ইরান নয়, টার্গেট তুরস্ক

এরদোয়ান নিজেকে একজন জনপ্রিয় আঞ্চলিক নেতা হিসাবে হাজির করেছেন - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০১ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৩৩

সংযুক্ত আরব আমীরাতের পর এবার আরেকটি ছোট আরব দেশ, বাহরাইন, ঘোষণা দিল ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার। এর আগে আরবদের অবস্থান ছিল, আগে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হোক, তারপর ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি দেখা যাবে। সেই অচলায়তন ভেঙে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি' রীতিমতো ধাঁধায় ফেলে দেয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। তারা নিজেদেরই প্রশ্ন করতে থাকেন, যে চুক্তি প্যালেস্টাইনীরা বয়কট করেছে, আরব দেশগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে এবং যে চুক্তি কখনোই কাজে দেবে না, তা নিয়ে এত শ্রম ও সময় ব্যয় করছেন কেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট? এই প্রশ্নের জবাব খুজে দেখেছেন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিখ্যাত সাংবাদিক ও মিডল ইস্ট আইয়ের সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট। আসুন জেনে আসি সেই অজানা কারন।

ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আমীরাতী ঘোষণায়ও অনেক প্রশ্নের যথাযোগ্য জবাব মেলেনি। অন্য আরব দেশগুলোকেও এ কাজে যুক্ত করতে রীতিমতো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর জামাতা জারেড কুশনার। তার ফল মিলেছে বাহরাইনের ঘোষণায়। আরো দু'টি ছোট দেশ, কসোভো ও সার্বিয়াও ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে পারে। তবে বড় ও জনবহুল দেশগুলো এ প্রক্রিয়ায় শামিল হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এতে সমর্থন মেলেনি সউদি আরব, সুদান, ওমান, কুয়েত বা জর্দানেরও।

এ অবস্থায় হোয়াইট হাউসে এক অনুষ্ঠানে দু'টি ছোট আরব দেশের নেতাদের সাথেই কেবল হাত মেলাবেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই অনুষ্ঠানকে বলবেন 'ঐতিহাসিক'।

প্রশ্ন উঠেছে, এ চুক্তির টার্গেট যদি কখনোই প্যালেস্টাইনীরা না হয়, তাহলে কারা? কার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য জোট বেঁধেছে ইসরাইল ও আমিরাত? ইসরাইল বিভিন্ন সময় আরব কূটনীতিকদের বলেছে যে ইরানকে তারা কখনোই সামরিক হুমকি বলে গণ্য করে না। ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর প্রধান ইয়োসি কোহেনও মনে করেন, ইরান 'নিয়ন্ত্রণযোগ্য'।

ইরান নিয়ে নিজেদের তত্ত¡টি বারবার পরীক্ষা করেও দেখেছে ইসরাইল। তারা সিরিয়া ও লেবাননে ইরানী মদদপুষ্ট যোদ্ধাদের ওপর বোমা বর্ষণ করেছে। কিন্তু না ইরান, না হিজবুল্লাহ কেউই এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এতেই ইসরাইল যা বোঝার তা বুঝে গেছে।

ট্রাম্পও একবার ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছিলেন। গত জানুয়ারী মাসে ইরানী জেনারেল কাসেম সুলায়মানী ইরাকে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হলে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। কিন্তু হতে-হতেও হয়নি কোনো সামরিক সংঘাত। বোঝা গেল, টার্গেট ইরান নয়, অন্য কেউ। প্রশ্ন উঠেছে, নতুন জোটের টার্গেট যদি ইরানও না-হয়,তবে কারা?

এ প্রশ্নের জবাব মিলেছে সদ্যসমাপ্ত আরব লীগ বৈঠকে আরব নেতৃবৃন্দের বিবৃতিতে। বলা হয়েছে, সত্যিকার শত্রুটি লুকিয়ে আছে ন্যাটো জোটে। ওই জোটের সদস্য ওই দেশ। আরব বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ ওই দেশটি ইরান নয়, রাশিয়াও নয়, দেশটি হচ্ছে তুরস্ক।
আরব লীগের বৈঠকে অভিযোগটি সরাসরি উত্থাপন করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ। তিনি বলেন, তুরস্ক যেভাবে আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে, তা এ অঞ্চলে নেতিবাচক হস্তক্ষেপের জ্বলন্ত উদাহরণ।

আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বিবৃতির হাস্যকর দিকটি হলো, তিনি এমন একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যে দেশ মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করেছে এবং লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে উৎখাত করার জন্য যাদের বিমান থেকে নিয়মিতই ত্রিপলিতে বোমা ফেলা হচ্ছে।
আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে গলা মেলান মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শৌকরি। তিনি বলেন, বিভিন্ন আরব দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তুরস্কের হস্তক্ষেপ আরব জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় মিশর চুপ করে বসে থাকবে না।
আরব লীগের ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করছিলেন প্যালেস্টাইনী প্রতিনিধি। তারা একটি কড়া বিবৃতি নিয়ে প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন। ওই বিবৃতিতে ইসরাইল-আমিরাত চুক্তিকে 'বিশ্বাসঘাতকতা' বলে অভিহিত করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বৈঠকে বিবৃতিটি গৃহীত হয়নি। তার বদলে সিদ্ধান্ত হয় একটি স্থায়ী সাব-কমিটি গঠনের। ওই সাব-কমিটি তুর্কী 'আগ্রাসন' মনিটর করবে এবং সংস্থার পরবর্তী বৈঠকে তা পেশ করবে।

আরব লীগের বৈঠকের এসব তৎপরতা তুরস্ক সরকারের নজর এড়ায়নি। এ প্রসঙ্গে তুরস্কের একটি সরকারী সূত্রের বক্তব্য হলো, সংযুক্ত আরব আমীরাত তুরস্ককে 'একঘরে' করে ফেলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। তারা এ কাজে অর্থ ঢালছে। এতে সত্যিকার অর্থে লাভবান হবে ইসরাইল এবং ইসরাইলপন্থি লবির সাথে ঘনিষ্ঠ কতিপয় মার্কিন রাজনীতিবিদ। তারা তুরস্কবিরোধী যে কোনো জোট গঠনের সাথে আছে। তারা এ কাজে আমিরাতকে উৎসাহ দিয়ে চলেছে।

মজার ব্যাপার হলো, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরুদ্ধে ২০০২ সালে সউদি আরবের উদ্যোগে আরব লীগের যে সাব-কমিটি গঠিত হয়েছিল সেটি এখনও বহাল আছে, যদিও সেটির আর কোনো কার্যকারিতা নেই। থাকবে কী করে, ইসরাইল তো এখন আর আরব লীগের শত্রু নয়, শত্রু এখন তুরস্ক।

তুরস্ক প্রসঙ্গে আরব দুনিয়ার মনোভাবের পরিচয় মেলে জর্দানের সরকারী পত্রিকা 'জর্দান টাইমস'-এ সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে। এতে বলা হয়, ''লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরাক - এ তিন আরব দেশে তুরস্কের সৈন্য এবং তুর্কী মদদপুষ্ট মিলিশিয়ারা তৎপর রয়েছে। এটা ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা যে আরব বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তা অবশ্যই স্বীকার করতে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব দেশ এবং তার বাইরেও তুরস্কের যে আঞ্চলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকঙ্খা আছে, তা দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও শীর্ষ কর্মকর্তারা মোটেই লুকাচ্ছেন না।''

পত্রিকাটিতে আরো লেখা হয়, ''কাতার, লিবিয়া, সোমালিয়া, উত্তর সাইপ্রাস, সিরিয়া ও ইরাকে এখন তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি আছে। এসব ঘাঁটির সবগুলো যে ওসব দেশের বৈধ সরকারের অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাও নয়।''

এদিকে তুরস্ককে ''পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার নতুন দস্যু'' ঘোষণার একটি অভিনব চেষ্টাও চলছে। এ চেষ্টার সামনের সারিতে আছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ। তাঁর সাফ কথা, তুরস্ক এ অঞ্চলের কেউ নয়। পাশাপাশি আবার এও বলেন যে তিনি তুরস্কের বিরোধী নন, এরদোয়ানের বিরোধী।

এমন কৌশল এর আগেও নেয়া হয়েছিল,কিন্তু কাজে দেয়নি। দেখা গেছে, লিবিয়া, প্যালেস্টাইন, ইরাক, সিরিয়া - যেখানেই এরদোয়ান সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তুরস্কের সামরিক বাহিনী ও প্রধান বিরোধী দলগুলো তাতে সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো অভ্যন্তরীণ নানা ব্যাপারে সরকারের মুখোমুখি অবস্থানে থাকলেও বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে এরদোয়ানকে জাতীয় বীরের সম্মান দিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা ইস্যুতে।

মধ্যপ্রাচ্যে আরব দেশগুলো তুরস্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অথচ আরব বিশ্বে সাধারন মানুষের মাঝে এরদোয়ান নিজেকে একজন জনপ্রিয় আঞ্চলিক নেতা হিসাবে হাজির করেছেন। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বড় ও সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সমর্থন কোনো গোপান বিষয় নয়।

তুরস্কের যে আঞ্চলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকঙ্খা আছে, তা দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও শীর্ষ কর্মকর্তারা মোটেই লুকাচ্ছেন না। ছবি : ইন্টারনেট
তুরস্কের যে আঞ্চলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকঙ্খা আছে, তা দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও শীর্ষ কর্মকর্তারা মোটেই লুকাচ্ছেন না। ছবি : ইন্টারনেট

 

ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজটিও তিনি করে যাচ্ছেন। ফাতাহ ও হামাস উভয় দলের সাথে আছে তুরস্কের যোগাযোগ। কাতারের মাধ্যমে বছরের পর বছর গাজার অবরুদ্ধ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তুরস্ক। আর বাস্তবতা হচ্ছে সোমালিয়া থেকে কাতার পর্যন্ত তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি দৃশ্যমান।

এরদোয়ানের এই বৈদেশিক নীতির প্রতি তুরস্কের ভেতরে রয়েছে জোরালো সমর্থন।
তুর্কী রাজনীতিক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভতুগুলুর উদাহরণ দেয়া যায়।

এরদোয়ানের কট্টর বিরোধী এ মানুষটি সম্প্রতি বলেছেন, ম্যাক্রোঁর উচিত সীমা লঙ্ঘন না-করা এবং তুরস্ক ও তার প্রেসিডেন্টকে অপমান না-করা।

তবে ফরাশি প্রেসিডেন্ট যতোই হম্বিতিম্বি করুন না কেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সংঘাত বাধানোর ক্ষমতা তাদের নেই। কেননা, নিজ দেশেই তার অবস্থা বিশেষ সুবিধার নয়। এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সের সবচাইতে অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যাক্রোঁর উচিত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ফরেইন অ্যাডভেঞ্চার থেকে দূরে থাকা। কিন্তু ইতিহাসেরই একটা বড় শিক্ষা হলো যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ফরাশি প্রেসিডেন্ট কি নেবেন?

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে