এরদোয়ান-পুতিন বন্ধুত্ব কি ভেঙে যাচ্ছে

পুতিন ও এরদোয়ান দুজনই আর্ন্তজাতিক রাজনীতির বড় খেলোয়াড় - ডিডব্লিউ

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৫ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৫৯

কয়েক বছর আগের কথা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সম্পর্ক তখন গলায় গলায়। একজন অপরজনকে প্রায়- প্রতিদিনই ফোন করেন, আলাপ করেন বিভিন্ন বিষয়ে নিজ দেশের রণকৌশল নিয়ে। তাদের পারস্পরিক আস্থা এক পর্যায়ে এতোটাই কাছাকাছি পৌঁছে যায় যে পুতিন অনেক 'বিশেষ খবর'ও এরদোয়ানকে দিতে থাকেন। এরকম একটি সময়ে, বছর-দুই আগে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এরদোয়ান কোনো রাখঢাক না-রেখেই বলেছিলেন, ''রাশিয়া অবশ্যই আমাদের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। কিন্তু দুই নেতার এই বন্ধুত্বের সর্ম্পকে এখন কী চিড় ধরতে যাচ্ছে? আর্মেনিয়া, লিবিয়া ও সিরিয়া প্রশ্নে দুদেশের দূরত্ব বাড়ছে। তুরস্ক ও রাশিয়া সর্ম্পক এখন কোন পর্যায়ে?

রাশিয়া কেন তুরস্কের স্টাটেজিক পার্টানার তার বর্ননা দিতে গিয়ে বছর দুয়েক আগে এরদোয়ান বলেছিলেন, দুদেশের মধ্যে পাইপলাইন থেকে শুরু করে পারমাণবিক চুল্লি­ পর্যন্ত অনেক কিছুতেই যৌথ বিনিয়োগ আছে। প্রতিরক্ষা শিল্পে দুদেশের যৌথ উদ্যোগ আছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও পর্যটন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এগিয়ে চলেছে সম্পর্কের অন্যান্য দিকও।

তুরস্ক ও রাশিয়ার এমন বন্ধুত্ব একেবারেই অস্বাভাবিক নয় । যুগ-যুগ ধরে দেখা গেছে, এ দু' দেশ বিভিন্ন ইস্যুতে ''একমত হয়েছে অথবা দ্বিমত পোষণ করেছে''। তা সত্ত্বেও পুতিন-এরদোয়ান এমন সম্পর্ককে 'অস্বাভাবিক'ই মনে করেছেন পর্যবেক্ষকরা। বিশেষ করে ২০১৫ সালে তুরস্ক যখন রাশিয়ার একটি জেট বিমানকে গুলী করে ভূপাতিত করে। ওই সময় দুই দেশের দুই নেতা তো পারলে একে অপরের গলায় ছুরি চালিয়ে দেন।

পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে তুরস্কে সংঘটিত হয় এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান। তখনই পাশ্চাত্য জগত সম্বন্ধে মোহমুক্তি ঘটে এরদোয়ানের। তিনি নিশ্চিত হন যে, ওই অভ্যুত্থানকারীদের পেছনে কয়েকটি পশ্চিমা দেশেরও মদদ ছিল। এরপর থেকে আরো স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি চর্চায় মনোযোগি হন এরদোয়ান। এ যাত্রায় সিরিয়াসঙ্কটে তুরস্ক ও রাশিয়ার স্বার্থ একবিন্দুতে এসে মিলে যায়। সিরিয়ান কুর্দিদের সমর্থনে সেদেশে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে জোট বাঁধে দু' দেশ। মস্কো চাচ্ছে সিরিয়ার আসাদ সরকারকে বাঁচাতে আর তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন মদদপুষ্ট কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে দলটিকে তুরস্ক তাদের সীমান্তে একটি হুমকি বলেই মনে করে। তাছাড়া তুরস্ক এটাও নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিরোধীদের জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই শরণার্থী সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে এবং উত্তর সীমান্ত বরাবর একটি ''পিকেকে রাষ্ট্র'' প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে তুরস্কের দরকার একটি নতুন কৌশল।

এমন অবস্থায় রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে বন্ধুত্ব ভালোই উপভোগ করছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তিনি দেখছেন, রুশীরা মার্কিনীদের মতো নয়। রুশ নেতা কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করেন। তিনি তুরস্কের কাছে বিতর্কিত এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম বিক্রি থেকে শুরু করে পাইপলাইনে বিনিয়োগ পর্যন্ত সব বিষয়ে দেয়া কথা রেখেছেন।

অতি সম্প্রতি এসে এ চমৎকার দৃশ্যপট কেমন পাল্টে গেল! বিশ্বাস করার মতো না-হলেও সত্য, উত্তর আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ককেসাসের তিনটি পৃথক দেশে আঞ্চলিক সংঘাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে তুরস্ক। ওসব দেশে তুরস্কের সশস্ত্র ড্রোনগুলো ধ্বংস করছে রাশিয়ার নির্মিত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। তিন দেশেই রাশিয়ান প্রযুক্তিকে যেন হাস্যকর বানিয়ে ফেলেছে তুরস্ক, হামলার ভিডিও ফুটেজ দেখে অন্তত তেমনই মনে হচ্ছে। এমন অবস্থায় ভাঙ্গন ধরেছে পুতিন-এরদোয়ান বন্ধুত্বে আর তার ফলে রাশিয়া ও তুরস্ক দাঁড়িয়েছে একে অপরের মুখোমুখি।

দুই নেতার সম্পর্কে প্রথম ফাটলটি দেখা যায় গত জানুয়ারি মাসে, যখন লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে মস্কোতে এক শীর্ষ সম্মেলন চলছিল। ওখানে পুতিন লিবিয়ায় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ব্যর্থ হন। লিবিয়ার জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকার যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলেও জঙ্গি নেতা খলিফা হাফতার গোঁয়ারের মতো সম্মেলন ত্যাগ করে চলে যান। এরপরও লিবিয়ায় নিজের উপস্থিতি বজায় রাখার স্বার্থে রাশিয়া তাঁকেই সমর্থন দিয়ে যেতে থাকে।

জঙ্গি নেতা হাফতারের প্রতি রাশিয়ার এমন প্রীতিকে সহজভাবে নিতে পারে না তুরস্ক। এরদোয়ান পরে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে মিডিয়াকে বলেন, ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহ করে রাশিয়াই আসলে হাফতার বাহিনীকে টিকিয়ে রেখেছে। এ বছরের গোড়ার দিকে সরকারি বাহিনী যখন ত্রিপলির ওপর হাফতার বাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছিল, পুতিন তখন তেলসমৃদ্ধ সির্তে-র ওপর বিদ্রোহীদের দখল বজায় রাখতে সেখানে আরো যুদ্ধবিমান মোতায়েন এবং সিরিয়ান ভাড়াটে সৈন্য পাঠাতে ব্যস্ত ছিলেন।

এরপরও দু' নেতার সম্পর্ক যেমন হোক একরকম ছিল। কিন্তু পরের মাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে এসে তা যেন একেবারে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। এ সময় সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ তুঙ্গে ওঠে। সরকারি বাহিনী ও তাদের রুশ মদদদাতারা বিরোধীদের শেষ অবস্থানস্থল ইদলিবে নড়বড়ে যুদ্ধবিরতি অমান্য করে। তারও আগে পুতিন উপলব্ধি করেন যে, সিরিয়ায় তাঁর যা পাওয়ার তা গত বছরই পেয়ে গেছেন। এরদোয়ানের সাথে তিনি যে অঙ্গীকার করেছিলেন তার মেয়াদও গত বছর অক্টোবরে কার্যত শেষ হয়ে গেছে, যখন সিরিয়ান কুর্দি মিলিশিয়াদের উৎখাতে তুরস্ক অভিযান চালায়।

এদিকে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে ওই এলাকাটি কার্যত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আর তুরস্ক হারায় রাশিয়াকে দিয়ে উদ্দেশ্য সাধনের উপায়। রাশিয়া দেখে, আমেরিকার উপস্থিতিকে ব্যালান্স করার জন্যই তুরস্ককে প্রয়োজন ছিল। এখন আমেরিকা নেই, তাই তুরস্কেরও আর প্রয়োজন নেই রাশিয়ার।

এবার ইদলিবে বসে ঘটনার গোড়ায় তাপ দিতে থাকে রাশিয়া। তারা আরো কিছু এলাকা দখল এবং শেষ আশ্রয়স্থল থেকে বিরোধীদের উৎখাতের লক্ষ্যে মাঝে মাঝে হামলা চালাতে থাকে। গত মার্চ মাসে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও রুশ বাহিনী যখন ইদলিবে প্রচন্ড আক্রমণ চালায়, তুরস্ক তখন তার অবজারভেশন পোস্টগুলোতে জনবল বাড়াতে থাকে।

যুদ্ধ যখন তুঙ্গে পৌঁছে, এরদোয়ান তখন ফোন করেন পুতিনকে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। এরদোয়ান পুতিনকে বলেন যুদ্ধ বন্ধ করতে। কিন্তু পুতিন অনড়। তিনি বলেন যে তাঁর বাহিনী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এ লড়াই চলবে। একইসাথে তিনি তুরস্ককে এই বলে অভিযুক্ত করেন যে, তুরস্ক তো হা'ইয়াত তাহরির আল-শামের মতো র‌্যাডিক্যাল গোষ্ঠীগুলোকে ইদলিব থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি! জবাবে এরদোয়ান হুমকি দেন যে অধিকৃত এলাকা ফের দখলে নিতে তুরস্ক প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করবে।

এক কথা দু'কথায় এরদোয়ান-পুতিন টেলিফোন আলাপটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কোনো পক্ষই পিছু হটতে নারাজ। এই প্রথমবারের মতো তুরস্কের সাথে এতোটা অনমনীয় মনোভাব দেখালেন পুতিন। শুধু পুতিন নন, ওই সময় তুরস্ক সফররত এক রুশ প্রতিনিধিদলও তুর্কী প্রতিনিধিদলকে বলে উত্তরাঞ্চলীয় আফরিন এলাকা থেকে সরে আসতে।

ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের সংঘাতে তুরস্কের ৫৯ জন সৈন্য প্রাণ হারান। তুরস্ক মনে করে, এসব হামলার মধ্যে কমপক্ষে একটি বিমান হামলায় রাশিয়ানরা সরাসরি জড়িত, যাতে কয়েক ডজন তুর্কী সৈন্য নিহত হয়েছে।

এতকিছুর পরও এরদোয়ান আপন নীতিতে অনড়। তবে তুরস্কে কোভিড-১৯মহামারী ছড়িয়ে পড়ায় সৃষ্ট উদ্বেগের মুখে পাল্টা আক্রমণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এরদোয়ান। তিনি অনুভব করেন, তুরস্কের মানবিক সঙ্কট কিংবা শরণার্থীর ঢল, কিছুকেই পাত্তা দেন না পুতিন। তিনি এখন আমেরিকার মাঠে।

এ পরিস্থিতিতে এরদোয়ান ও পুতিনের মধ্যে কথাবার্তাই এক রকম বন্ধ হয়ে গেছে বলা যায়। উভয় দেশের কূটনীতিকদের মাঝেও কোনো ঐকমত্য হচ্ছে না। এক বিষয়ে একমত তো আরেক বিষয় এসে সেটা ভেঙে দিল।

তবে সিরিয়া ও লিবিয়ায় এরদোয়ানের অ্যাডভেঞ্চারিজম তুরস্কের সামরিক বাহিনীকে এমন এক দক্ষতা দিয়েছে, যা আগে তাদের ছিল না। সিরিয়া ও লিবিয়ার রণক্ষেত্রে তারা শিখেছে সাঁজোয়া ড্রোন পরিচালনাসহ অনেক রণকৌশল, যা তাদেরকে একেবারে বদলে দিয়েছে।

এ অভিজ্ঞতাই তাদের সাহস দিয়েছে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধে সরাসরি জড়িত হওয়ার। আজারবাইজান সাহায্য চাওয়ামাত্রই বিনাবাক্যব্যয়ে রাজি হয়েছেন এরদোয়ান। বহির্বিশ্বে তুরস্কের স্বার্থের বিরুদ্ধে পুতিনের অবস্থান ক্ষুব্ধ করেছে এরদোয়ানকে। তার সাথে পুতিনের একসময়ের প্রগাঢ় বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে। এরদোয়ান এখন নতুন পথ খুঁজে বের করার চেষ্টায় আছেন। সফল হবেন কি না, সেটা আগামী দিনই বলে দেবে।

পুতিন ও এরদোয়ান দুজনই আর্ন্তজাতিক রাজনীতির বড় খেলোয়াড়। নিজ দেশের স্বার্থে তাদের মধ্যে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। আবার তৈরি হয় দূরত্ব। এই সর্ম্পক একেবারেই ভেঙে যাবে এমন নয়। আর্ন্তজাতিক ঘটনাবলিই তাদেরকে আবার কাছাকাছি আনতে পারে। দুজনেই জানেন কখন কাকে দরকার হবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে