ও যুক্তরাষ্ট্র কী বলে, আগে তা-ই দেখবে ইসরাইল। কেননা, এ বিষয়ে খুব জোর দিচ্ছে না তারা।

এদিকে সুদান পড়েছে আরেক বিপাকে। তারা যে বিষয়টি সবাইকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও বোঝাতে পারছে না তা হলো, ইসরাইলের সাথে সুদানের এটা কোনো শান্তিচুক্তি নয়, নেহাৎ স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠামাত্র।

উভয় দেশের এই সমঝোতা বিষয়ে যেটা নিশ্চিতভাবে জানা গেছে তা হলো, সুদানকে ইসরাইল সাহায্য দেবে আর সেদেশের বেসরকারী খাতকে অনুমতি দেবে সুদানের প্রযুক্তি ও কৃষি খাতে পুঁজি বিনিয়োগের। সুদানের কাছে এটাও কম নয়। কেননা, দেশটিতে দশকের পর দশক ধরে চলেছে সামরিক জান্তার শাসন।

মাত্র গত বছরই তার অবসান ঘটেছে এবং ক্ষমতায় এসেছে নতুন সরকার। এ সরকার জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় ইসরাইলী ত্রাণ তাঁদের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তির বার্তা বয়ে আনবে, এতে আর সন্দেহ কী।

সুদান ও ইসরাইলের এ সমঝোতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেশ-কিছুটা প্রভাব ফেলবে বলেই রিপাবলিকান শিবিরের ধারণা। তাঁর বাইরেও যা ঘটবে তা হলো, এটা ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক রদবদল ঘটিয়ে দেবে। যেমন, এখন এমনিতে একঘরে হয়ে থাকা ইরান আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। নেতানিয়াহুর কথায় তারই আভাস মেলে। তিনি বলেন, দু' দেশের সমঝোতায় ''ইরান নাখোস, হেজবুল্লাহ নাখোস, হামাস নাখোস। এছাড়া আর বাকি সবাই খুশি''।

এসব ঘটনা দেখে প্যালেস্টাইন অবশ্যই অখুশি। কারণ, বহু বছর ধরে প্যালেস্টাইনের কট্টর সমর্থক দেশ ছিল সুদান। সে-রকম একটি দেশ কিনা ইসরাইলের সাথে মৈত্রী গড়লো! এছাড়া ''স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না-হওয়া পর্যন্ত ইসরাইলের সাথে কোনো রকম সমঝোতা নয়'' মর্মে আরব মতৈক্যও আজ ভূলুণ্ঠিত। এ অবস্থা দেখে পিএলও-র একজন কর্মকর্তা বলেন, ''প্যালেস্টাইনের পিঠে আরেকবার ছুরি মারা হলো''।

পিএলও-কর্মকর্তার এ কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, প্যালেস্টাইনের দুঃখী মানুষদের কথা একবারও না-ভেবে এ বছরই ইসরাইলের সাথে একই রকম চুক্তি করেছে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমীরাত।

তবে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমীরাতের সাথে ইসরাইলের সমঝোতা স্ট্র্যাটেজিক্যালি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সুদানের সাথে ততোটা নয়। ভুললে চলবে না, বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে আমীরাত এখন বড় খেলোয়াড়। আর বাহরাইনের ক্ষেত্রে রয়েছে সউদি আরবের সমর্থন অর্থাৎ বাহরাইন যা করবে, তা সউদি আরব করেছে বলেই ধরে নিতে হবে।

সুদানের সাথে ইসরাইলের চুক্তির ফলে দু' দেশের কিছুই এ মুহূর্তে পাল্টাবে বলে মনে করছেন না পর্যবেক্ষকরা, যদিও নেতানিয়াহু একটু বেশি আশাবাদী কথা বলে ফেলেছেন। বলেছেন, এটা একটা নতুন পৃথিবী, যেখানে সবার জন্যে আরো উন্নত ভবিষ্যত গড়তে আমরা একে অপরকে সহযোগিতা করবো।

নেতানিয়াহু যা-ই বলুন, ইতিহাস কিন্তু বলে তার চাইতে ঈষৎ ভিন্ন কথা। পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সুদানও অংশ নিয়েছিল, যদিও সেই অংশগ্রহণটা ছিল প্রতীকী। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধেও তারা সৈন্য পাঠায়। তবে সুদানী সৈন্যরা রণাঙ্গনে পৌঁছার আগেই যুদ্ধ থেমে যায়।

তার চাইতেও বড় কথা, অল্প কিছুকাল আগেও পশ্চিমারা সুদান নামের দেশটির গায়ে ''দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের'' তকমা লাগিয়ে রেখেছিল। দারফুর গণহত্যা এবং আল কায়েদা ও হামাসের নেতাদের আশ্রয় দেয়ার কারণেই এ তকমা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ কারণে সুদানের ওপর অবরোধও আরোপ করে।

২০১৬ সালে সুদানই সর্ব প্রথম ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের ধারণাটি প্রকাশ করে। তখন সবাই বলাবলি করতে থাকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাতে অবরোধ তুলে নেয়, সে-জন্যই সুদান এ কথা বলছে। যাহোক, পরের বছর বারাক ওবামার সরকার সুদানের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, সুদানের আচার-আচরণের মান উন্নত হওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ অবরোধ প্রত্যাহার করা হলো।
২০১৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান সুদানের 'শক্ত মানুষ' ওমর আল-বশির। এরপর থেকে দেশটি পশ্চিমা দুনিয়ার আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা আসার কয়েক দিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের ''সন্ত্রাসী দেশের'' তালিকা থেকে সুদানের নাম বাদ দেয় ট্রাম্প প্রশাসন।

সুদানের সাথে ইসরাইলের সম্পর্কটিও বরাবরই ভঙ্গুর। দু' দেশের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও উভয় দেশ গত কয়েক দশক ধরে পরস্পরের সাথে চালিয়ে যাচ্ছে অঘোষিত লড়াই। ১৯৯০ সালে সুদানে বিমান হামলা চালায় ইসরাইলী এয়ারফোর্স। সুদানের যে পথ দিয়ে প্যালেস্টাইনের হামাস গোষ্ঠীর কাছে ফজর-৩ রকেট যায়, সেই পথটাই ছিল এ হামলার টার্গেট। এ হামলায় স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয় সুদান। তারা বলে, ''অপর দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা বেআইনী কাজ।'' এর দু' বছর পর পোর্ট সুদানে হামাসের একজন কর্মকর্তাকে হত্যা করে ইসরাইল।

ওই সময় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট হুমকি দেন, সুদানসহ পৃথিবীর কোথাও হামাস নিরাপদ নয়। যারা জানেন না তারা জেনে রাখুন, ইসরাইল অপারেশন চালাতে পারে না, এমন জায়গা পৃথিবীর কোথাও নেই।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পরপরই আরব লীগের নেতারা সুদানের রাজধানী খারতুমে এক বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে প্রস্তাব পাস হয়, ''আরব দেশগুলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে না, তাঁদের সাথে আলোচনা করবে না, শান্তি স্থাপনও করবে না''।

আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সুদানের অংশ গ্রহণে এমনিতেই ক্ষিপ্ত ছিল ইসরাইল, তার ওপর সুদানের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এমন প্রস্তাব! প্রতিশোধ নিতে ইসরাইল এবার সুদানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা দিতে শুরু করে। ইসরাইলের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পেয়ে দক্ষিণ সুদানী বিদ্রোহীদের আর পায় কে! দীর্ঘ সংগ্রামের এক পর্যায়ে তারা সুদানের সরকারি বাহিনীকে বিতাড়িত করে ''স্বায়ত্বশাসিত এলাকা'' প্রতিষ্ঠা করে এবং এরপর ২০১১ সালের জুলাই মাসে স্বাধীন হয়ে যায়। তাঁদের সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় ইসরাইল।

সেই ইসরাইলের সাথে এখন সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে সুদান। এ অবস্থায় দক্ষিণ সুদান বুঝতে পারে, ইসরাইলের কাছে তাদের সেই গুরুত্ব কিছুটা হলেও কমবে। তারপরও তারা এ চুক্তির বিরোধিতা করেনি। কারন এ চুক্তি আসলে একটি আমেরিকান প্রজেক্ট। আর যেহেতু আমেরিকা ও ইসরাইলের সাহায্য ছাড়া দক্ষিণ সুদানের চলবে না, তাই এ চুক্তির বিরুদ্ধেও যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, সুদান ও দক্ষিণ সুদানের সম্পর্ক আগের চাইতে ভালো হয়েছে। তারা এখন পরস্পরের জন্য সমস্যা সৃষ্টি না-করে নিজের ঘর সামলানোর দিকে বেশি করে মন দিয়েছে।

সুদান-ইসরাইল চুক্তিটি আমেরিকা ও ইসরাইলের পররাষ্ট্রনীতির বিজয় - এ নিয়ে কোনো ভিন্নমত নেই। কিন্তু যে সুদান দশকের পর দশক ইসরাইলের বিরোধিতা করে এসেছে, এ চুক্তি সেই সুদানকে কী দেবে, এ প্রশ্ন আজ অনেকের।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে