ইরানের কাছে কি হেরে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

আমেরিকা ইরানের ওপর ক্রমাগত চাপ দেয়ার নীতি থেকে সরে আসবে না। আবার ইরানও তেমনই পাল্টা চাপ দিয়েই চলবে। লড়াই চলবে শেয়ানে শেয়ানে - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৫ নভেম্বর ২০২০, ১৫:১৯

ইরানের ওপর থেকে জাতিসংঘ-আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে গত ১৮ অক্টোবর। এই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে একেবারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে, এজন্য জাতিসংঘের কোনো ঘোষণা বা আনুষ্ঠানিক বিবৃতিরও প্রয়োজন হয়নি। এখন থেকে ইরান কোনো আইনগত বাধা ছাড়াই যেকোনো দেশের কাছ থেকে নিজের প্রয়োজনমতো অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনতে এবং যেকোনো দেশের কাছে বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতিতে এর প্রভাব কতটা পড়বে। আর যুক্তরাষ্ট্র বা কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবো।

আমেরিকা অনেক চেষ্টা করেছিল, যাতে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাটি উঠে না-যায়। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দু'টি প্রস্তাব এনে চেষ্টা করেছিল, যাতে ইরানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা যায়। দু'বারই এ প্রস্তাব বাতিল করে দেয় নিরাপত্তা পরিষদ। বলে, এর কোনো আইনী ভিত্তি নেই।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আর কী করেন! বললেন, এ সুযোগে কেউ ইরানের সাথে অস্ত্র কেনা-বেচার চুক্তি করলে তার পরিণাম কিন্তু ভালো হবে না।

এর জবাবে ইরান বলেছে, মি. পম্পেওর কথাতেই প্রমাণ হয় যে, তার দেশের একক নিষেধাজ্ঞা কাজে দেবে কিংবা জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হবে - এ কথা তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন না।

ইরান তার অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম চাহিদার ৮০ ভাগই দেশে উৎপাদন করে থাকে। তাই তাদের এসব আমদানি করতে হয় খুবই কম, বরং তাদের নজর রফতানির দিকেই বেশি।

এ নিয়েও আমেরিকার ভয় কাটে না। তবে ইরান বলেছে তারা আন্তর্জাতিক চুক্তির কাঠামোর মধ্যে থেকেই যা করার করবে। শত্রুরা ভয় পাচ্ছে, কিন্তু ইরান বলছে তারা এমনসব দেশের কাছেই অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করবে, যারা ওসবের 'অপব্যবহার' করবে না, বরং কঠোরভাবে প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করবে।

আরব দেশগুলোর কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি এবং তার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠার দিকে ইঙ্গিত করে ইরান এমনও বলেছে, আমেরিকা যেমন টাকার জন্য সবকিছুই করতে পারে, আমরা তেমন দেশ নই।

ইরানের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রি বিষয়ে রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য দেশকেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এতেই আস্কারা পেয়ে ইসরাইল বলেছে যে, ইরান যাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কিনতে না-পারে, সেই ব্যবস্থা করতে ইসরাইল ''যা যা করা দরকার'' সবই করবে। কিন্তু আসলে কী ইসরাইল কিছু করতে পারবে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুমিকাই বা কী হবে?

এটা আজ পরিষ্কার যে, চীন ও রাশিয়া কিছুতেই ইরানের বিরুদ্ধে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে দেবে না। এখন ইরানের কর্তব্য হলো, সাবধানে পথ চলা। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে আরো দু'টি নিষেধাজ্ঞা এখনও বলবৎ আছে। একটি হলো, ২০২৩ সাল পর্যন্ত মিসাইল বিষয়ক এবং ২০২৫ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা। একটির জন্য আর তিন বছর এবং আরেকটির জন্য আর দুই বছর ধৈর্য ধরলেই সব রকম নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে পারে ইরান।

ইরান তা করছেও। তারা এমন একটি নীতি নিয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশ নেয়নি। তারা একটি বার্তাই দিয়ে চলেছে যে তারা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে কাজ করবে এবং নিজ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাবে, যাতে যে-কোনো আগ্রাসন মোকাবিলা করা যায়। দেশটি এখন এখন তাকিয়ে আছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের বিজয়ের দিকে।

পরমাণু ইস্যু নিয়ে রাশিয়ার সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ইরান। এ ব্যাপারে ইরানের অবস্থান নিয়ে রাশিয়াও সচেতন বলেই মনে হচ্ছে। রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন সরকারের একটি হুমকিকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করলে রাশিয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে আমেরিকা? কিন্তু রাশিয়া এই হুমকি উড়িয়ে দিয়ে বলছে আমরা সামরিক-প্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে ইরানের সাথে একযোগে কাজ করছি, করবো।

রাশিয়ার এ অবস্থান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগের সুযোগ আসলেই আমেরিকার নেই। আজকের বাস্তবতায় এটা স্পষ্ট যে, আমেরিকা ইরান আক্রমণ করলে তাতে রাশিয়ার কোনো লাভ নেই। এ কারণেই তারা ইরানকে এমনভাবে সামরিক প্রযুক্তি দিয়ে এসেছে যে আমেরিকা যদি ইরান আক্রমণ করেও, তাহলে তা হবে বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ।

অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি রফতানি বিষয়ে এখন পর্যন্ত ইরান একটি কথাও বলেনি। তবে এটা ঠিক , এখন সব রকম খাত থেকে রফতানি আয় বাড়ানো প্রয়োজন। মনে করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন, আঞ্চলিক স্ট্র্যাটেজি এবং পররাষ্ট্রনীতির সাথে সঙ্গতি রেখে ইরান যে-কোনো দেশের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করবে; দেশটি হোক মধ্যপ্রাচ্যে, ল্যাটিন আমেরিকায় অথবা আফ্রিকায়।

আন্তর্জাতিক অবরোধের মুখেও ইরান বিগত বছরগুলোতে নিজস্ব অস্ত্রের উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে এবং প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকেও উন্নত করার চেষ্টা করেছে। অবরোধ যেহেতু শেষ হয়েছে অন্য দেশগুলোর কাছেও নিজেদের নির্মিত অস্ত্রগুলো বিক্রিতে ইরানের আর কোনো বাঁধা নেই। এরই মধ্যে গত আগস্টে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো ইরানের কাছ থেকে মিসাইল কেনার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

মার্কিনীরা শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত এ অবরোধকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এর অংশ হিসেবে ১৮টি ইরানী ব্যাংককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এমনকী মানবিক কল্যাণ ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে- এমন ব্যাংকগুলোকেও এ তালিকায় ফেলা হয়েছে। ফলে ইরানের অর্থনৈতিক সঙ্কট সহজে কাটবে না।

ইরান ও চীন ২৫ বছরের মেয়াদে একটি সামরিক প্রতিরক্ষা কৌশল বিষয়ক চুক্তি করতে চাইছে। যেহেতু এ চুক্তির সাথে আন্তর্জাতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় জড়িত, তাই চীন আরো গভীরভাবে চুক্তি বিশ্লেষণ করছে। যদি জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়, তাহলে নতুন মার্কিন প্রশাসনের সাথে চীনের সম্পর্ক আবার উন্নত হয়ে উঠতে পারে। তাই এখনি ইরানের সাথে কোনো বিশেষ সামরিক চুক্তি করে বাইডেন প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক তৈরির সম্ভাবনাকে চীনা সরকার ঝুঁকিতে ফেলতে চাইছে না।

রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে। ২০১৯ সালে মার্কিন গোয়েন্দা দফতরের একটি প্রতিবেদনে ধারনা করা হয় যে, অস্ত্রের অবরোধ শেষ হওয়া মাত্রই ইরান মস্কো থেকে এস-ইউ থার্টি যুদ্ধবিমান, ইয়াক-ওয়ান থার্টি ট্রেইনার্স, টি-নাইনটি ট্যাংক, ব্যাসটন মোবাইল উপক‚লীয় মিসাইল প্রতিরক্ষা সিস্টেম এবং এস-ফোর হান্ড্রেড বিমান প্রতিরক্ষা সিস্টেম ক্রয় করবে।

আগষ্ট মাসের শেষ দিকে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি রাশিয়া সফরে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি টেকনিকাল ফোরাম আর্মি পর্যবেক্ষন করেন এবং রাশিয়ার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন। এ সফরের মধ্যদিয়ে রাশিয়ান অস্ত্রের প্রতি তেহরান প্রশাসনের বাড়তি আগ্রহের বিষয়টি নতুন করে সামনে চলে আসে।

ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে একটি উন্নত সামরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিগত কয়েক বছরে রাশিয়া ও ইরান একসাথে কৌশলগত নানামুখী সহযোগিতার সর্ম্পক গড়ে তুলেছে। এছাড়া সিরিয়ার মতো বেশ কিছু ইস্যুতে রাশিয়া ও ইরান অভিন্ন স্বার্থ নিয়ে কাজ করেছে। ফলে ইরানের বিষয়ে এরই মধ্যে রাশিয়ার প্রশাসনের মাঝে এক ধরনের আস্থা ও সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে রাশিয়া চাইবে ইরানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যাতে ভালোর দিকে যায়। তেল রফতানি বাড়ানোর পাশাপাশি সমরাস্ত্রসহ অন্য খাত থেকে ইরান রফতানি আয় বাড়াতে পারে সে পথ সুগম করতে মস্কো চেষ্টা করে যাবে বলে ধারনা করা যায়।

তবে একথাও সত্য আমেরিকা ইরানের ওপর ক্রমাগত চাপ দেয়ার নীতি থেকে সরে আসবে না। আবার ইরানও তেমনই পাল্টা চাপ দিয়েই চলবে। লড়াই চলবে শেয়ানে শেয়ানে। এখন কেবল অপেক্ষার পালা।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে