এরদোয়ানের সাথে বাইডেনের সর্ম্পক কেমন হবে

বাইডেনের বিজয়ে তুরস্কবাসী উল্লাসে একেবারে ফেটে পড়েনি। তবে এটাও ঠিক, অন্য অনেক দেশের সাথে ট্রাম্পের সম্পর্ক একেবারে নিম্নতম পর্যায়ে নেমে গেলেও তুরস্কের সাথে মোটামুটি সুসম্পর্কই ছিল - ডেইলি সাবাহ

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১২ নভেম্বর ২০২০, ১৩:১৬

আমাদের দেশেও অনেকে মনে করেন, আমেরিকায় কে প্রেসিডেন্ট হলো না হলো, তাতে আমাদের কী যায়-আসে। কথাটাকে হালকাভাবে নিলে কিছু বলার থাকে না, কিন্তু গুরুত্বের সাথে নিলে বলতেই হয়, আমাদের এবং বাকি পৃথিবীর অনেক কিছুই যায়-আসে। ভুলে গেলে চলবে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের একক পরাশক্তি। তারা চাইলে পৃথিবীতে অনেক অঘটন ঘটাতে পারে এবং ঘটাচ্ছেও। তাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হলেন, সেটার গুরুত্ব বিশ্ববাসীর কাছে অনেক। আমাদের আজকের আলোচনা অবশ্য বাকি বিশ্ব নিয়ে নয়, মুসলিম বিশ্বের উদীয়মান সুপার পাওয়ার তুরস্ককে নিয়ে।

জো বাইডেন হতে যাচ্ছেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট - বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার সাথে-সাথেই প্রশ্ন উঠেছে, বাইডেনের শাসনকালে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্ক কেমন যাবে? বলা হচ্ছে, ট্রাম্প 'কর্তৃত্ববাদী' শাসকদের সম্মান দিতেন। তুরস্কের সাথে কঠোর হয়ে বাইডেন সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাই করবেন হয়তো।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে দলের এক র‌্যালিতে যোগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান। সেখানে দেয়া ভাষণে এরদোয়ান তাঁর দেশের ন্যাটো মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে কড়া ভাষায় বলেন, ''আপনারা জানেন না, কার সাথে কাজ করছেন।''

রাশিয়ার কাছ থেকে বিতর্কিত মিসাইল সিস্টেম কিনলে তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপের মার্কিন হুমকি প্রসঙ্গে এরদোয়ান বলেন, অবরোধ করবে? করলে করো! যা হওয়ার হবে।

মনে করা হচ্ছে, তুরস্কের এ বক্তব্য কেবল ট্রাম্প নন, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপরও বর্তায়। তুরস্ক সরকারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা তাঁর নাম প্রকাশ না-করার শর্তে মিডিয়াকে বলেন, বাইডেনের বিজয়ে তুরস্কবাসী উল্লাসে একেবারে ফেটে পড়েনি। তবে এটাও ঠিক, অন্য অনেক দেশের সাথে ট্রাম্পের সম্পর্ক একেবারে নিম্নতম পর্যায়ে নেমে গেলেও তুরস্কের সাথে মোটামুটি সুসম্পর্কই ছিল। গত গ্রীষ্মে এক টিভি সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প সরাসরি সে-কথা বলেও ফেলেন। তিনি বলেন, ''এরদোয়ানের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ ভালো।''

তুরস্ক গত বছর রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনার পরও ট্রাম্প-এরদোয়ান সম্পর্কে তাই ভাঙ্গন ধরেনি। কোনো দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনলে ওই দেশের ওপর অবরোধ আরোপের একটি আইনও আছে যুক্তরাষ্ট্রে। আইনটি কাজে লাগিয়ে তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি একাধিকবার আহবান জানিয়েছে কংগ্রেস এবং পররাষ্ট্র বিভাগ। কিন্তু প্রতিবারই তুরস্কের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ট্রাম্প।

এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন তুরস্কের একজন কর্মকর্তা। তার মতে, দুই নেতার মধ্যে এক ধরনের ওয়ার্কিং রিলেশন ছিল। এ কারণেই অবরোধ প্রশ্নে কংগ্রেসের লাগাম টেনে ধরতে চাইছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ প্রসঙ্গে একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলেন, ওয়াশিংটনে তুরস্কের বন্ধু বলতে একজনই ছিলেন, তিনি হচ্ছেন ট্রাম্প।

নতুন মার্কিন প্রশাসনের নীতি হবে ভিন্ন। 'কর্তৃত্ববাদী' শাসকদের প্রতি ট্রাম্পের বহুনিন্দিত আকর্ষণ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইবেন বাইডেন। আর এর অংশ হিসেবে তুরস্কের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেবেন তিনি। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ব্যবস্থা কতোটা কঠোর হবে এবং বাজারে তার প্রতিক্রিয়াই বা কেমন হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তুরস্কের বিরুদ্ধে পাঁচ রকম ব্যবস্থা নেয়া যায়। এর একটি হলো, দু'দেশের মধ্যে ব্যাঙ্ক লেনদেন বন্ধ করা।

নতুন মার্কিন প্রশাসন কি তা করবে? এক তুর্কী বিশেষজ্ঞের মতে, সেটা নির্ভর করবে কংগ্রেসে বিদ্যমান রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপর। কিন্তু কথা হলো, ট্রাম্প প্রশাসন তো তুরস্কের ওপর কিছু অবরোধ আরোপ করেই ফেলেছে। যেমন, ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে মার্কিন যাজক এন্ড্রু বার্নসনকে তুরস্ক কারাগারে নিক্ষেপ করলে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তুরস্ক থেকে অ্যালুমিনিয়াম ও ইস্পাত আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রভাবে ডলারের বিপরীতে তুর্কী লিরার ব্যাপক দরপতন ঘটে। তুরস্কের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে নতুন মার্কিন প্রশাসন আরো অবরোধ আরোপ করে কি না, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে তুরস্ক সরকারে।

রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেমের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করেছে তুরস্ক। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার প্রোগ্রামে তুরস্কের অংশ গ্রহণ একেবারেই শেষ হয়ে গেছে। এক বিশেষজ্ঞ বলেন, এটি এখন ক্লোজড ফাইল। যদিও দেশটি এখনও এফ-৩৫এর কিছু যন্ত্রাংশ এখনও উৎপাদন করছে, তাও চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে যাবে।

তুরস্ক ১০০টি এফ-৩৫ জঙ্গি বিমান কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু রুশ-নির্মিত এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনা এবং বাইডেনের নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এর কোনো সম্ভাবনাই আর রইলো না। তুরস্কের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, কোনো কিছুই আমাদেরকে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে পারবে না। আমরা বাইডেনের সাথে সংলাপের চেষ্টা করবো।

গত আগস্ট মাসে ফাঁস হয়ে যাওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, বাইডেন তুরস্কে বিরোধী দলকে সমর্থন দেয়ার কথা বলছেন, যাতে তারা এরদোয়ানকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করতে পারে। ভিডিওটি তুরস্কের সরকারী মহলে তীব্র ক্রোধের জন্ম দেয়। বিব্রত হয় বিরোধী শিবিরও।

তুরস্কের একজন কর্মকর্তা বলেন, ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাইডেন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ওই সরকার সে-সময় এমন অনেক কিছু করেছে, যাকে তুরস্ক ভালোভাবে নেয়নি। যেমন সিরিয়ায় তারা সমর্থন দিয়েছে ওয়াইপিজি নামের একটি মিলিশিয়া বাহিনীকে। এটিকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে-র একটি শাখা বলেই মনে করে তুরস্ক। আর তুরস্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সবাই পিকেকে-কে ''সন্ত্রাসবাদী'' সংগঠনের তকমা দিয়েছে। তুরস্কের প্রশ্ন, তাহলে পিকেকে-র শাখা কিভাবে মার্কিন সমর্থন পেতে পারে?

এমন অবস্থায় তুরস্ক কী করতে পারে? একজন সাবেক কূটনীতিক মনে করেন, ট্রাম্পের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তুরস্কের জন্য যে ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে তা সামাল দিতে দেশটির উচিত কোনোক্রমেই শুধু এক ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে না-থাকা; এমনকি ওই ব্যক্তি যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্টও হন। তাদের উচিত হবে কংগ্রেস, পররাষ্ট্র বিভাগ, পেন্টাগনসহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলা।

অপর এক কূটনীতিক আরো স্পষ্ট ভাষায় বলেন, তুরস্ক এতদিন যাদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল, আজ সময় এসেছে তাদের কাছে টেনে নেয়ার।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি হয়ে উঠেছে ক্রমেই জেদি এবং অতিমাত্রায় জাতীয় স্বার্থ ভিত্তিক। ফলে জড়িয়ে পড়েছে সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধেও তুরস্ক একটি পক্ষ নিয়েছে। আর পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে গ্রীস, সাইপ্রাস ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে বিরোধ তো চলে আসছে অনেক দিন ধরেই। লিবিয়ায় তুরস্কের উপস্থিতি বাইডেন প্রশাসন স্বাভাবিকভাবে নাও নিতে পারে।ৎ

প্রশ্ন হলো এবার কি তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সাথেও বিরোধে জড়িয়ে পড়বে তুরস্ক? একজন সিনিয়র কূটনীতিক মনে করেন, বাইডেন প্রশাসনের সাথে সহযোগিতার অনেকগুলো ক্ষেত্র আছে তুরস্কের সামনে। কেননা, বাইডেন ন্যাটো জোটকে শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। আর তুরস্ক তো ন্যাটো জোটেরই সদস্য। তুরস্কের সাথে বর্তমান টানাপোড়েন সত্তে¡ও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে ওই দেশটির সাথে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ গড়ে তোলা।

বাস্তবতা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সর্ম্পকের ক্ষেত্রে এরদোয়ান প্রশাসনকে বেশ চ্যানেল মোকাবিলা করতে হবে। আবার বাইডেনের পক্ষে তুরস্ককে উপেক্ষা করা বা কঠোর পদক্ষেপ নেয়া সহজ নয়। ভূ রাজনীতিতে এরদোয়ান একজন শক্ত খেলোয়াড়। ইতোমধ্যে রাশিয়ার সাথে তিনি এক ধরনের পার্টনারশীপ গড়ে তুলেছেন। সেদিকেও নজর আছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে বাইডেনকেও একই সাথে সুসম্পর্ক ও কঠোর ব্যবস্থা - এই দ্বৈরথ সামাল দিয়ে এগুতে হবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে