একুশ শতকের গোড়ার দিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রে, চীনে এবং বলকান অঞ্চলে যেসব ঘটনা ঘটে যায়, বিশ্ব মিডিয়ায় তা এক শব্দে 'কালার রেভুল্যুশন' বা রঙিন বিপ্লব নামে অভিহিত হতে থাকে। রাশিয়াকে বাদ দিলে কিরগিজস্তানে সংঘটিত রঙিন বিপ্লবের সবচাইতে বেশি প্রভাব পড়েছে যে দেশটির ওপর, সেটি হলো চীন। কারণ চীনের বিরুদ্ধে মধ্এশিয়ার দেশগুলোকে ব্যবহারের চেষ্টা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। আজ আমরা জানাবো চীনের সীমান্ত ঘেষা কিরঘিজস্তানের আন্দোলনের প্রভাবের নানা দিক।
চীনের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জিনজিয়াং প্রদেশের সাথে কিরগিজস্তানের রয়েছে এক হাজার ৬৩ কিলোমিটার দীর্ঘ জটিল সীমান্ত। এই দীর্ঘ সীমান্ত পথে রয়েছে সারি সারি পর্বতমালা আর আছে দু'টি বর্ডার ক্রসিং। কিরগিজস্তান দেশটির স্থিতিশীলতা চীনের কাছে অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
সাবেক সোভিয়েত আমলে কিরগিজস্তানের ছোট্ট উইঘুর সম্প্রদায়টিকে অনেকাংশেই রুশভাষী জনগোষ্ঠীর সাথে একীভূত করে ফেলা হয়। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। এ সময় চীনের জিনজিয়াং থেকে দলে দলে পালিয়ে এসে কিরগিজস্তানে আশ্রয় নেয় অনেক উইঘুর মুসলিম।
কিরগিজস্তানের সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায় হচ্ছে এককালের বিশাল উইঘুর সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশ। অষ্টম শতাব্দীতে কাস্পিয়ান সমুদ্র থেকে মাঞ্চুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এ সাম্রাজ্য। আজকে যারা কিরগিজ নামে পরিচিত, সেই উপজাতিদের দ্বারা পরাজিত হয়ে উইঘুরদের বেশিরভাগই চীনে অভিবাসী হয়, আর কিছু থেকে যায় ফারগানা উপত্যকায়।
উইঘুর জনগোষ্ঠীর প্রতি কোনোরকম সহানুভূতি না-দেখানো এবং উইঘুর 'বিচ্ছিন্নতাবাদীদের' সাথে কোনোরকম সংযোগ না-রাখার নীতিই অনুসরণ করে চলেছে কিরগিজস্তান নামের 'মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ' দেশটি।
কিরগিজস্তানে উইঘুর অভিবাসীদের কর্মকান্ড চীনের জন্য অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। কেননা এর আগে ওরা কিরগিজ রাজধানী বিশকেকে কয়েক বারই চীনের সরকারি প্রতিনিধিদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে, কিরগিজস্তান সম্ভবত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি গেটওয়ে বা প্রবেশপথ।
কিরগিজস্তানের সাথে সংযোগ না-পাওয়ায় জিনজিয়াং-উজবেকিস্তান রেললাইন নির্মাণের একটি প্রকল্প এখন থমকে আছে। রেলপথটি নির্মিত হলে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের বাণিজ্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। এখনকার চাইতে তখন কমপক্ষে পাঁচ দিন সময় কম লাগবে। এখন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের বাণিজ্য চলে কাজাখস্তানের খরগস দিয়ে।
আফগানিস্তান, ইরান ও তুরস্ক হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত রেললাইন প্রতিষ্ঠার একটি গ্রান্ড আইডিয়া চীনের মাথায় আছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে কিরগিজস্তানও সুযোগ পাবে তার কয়লা, স্বর্ণ, অ্যালুমিনিয়াম, লোহা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ বিশ্ববাজারে নিয়ে যাওয়ার।
কিরঘজিস্তানের দীর্ঘ সময়ের প্রেসিডেন্ট সুরনবায় জিনবেকভের পদত্যাগের পর কিরগিজ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাদির জাপারভ। এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলো চীন। তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ইসিক-কুল এলাকার মানুষ। এলাকাটি তিয়েনশান পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা আর এরই একটি সীমান্ত পথ দিয়ে সহজে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে ঢোকা যায়।
কিরঘিজস্থান ইস্যুতে রাশিয়ার সাথেও চীনের কথা বলতে হয়। কেননা, নতুন কিরগিজ প্রেসিডেন্ট জাপারভ যে অঞ্চলের মানুষ, সেই ইসিক-কুল হ্রদের পশ্চিম প্রান্তে রাশিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটি আছে। সেই সোভিয়েত আমলে সাবমেরিন ও টর্পেডো প্রযুক্তি পরীক্ষার কাজে এটি ব্যবহৃত হতো।
কিন্তু কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকে যখন চীনের সকল সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এবং জাপারভ যখন ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে পুনরুত্থিত হয়ে যতদূর চোখ যায় তার সবকিছুরই অধিপতি হয়ে বসছেন, তখনও চীন নিষিক্রিয় বসে আছে।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তা বিধানে রাশিয়ার সক্ষমতার ওপর ভরসা করেই বসে আছে চীন। তারা মনে হয় দেশটিতে আরেকটি রঙিন বিপ্লবের অপেক্ষায় আছে।
এ ক্ষেত্র মার্কিন দূতাবাসের ভূমিকাও অবাক করার মতো। তারা গত ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে দেশটির গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষের অভিযোগ তুলে ধরে এবং এসব অভিযোগ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আবেদন জানায়। কিরগিজস্তানে তখন সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। আর সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিতে প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মার্কিন সরকারি মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া।
বিক্ষোভকারী জনতা স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী ও অপর কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করলে ৭ অক্টোবর একটি সতর্ক বিবৃতি দেয় বিশকেকের মার্কিন দূতাবাস। এতে বলা হয়, ''কিরগিজস্তানের জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তাদের সরকারের ধরণ কেমন হবে এবং কখন ও কিভাবে তাদের দেশে নির্বাচন হবে। এসব বিষয়ে কিরগিজ জনগণের পাশেই থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।''
বিবৃতির উপসংহার টানা হয় এভাবে, গত ক'দিনের ঘটনা একান্ত কিরগিজস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, বৈদেশিক কিছু নয়। আমরা তাই কিরগিজস্তানের সকল প্রতিবেশী দেশ এবং এ দেশের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রতি আহবান জানাবো যেন তারা দেশটির ইতিহাসের একটি নাজুক সময়ে এমন-কিছু না-করেন, যাতে এ দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়।
মার্কিনীদের সুর যেন ভোজবাজির মতো হঠাৎ পাল্টে গেলো! তবে এরই মাঝে ভয়ঙ্কর যে ঘটনাটি ঘটে গেল তা হলো বিরোধী নেতা সাদর জাপারভের উত্থান। কোনো-কোনো মার্কিন মিডিয়া তাঁকে নিয়ে প্রতিহিংসামূলক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। তারই একটিতে এমনও বলা হলো যে, ক্ষমতাবলয়ে জাপারভ একজন অনধিকার প্রবেশকারী ছাড়া আর কিছু নন।
এরপর মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতিতে, দুঃখ করে বলা হলো, একটি অপরাধী চক্রের তৎপরতায় কিরগিজ জনগণের গণতান্ত্রিক অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে। ওই চক্রটি রাজনীতি ও নির্বাচনকে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিরগিজ জনগণকে নসিহত করে ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, রাজনীতিতে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের প্রভাব ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশবাসী ও তাদের নেতাদের অবশ্যই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অবশ্যই হতে হবে দেশের সংবিধান ও আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখা।
মার্কিন বিবৃতির উপসংহারেও বলা হয়, আমরা কিরগিজস্তানের সকল প্রতিবেশী দেশ এবং এ দেশের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রতি আবারও আহবান জানাবো যেন তারা দেশটির ইতিহাসের একটি নাজুক সময়ে এমন-কিছু না-করেন, যাতে এ দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়। এ সমস্যার সমাধান কোনো রকম সহিংসতা ছাড়াই কিরগিজবাসী নিজেরা-নিজেরা করুক।
যুক্তরাষ্ট্রের এসব নসিহত মুলক বিবৃতির মধ্যে রাশিয়ার দূত দিমিত্রি কোজাক কিরগিজস্তান ঘুরে যান এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছ থেকে আনা কিছু বার্তাও দিয়ে যান। এভাবে রাশিয়া দ্বিতীয় বারে মতো কিরগিজস্তানে একটি রঙিন বিপ্লবের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেয়। ১৫ বছর আগে এ দেশেই ঘটেছিল 'টিউলিপ বিপ্লব'।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর মধ্য এশিয়া সফরের পরই রঙিন বিপ্লবের প্রতি মার্কিনীদের সবুজ সঙ্কেত পাওয়া যায়। ওই সময় পম্পেও মধ্য এশিয়ার পাঁচ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যেকের সাথে পৃথক বৈঠক করেন। তিনি তাদের বলেন, আসুন, আমরা সবাই চীনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক হই। চীন থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দিই, মানবিক মর্যাদাকে সুরক্ষা দিই, ন্যায়সঙ্গত কাজটিই কেবল করি।
আফগানিস্তান, চীন, ইরান ও রাশিয়ার অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলটি বিশাল গুরুত্ব বহন করে। আমেরিকা বহু কাল থেকেই এ অঞ্চলে রাশিয়া ও চীনের সাথে প্রতিযোগিতা না-করার নীতি অনুসরণ করে আসছে। কিন্তু চীনের সাথে সম্পর্ক পূনঃমূল্যায়নে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি প্রকাশ্য আহবান এবং এসব দেশের ক্রমেই বেশি করে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চুপচাপ বসে থাকতে পারে না।
পম্পেও বুঝতেই পারেননি যে, চীনের সাথে সম্পর্ক পূনঃমূল্যায়নের জন্য তার আহবানে কোনো সাড়াই দেবে না মধ্য এশিয়ার দেশগুলো।
মোটের ওপর, কিরগিজস্তানে আরেকটি রঙিন বিপ্লব ব্যর্থ হওয়াটা মধ্য এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় আঘাত হয়েই এসেছে। ক্রেমলিন যেমন সহজে কিরগিজ রঙিন বিপ্লবকে বেপথু করে দিল, তা এ অঞ্চলের জন্য একটি বিরাট বার্তা।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে