লাইফ সাপোর্টে আমেরিকার প্রেস্টিজ

ট্রাম্পের অ্যান্টি-চায়না টিম মনে হয় ইকনমিক ল অব ডিসঅ্যাডভান্টেজ তত্ত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৮ অক্টোবর ২০২০, ১৬:৩৪

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জাতিসংঘের হীরক জয়ন্তী বা ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। পৃথিবীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এ উপলক্ষকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ চত্বরে নিশ্চয়ই বসে যেত বিশ্বনেতাদের মিলনমেলা। কিন্তু কোভিড-১৯এর উদ্যত থাবার মুখে যেহেতু সবকিছুই একরকম অচল, তাই কোনো উপলক্ষেই ঘর থেকে বের হওয়া সমীচীন মনে করেননি তাঁরা, তার পরিবর্তে ভিডিও ফিডের সাহায্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন।

অবশ্যম্ভাবীভাবে ভাষণ দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। সবাইকে বিস্মিত করে তিনি বক্তব্য দেন মাত্র সাড়ে সাত মিনিট। পর্যবেক্ষকরা বলেন, এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যকেও সামারাইজ বা সারসংক্ষেপ করা যায় কেবল তিনটি শব্দে : 'চায়না, চায়না, চায়না'। ওই ভাষণে কোভিড-১৯এর কথা শুরুতে চেপে রেখে পরে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য চীনকে দোষারোপ করেন ট্রাম্প।

করোনা অতিমারীকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার বিরাট সাফল্যের জন্য নিজেকেও অভিনন্দিত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, ট্রাম্পের দেশে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা চার ভাগের কিছু বেশি লোক আর বিশ্বের মোট কোভিড-আক্রান্তের ২০ ভাগেরও বেশি আমেরিকাতেই।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং তাঁর ভাষণে জানান, চীন কোভিড-১৯এর কয়েকটি টিকা উদ্ভাবন করেছে এবং সেগুলো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এগুলো সফল হলে তা বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।

সি আরো বলেন, ''কোভিড-১৯ই মানবজাতির শেষ সঙ্কট নয়। কাজেই আরো সঙ্কট মোকাবিলার জন্য আমাদের সবাইকে হাতে হাত রেখে তৈরি থাকতে হবে।'' মোটের ওপর সি বোঝাতে চেয়েছেন যে চীন নিজেকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের একজন সদস্য বলেই বিবেচনা করে এবং জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে থেকে সকলকে সহযোগিতা করতে চায়। পক্ষান্তরে ট্রাম্পের আমেরিকা চায় তারা একলা চলবে এবং অন্য দেশগুলো তাদের পেছন পেছন চলবে। আর জাতিসংঘও ট্রাম্প সাহেব যখন যা চাইবেন তখন তা-ই করবে।

এদিকে আগামী নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য ওতে লড়ছেন ট্রাম্পও। এ জন্য তার দরকার যে-কোনো উপায়ে চীনের মতো একটি দেশকে দেশবাসীর সামনে শত্রুরূপে উপস্থাপন করা।

ট্রাম্পের অ্যান্টি-চায়না টিম মনে হয় ইকনমিক ল অব ডিসঅ্যাডভান্টেজ তত্ত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এর সরল বাংলা মানে দাঁড়ায়, আমার নাক কাটা গেলে যাক, তোমার যাত্রা তো ভঙ্গ হলো! আমেরিকার ক্ষতি হয় হোক, চীনের আরো বেশি ক্ষতি হলেই হলো। 'পারস্পরিক ক্ষতির' এ ভাবধারা এখন আমেরিকানদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

চীন থেকে পণ্য আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা চাপিয়েছিলেন ট্রাম্প, সেটা বুমেরাং হয়েছে। চীনের সাথে বাণিজ্য বৈষম্য তো কমেইনি বরং তাদের পক্ষে গেছে। ল অব কম্প্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজ তত্ত্ব অনুযায়ী এটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। কেননা দেশটি অনেক কম খরচে পণ্য প্রস্তুত করতে এবং অধিক পরিমাণে বিক্রি করতে সক্ষম। আর তাই চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধে ইতিমধ্যে চীনকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে ব্লুমবারগ বিজনেসউইক।

এদিকে বার্তাসংস্থা রয়টার্স খবর দিয়েছে, চীনের সাথে বেআইনী বাণিজ্যযুদ্ধে জড়ানোর দায়ে সাড়ে তিন হাজার মার্কিন কম্পানি ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিয়েছে বা মামলা ঠুকে দিয়েছে। তারা মনে করছে, অনেক হয়েছে, আর নয়।

অপরদিকে চীন কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমারীকে ভালোমতোই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোদমে শুরু করে দিয়েছে। বিপরীতে এ অতিমারীকে কব্জা করতে পারেনি আমেরিকা, যার চড়া দাম দিতে হচ্ছে তার অর্থনীতিকে। এ অবস্থা চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত, এমনকি তার পরেও চলবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, চীনে চারদিক থেকে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আসছে। কেননা, বিনিয়োগকারীরা অনুভব করছেন যে, বিশ্বের সবচাইতে প্রসারমান ভোক্তা অর্থনীতি থেকে দূরে থাকা তাদের উচিত হবে না।

এমন এক অবস্থায় আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এখন পর্যন্ত পাওয়া জনমত জরিপের ফলাফলে মনে করা হচ্ছে, হোয়াইট হাউসে ঢোকার দৌড়ে সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনই এগিয়ে আছেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিজয়ী হলে বাইডেনের উচিত হবে চীনের সাথে সংঘাত শূন্যে নামিয়ে আনা এবং সহযোগিতা জোরদার করা। কেননা, চীনের সাথে পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক রক্ষার ওপরই নির্ভর করছে আমেরিকার অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো।

তবে চীনের সাথে সংঘাত শূন্যে নামিয়ে আনা এবং সহযোগিতা জোরদার করার কথা যত সহজে বলা হচ্ছে, বাস্তবে তা হবে ততোটাই কঠিন। এটি হবে বাইডেন প্রশাসনের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের একটি। কারণ, বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তাঁর দেশের সাথে বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে অনেক দেশের সম্পর্কে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেছেন। যে জঞ্জাল তিনি রেখে যাবেন তা সরিয়ে আমেরিকাকে আবার বিশ্বাসযোগ্য বিশ্বনেতার আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন হবে আসুরিক শক্তির।

পম্পেওর সৃষ্ট জঞ্জালের একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায় অস্ট্রেলিয়ার কথা। পম্পেও অস্ট্রেলিয়াকে চাপ দিতে থাকেন চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকা যে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছে, অস্ট্রেলিয়াও যেন তা বলতে থাকে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে এমন চাপের মুখে মাথা নত করাটা রীতিমতো দুরূহই ছিল। কেননা, চীন হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে বড় ক্রেতা এবং তাদের অর্থনীতির সবচাইতে বড় কন্ট্রিবিউটর। চীনকে চটিয়ে অস্ট্রেলিয়া কেন নিজের কবর খুঁড়তে গেল, তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের বিস্ময়ের শেষ নেই।

কানাডাকেও একই অবস্থায় নিক্ষেপ করেছেন পম্পেও। তবে নিজের হাতে নিজের গলা কাটতে অতোটা উৎসাহী নয় কানাডা। কিন্তু বিশাল ও শক্তিশালী প্রতিবেশী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এড়ানোও কানাডার পক্ষে অনেকটা অসম্ভব।

চীনা কম্পানি হুয়াওয়ের দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অকারণে গ্রেফতারও ক্ষুব্ধ করেছে চীনকে। হুয়াওয়ের ফাইভ-জি প্রযুক্তি প্রত্যাখান করতেও অনেক দেশকে প্রায়-বাধ্য করেছেন পম্পেও। তাঁর যুক্তি, চীনের এ কম্পানি যে-কোনো দেশের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি।

বলা প্রয়োজন যে, অনেক দেশই এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই হুয়াওয়ের ৩জি ও ৪জি প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এসব বাদ দিয়ে এরিকসন বা নকিয়ার প্রযুক্তি গ্রহণ অনেক সময় ও অর্থ ব্যয়ের ব্যাপার। ব্রিটেনের কথাই ধরা যাক। হুয়াওয়ের সমস্ত স্থাপনা অপসারণ করতে তাদের ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। নতুন করে ফাইভ-জি বসাতে সময় লাগবে আরো তিন বছর। অর্থব্যয় হবে ১৮ বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি। এমন এক হ-য-ব-র-ল অবস্থায় ব্রিটেন অপেক্ষায় আছে নভেম্বরে হোয়াইট হাউসে কারা আসেন তা দেখার। অবশ্য শুধু ব্রিটেন নয়, এমন অপেক্ষায় আছে আরো অনেক দেশ। যেমন, কানাডার কম্পানিগুলো হুয়াওয়ের কাছ থেকে সরে আসার বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে ১০০ কোটি কানাডিয়ান ডলার ক্ষতিপূরণ চাইবে।

পম্পেওর সর্বশেষ বায়না হলো, ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষরদাতা দেশগুলো যেন চুক্তির শর্ত মোতাবেক ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করে। পম্পেওর আবদার শুনে কেবল হেসেছে রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো। বলেছে, এটা তো আপনার বলার বিষয় না। আপনাদের প্রেসিডেন্ট তো অনেক আগেই এ চুক্তি থেকে সরে গেছেন।

মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে রাশিয়া ও চীনকে হুমকি দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও যেন দেশ-দু'টিকে অনেক কাছাকাছি এনে দিয়েছেন। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার এক দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করেছে চীন। সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যৌথভাবে কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে কাজ করতেও সম্মত হয়েছে উভয় দেশ। চীনকে একটি অ্যান্টি-মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম স্থাপনেরও প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া।

ভারতের একজন বিশিষ্ট কূটনীতিক ও লেখক এম কে ভদ্রকুমারের পর্যবেক্ষণ এ ক্ষেত্রে উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এককভাবে চীন ও রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করতে, যা আন্তর্জাতিক আইনে সমর্থনযোগ্য নয়। তারা অন্য দেশগুলোকেও তাদের অনুসরণ করতে চাপ দিচ্ছে।

এমন অবস্থায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বাইডেন যদি জয়ী হন, তাঁর সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে আমেরিকাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া, যেখানে আমেরিকার যোগ্য স্থান এবং যেখানে গেলে আমেরিকা আবার বিশ্বের আস্থা ও সম্মান ফিরে পাবে।

বিশ্ব এখন সেদিকেই পরম আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আগামী নভেম্বরেই স্থির হয়ে যাবে পরবর্তী চার বছর কারা বিশ্বের একক পরাশক্তির ক্ষমতাকেন্দ্রে থাকবে এবং তারা বাকি পৃথিবীর সাথেই বা কেমন আচরণ করবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে