নির্বাচন নিয়ে বিভক্ত মার্কিন সমাজ

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার জাতীয়বাদী রাজনীতি দিয়ে মার্কিন সমাজে যে বিভক্তির বীজ বুনে দিয়ে গেছেন তার জন্য বিশ্ব মোড়ল হয়ে থাকা দেশটিকে হয়তো অনেক বড় মাশুল দিতে হবে - ইন্টারনেট

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৭ নভেম্বর ২০২০, ১৫:০৮

নজিরবিহীন এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির ৫৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এসে বিশ্ববাসীও স্বাক্ষী হলো নানা কান্ডের। ভোট চুরির অভিযোগ, আদালতে মামলা, রাস্তায় সহিংসতা সবই দেখেছে এবারের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। ভোট গণণায়ও এবার লাগছে দীর্ঘ সময়। ভোটের পরে দুই দিন ধরে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দেশটির নাম যুক্তরাষ্ট্র বলেই সারা বিশ্বই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে কখন খবর আসবে ২৭০ ইলেকটোরাল ভোটের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করার। আজ জানাবো যুক্তরাষ্ট্রের এবারে নির্বাচনের নানা দিক সম্পর্কে।

নানা কারণে এবারের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরু থেকেই অনেকটা ব্যাতিক্রম। করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্ব যখন টালামাটাল তার মধ্যেই দেশটিতে বেজে উঠেছে নির্বাচনী ডামাডোল। একদিকে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হয়েছে, অন্য দিকে চলেছে নির্বাচনী প্রচারণা। যে কারণে এবারের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন জনগনের স্বতঃস্ফূর্ততাও আগের যে কোন বারের চেয়ে অনেক কম ছিলো। সবার আগে তো নিজের জীবন! জীবনই যেখানে হুমকির মুখে সেখানে কে-ই বা চাইবে নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাতে। তবু দুই প্রার্থী সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন ভোটাদের আকৃষ্ট করতে। লকডাউল শিথিল হওয়ার পর তাই ভোটের মাঠ জমে উঠেছে। করোনাকে সঙ্গী করেই চলে প্রচারণা। ফলাফল যা হওয়ার তাই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার মধ্যেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেছেন। ভাগ্য সহায় ছিলো তাই আবার ফিরেছেন ভোটের মাঠে।

করোনার বাইরেও শুরু থেকেই এবারের নির্বাচন নিয়ে নানা সংশয় ছিলো। ভোটে হারলে সময়মতো ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন কিনা সেই প্রশ্নের সদুত্তর দেননি ট্রাম্প। নির্বাচনে জালিয়াতি হতে পারে এমন আশঙ্কাও করেছেন বারবার। দুই প্রার্থীর মুখোমুখী বিতর্কে হয়েছে বিশৃঙ্খলা। আর ভোটের দিন বা পরদিন যা ঘটেছে তা তো মার্কিন ইতিহাসেই নজিরবিহীন ঘটনা। মেইল ভোট বা ডাক যোগে আগাম ভোট বেশি পড়ার কারণে এবার ভোট গণনায় বেশি সময় লেগেছে। বুথে পড়া ভোট গণনা শেষে নির্বাচন কর্মকর্তারা হাত দিয়েছেন মেইল ভোটে। কর্মকর্তারাও প্রতিটি পেপার ব্যালট এক এক করে গুনেছেন স্বচ্ছতার জন্য।

তারপরও সেই গননা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউসের ব্রিফিংরুমে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, জালিয়াতি করে তাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ট্রাম্প বলেন, ‘যদি বৈধভাবে ভোট গণনা হয়, তাহলে আমি সহজেই জিতে যাই।’ তবে অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি তিনি। বলেছেন, ‘অবৈধভাবে ভোট গণনা করা করা হচ্ছে। তারা আমাদের কাছ থেকে নির্বাচন চুরি করার চেষ্টা করতে পারেন।’

ভোটের চূড়ান্ত ফল আসার আগেই ট্রাম্প এমন অভিযোগ তোলেন। কাগজে কলমে ততক্ষণ পর্যন্ত যে কোন প্রার্থীরই জয়ের সম্ভবনা রয়েছে। তবে মার্কিন মিডিয়া জানিয়ে দিয়েছে ব্যাটল গ্রাউন্ডে বাইডেন এগিয়ে আছেন। তাই হয়তো ট্রাম্প আগেই হাল ছেড়ে দিয়ে এসব আপত্তি তুলেছেন।

ব্যটেল গ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর একটি মিশিগানে ভোট গণনা বন্ধে আদালতে মামলাও করেছিল ট্রাম্পের কর্মীরা। তারা চেয়েছিল ভোট গণনা বন্ধ করতে। মিশিগানে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন জিততে যাচ্ছেন এমন আভাস পাওয়ার পরই ট্রাম্পের ক্যাম্পেইন টিম আদালতের দারস্থ হয়। তাদের যুক্তি ছিল ভোট গোনার সময় রিপাবলিকানদের প্রতিনিধি রাখা হয়নি। যদিও আদালতে তাদের সেই দাবি টেকেনি। বিচারক বলেছেন, ভোট গণনা প্রায় শেষ, এখন আর স্থগিত করার সময় নেই। শেষ পর্যন্ত মিশিগানে জো বাইডেনই জয় পেয়েছেন। এই কাÐকে ট্রাম্প শিবিরের ছেলেমানুষি হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন মিশিগানের প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা। এমন ছেলেমানুষি অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন নয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনেও তিনি জাল ভোট, ভোট জালিয়াতি ইত্যাদির অভিযোগ তুলেছিলেন।

এখানেই থামেনি মার্কিন নির্বাচনের এবারের কান্ড-কারখানা। নির্বাচনের পর দেশটিতে বেশ কিছু জায়গায় সহিংসতাও হয়েছে। নিউ ইয়র্কে ‘প্রতিটি ভোট গুণতে হবে’ দাবি নিয়ে একটি নির্বাচনী শোভাযাত্রা থেকে সহিংসতা শুরু হয়। এখান থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে অন্তত ২৫ জনকে। বিক্ষোভ হয়েছে শিকাগো আর ফিলাডেলফিয়াতেও। অ্যারিজোনায় ভোট গণনা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা। পোর্টল্যান্ড,ওরেগনে প্রতিটি ভোট গণনার দাবিতে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠলে মোতায়েন করা হয় ন্যাশনাল গার্ড। এছাড়া নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনেও বিক্ষোভ থেকে সহিংসতা হয়েছে।

ট্রাম্পের পক্ষের ভোট গণনা করা হবে না- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে অ্যারিজোনার মেরিকোপা এলাকার একটি ভোটকেন্দ্রের ভেতর ঢুকে পড়ে রিপাবলিকান সমর্থকরা। পুলিশের সহায়তায় তাদের বের করা হয়। পোর্টল্যান্ডে বিক্ষোভ থেকে দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। পুলিশ যে ঘটনাকে দাঙ্গা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে।

এসব বিক্ষোভ করেছে উভয় পক্ষের সমর্থকরাই। ট্রাম্পের সমর্থকরা বিক্ষোভ করেছেন তাদের হারিয়ে দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগে। অন্য দিকে জো বাইডেনের সমর্থকরা বিক্ষোভ করেছেন ট্রাম্প শিবিরের ভোট গণনা বন্ধের উদ্ভট দাবির বিরুদ্ধে। আলজাজিরা জানিয়েছে মিশিগানে দুই পক্ষের সমর্থকরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে পুলিশ তাদের নিবৃত করেছে। সড়কে বিক্ষোভ থেকে মিনিয়াপোলিসে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।

এবারের এসব বিতর্কিত ঘটনাই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে আগের যে কোন নির্বাচনের চেয়ে আলাদা হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে দেবে। প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচন নিয়ে এমন সব আপত্তিকর ঘটনা সত্যিই অবাক করার মতো। আর এতে বিশ^ব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজ নষ্ট হয়েছে তাতেও কোন সন্দেহ নেই। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন অনলাইনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এ বছরের মার্কিন নির্বাচন নিয়ে দৃষ্টিকটু বিতর্ক ও কুৎসিত প্রচারণা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে দেশের বাইরে তার অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উপরন্তু এ নির্বাচনকে প্রকাশ্যে অবৈধভাবে উপস্থাপনের মার্কিন নেতাদের যে চেষ্টা, তা আহত করেছে অনেককে। ট্রাম্পের বিরূপ মন্তব্যগুলো অনেক দেশই ভালোভাবে নেয়নি।

নির্বাচন, ভোটের ফল, ভোট গণনা নিয়ে এই যে দুই দলের মধ্যে বিভক্তি তার বাইরে আরো ভয়াবহ এক চিত্র উঠে এসেছে এবারের মার্কিন নির্বাচনে। মার্কিন সমাজ ব্যবস্থার স্পষ্ট বিভক্তি ফুটে উঠেছে। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন মানেই ভোটারদের কাছে ছিলো প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি আর নীতির বিষয়টি মাথায় রেখে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া। কিন্তু এবার মার্কিন সমাজে অন্য দিকটি ফুটে উঠেছে। এখানে বিভক্তি আছে শহর ও গ্রামের মাঝে, বিভক্তি আছে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মাঝে। বিভক্তি আছে শে^তাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ-হিস্পানিক পরিচয়ের মাঝেও।

গ্রামাঞ্চলের ভোটাররা ঝুঁকেছেন ট্রাম্পের দিকেই। গত নির্বাচনে তার আমেরিকা ফার্স্টনীতিতে আকৃষ্ট হয়েই তারা ট্রাম্পমুখী হয়। এবারো তারা অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা পেতেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। আর শহর এলাকায় ডেমোক্র্যাটদের ভোট ব্যাংক অক্ষত রয়েছে। উপশহর এলাকাগুলো এবার ঝুকেছে বাইডেনের দিকে।

২০১৬ সালে শ্বেতাঙ্গ তরুণ প্রজন্ম ঝুঁকেছিল ট্রাম্পের দিকে। চাকরি শিক্ষা আর অর্থনৈতিক নিশ্চয়তায় তারা ট্রাম্পমুখী এবারো। এই বলয়ে খুব একটা প্রবেশ করতে পারেনি ডেমোক্র্যাটরা। পাশাপাশি ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী মানসিকতাও এর একটি বড় কারণ। তরুণ ছাড়াও অন্য যে কোনো বয়সী শ্বেতাঙ্গরাই ট্রাম্পকে সমর্থন দিচ্ছেন। অভিবাসনবিরোধী, ইসলামফোবিকরাও যে ট্রাম্পকে জেতাতে মরিয়া হয়েছিলেন সেটিও বলা অপেক্ষা রাখে না।

অন্য দিকে এশিয়, আফ্রিকান কিংবা হিস্পানিকরা জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন বুঝিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে কালোরা কতটা নিগৃহীত। গত চার বছরে দেশটিতে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ, অভিবাসী-আমেরিকান এসব বিভক্তি চরম আকার ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র জুড়েঅর্থনৈতিক ও বর্ণভিত্তিক বিভক্তির একটি বড় উদাহরণ তাই থাকবে এবারের নির্বাচন। আর সেটি যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্যই অশনী সঙ্কেতও। এই বিভক্তি ক্রমশই বাড়বে ছাড়া কমবে না।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার জাতীয়বাদী রাজনীতি দিয়ে মার্কিন সমাজে যে বিভক্তির বীজ বুনে দিয়ে গেছেন তার জন্য বিশ্ব মোড়ল হয়ে থাকা দেশটিকে হয়তো অনেক বড় মাশুল দিতে হবে। ২০১৬ সালে ট্রাম্পের নির্বচনে জেতাটাই ছিলো বিভক্তির গান শুনিয়ে। সেটি দেশের বাইরে যেমন চীন আর ইরানকে রুখে দেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে। দেশে তেমন দরিদ্রদের স্বচ্ছলতার, বেকারদের কর্মসংস্থানের আর সাদাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রলোভন দেখিয়ে। চার বছর আগের সেই বীজই এবারের নির্বাচনে চারা গাছ হয়ে বেড়ে উঠেছে। আর ভবিষ্যতে যে সেটি মহীরূহ হয়ে উঠবে না সেই গ্যারান্টি কে দেবে?

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে