মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চীন, সু চিকে সমর্থন

আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে চীন সু চির পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে - নিউইয়র্ক টাইমস

  • মেহেদী হাসান
  • ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:০৫

আগামী নভেম্বরে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে অং সান সু চির পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে চীন। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী নয় বরং চীনের স্বার্থ বেশি রক্ষা করবে বর্তমান ক্ষমতাসীন সু চি সরকার।

মিয়ানমারে দীর্ঘ কয়েক দশক পর্যন্ত চীনা সমর্থনে ক্ষমতায় ছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ে সরাসরি চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে । ফলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর চীন ক্ষুদ্ধ। অপর দিকে চীন একসময় অং সান সুচির বিরুদ্ধে থাকলেও বর্তমানে তাকেই বেছে নিয়েছে। সু চিও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য চীনের কোলে আশ্রয় নিয়েছেন।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি পিং মিয়ানমার সফর করেন। সু চির প্রতি ছিল এটা চীনের প্রাকশ্য জোরালো সমর্থন। অপর দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এমন কিছু নীতি গ্রহন করেছে যা চীনের বিরুদ্ধে যায়। শুধু তাই নয় চীনের শত্রæর বিরুদ্ধেও হাত মিলিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রবণতা ছিলো চীনা বলয় থেকে মিয়ানমারকে বের করে আনা। তারা কিছুটা ভারতের দিকেও অগ্রসর হয়েছে। এমন নীতি চীনকে ক্ষুব্ধ করেছে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন চীনের হাতে মিয়ানমারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার অনেক উপায় আছে।

নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিবেচ্য বিষয় হলো নির্বাচনের পরে মিয়ানমার সরকারের পররাষ্ট্র নীতি কোন দিকে মোড় নেয়। নির্বাচনের পর মিয়ানমার কি চীনের সাথে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট করবে না চীনা বলয় থেকে বের হয়ে স্বাধীন নীতি অবলম্বন করে সেদিকে লক্ষ্য রাখছে।

দীর্ঘ কয়েক দশক পর্যন্ত চীন সরকার মিয়ানমার মিলিটারি জান্তার প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন, প্রায় সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিল। এর বিপরীতে অং সান সু চির প্রতি ছিলো বেইজিং ছিল ঘোরতর সন্দেহ। কিন্তু এই নীতিতে পরিবর্তন আসছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে চীন সু চির পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। চীন চাচ্ছে আগামী নির্বাচনে সু চি এবং তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি জয় লাভ করুক। ২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চির দলের কাছে ভরাডুবি ঘটে সেনাসমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির । আগামী নভেম্বরের নির্বাচনেও সেনা সমর্থিত দলের একই পরিণতি হতে পারে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী বর্তমানে সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে সেনা স্বার্থ সংহত করতে চাইছে। অপর দিকে সু চি চীনঘেষা নীতি গ্রহণ করেছে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য। এ ছাড়া রোহিঙ্গা গণহত্যার পক্ষে জোরালো অবস্থান এবং সমর্থনের কারনে পশ্চিমা আশির্বাদ হারিয়েছেন সু চি। ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য চীনের কোলে আশ্রয় নেয়া ছাড়া তার আর কোনো বিকল্প নেই।

২০১৭ সালের আগস্টের শুরু থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু করে। গণহত্যা থেকে রক্ষা পেতে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য বর্তমানে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে এবং তারা এ গণহত্যা পরিচালনা বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে ।

স্বীকারোক্তিতে তারা জানিয়েছে মিয়ানমার আর্মির নির্দেশনা ছিল অভিযানের সময় রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু, যাকেই সামনে পাওয়া যাবে হত্যা করতে হবে, নারীদের ধর্ষণ করতে হবে এবং বাড়িঘরসহ সব কিছু জ্বালিয়ে দিতে হবে। আর তারা সেটা পালন করেছে।

মানবাধিকারের কথিত চ্যাম্পিয়ন, গণতন্ত্রের তথাকথিক প্রতীক সু চি এ গণহত্যার নিন্দা করতেই শুধু অস্বীকৃতি জানায়নি বরং এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে হেগের আদালতে বক্তব্য দিয়েছে। ফলে অনেক পশ্চিমাদের কাছে প্রিয়ভাজন থেকে সু চি রাতারাতি ভিলেনে পরিণত হয়।

সু চি যেমন মিয়ানমার সেনাবাহিনী আর স্থানীয় বৌদ্ধদের সম্মিলিত গণহত্যার বিষয়ে নীরব তেমনি নীরব ভ‚মিকা পালন করেছে চীন। পশ্চিমা বিশ্বে যখন সু চির বিরুদ্ধে তীব্র সামলোচনায় সরব ঠিক তখন সুচির প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে আসছে চীন।

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে মিয়ানমার সফর করেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি পিং। শি জিন পিংয়ের এ সফরের সময়কালও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে হেগে মিয়ানমার আর্মির পক্ষে সাক্ষ্য দিতে হেগে যান অং সান সু চি। হেগের আদালতে সু চির এ আগমন এবং বক্তব্য নিয়ে পশ্চিমা জগতে তীব্র সমালোচনা চলে। এরপর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি হেগের আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রায় দেয় । রায়ের ঠিক এক সপ্তাহ আগে ১৭ জানুযারি ২ দিনের সফরে মিয়ানমার আসেন চীনা নেতা শি জিন পিং ।

চীনের মত মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সু চির বিষয়ে নিরব অবস্থানে রয়েছে জাপান। গত ২১ থেকে ২৪ আগস্ট জাপানি পররাষ্ট্র মন্ত্রী তোশি মিতসু মিয়ানমার সফর করেন।

মিয়ানমারের ওপর চীনা প্রভাব মোকাবেলায় করোনা দুর্যোগের মধ্যে জাপানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেন। সফরে তিনি সু চি এবং মিয়ানমার সেনা প্রধান মিন অং লাইং এর সাথে সাক্ষাত করেন। সফরের পর জাপানি পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়েল বিবৃতিতে একটি অদ্ভুত বিষয় উঠে এসেছে। এতে বলা হয় জাপানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী তোশি মিতসু এবং মিয়ানমার সেনা প্রধান আঞ্চলিক বিষয় যেমন দক্ষিন চীন সাগর বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বর্তমানে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ এ অঞ্চলের প্রায় সবগুলো দেশের বিরোধ চলছে । এর মধ্যে জাপানও রয়েছে চীনবিরোধী বলয়ে। এ অবস্থায় দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে মিয়ানমারের সাথে জাপানের এ আলোচনা নিয়ে কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে।

জাপানের সাথে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে মিয়ানমার সেনাপ্রধানের এ আলোচনা চীনকে আরো ক্ষুব্ধ করছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে জাপানের সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নীতি কোনো অবস্থাতেই মেনে নেবে না চীন।
অপর দিকে মিয়ানমার সেনা প্রধান মিন অং লাই জুনে মস্কো সফরে গিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে তা সবাইকে হতভম্ব করেছে। মিন অং লাইং রাশিয়ায় একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছে মিয়ানমারে সন্ত্রাসী গ্রæপ রয়েছে। এর কারণ তাদের পেছনে বৃহৎ শক্তির সমর্থন রয়েছে। বৃহৎ শক্তি বলতে মিন অং লাইং স্পষ্টত চীনকে বুঝিয়েছে।

অনেক পশ্চিমাদের কাছে প্রিয়ভাজন থেকে সু চি রাতারাতি ভিলেনে পরিণত হন। ছবি : এএফপি
অনেক পশ্চিমাদের কাছে প্রিয়ভাজন থেকে সু চি রাতারাতি ভিলেনে পরিণত হন। ছবি : এএফপি

 

মিয়ানমারে শান রাজ্যসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহীদের প্রতি অস্ত্র দিয়ে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে।

এভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বর্তমানে সরাসরি চীন বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। যা বেইজিংকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। এছাড়া মিয়ানমার সেনবাহিনী ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে মিয়ানমারে অবস্থানরত ভারতীয় কয়েকজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে ।

মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাপান মিয়ামনমারকে সহায়তার চেষ্টা করছে।
মিয়ানমারের ওপর দিয়ে সহজে চীন ভারত মহাসাগরে পৌছাতে পারে। সহজ পথ। মিয়ানমারের ওপর দিয়ে ভারত মহাসাগর হয়ে চীন সহজে বানিজ্য পন্য পরিবহন করতে পারে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং ইউরোপের সাথে। এখন যা চলছে দক্ষিন চীন সাগর আর সরু মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রন নিয়ে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা চলছে। অপরদিকে মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ভারতের নিয়ন্ত্রন। এ অবস্থায় মিয়ানমার হয়ে ভারত মহাসাগর এবং পাকিস্তান হয়ে আরব সাগরে প্রবেশ হচ্ছে চীনা বিকল্প বানিজ্য রুট। ফলে মিয়ানমারের ওপর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে চীন কোনো কিছুর তোয়াক্কা করবে না।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন থেকে চীনা ছত্রছায়ায় ক্ষমতায় আছে। এখন চীনের অতিরিক্ত প্রভাব থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় চীন মিয়ানমারের ওপর তার আধিপত্য সংহত করার অংশ হিসেবে সূ চিকে বেছে নেয়া অস্বাভাবিক নয়। অপর দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যতই চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিক না কেনো সূ চির বিরুদ্ধে তাদের কিছুই করার নেই।

বাস্তবতা হচ্ছে মিয়ানমারের আভ্যন্তরিন রাজনীতি, সেনাবাহিনী ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে চীনের প্রভাব এতোটাই যে দেশটি যার পক্ষ নেবে তার বিপক্ষে সেনাবাহিনী বা অন্য কারে তেমন কিছু করার নেই। কারন মিয়ানমারে যারাই ক্ষমতায় আসুক তাদেরকে কাবু করার বা পক্ষে রাখার অনেক কার্ড আছে চীনের হাতে।

ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য চীনের কোলে আশ্রয় নিয়েছেন সু চি। ছবি : দ্য ডিপ্লোমেট
ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য চীনের কোলে আশ্রয় নিয়েছেন সু চি। ছবি : দ্য ডিপ্লোমেট

 

মিয়ানমারের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে চীন নির্ভর। দেশটির প্রায় সমস্ত বড় অবকাঠামো চীনা বিনিয়োগনির্ভর। মিয়ানমার ও রাখাইন ঘিরে রয়েছে চীনের সুদুর প্রসারী মাল্টি বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক অবকাঠামো পরিকল্পনা। যার অনেকগুলো বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন। অপরদিকে বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহী বাহিনী দিয়ে মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল করারও উপায় জানা আছে চীনের।

২০২০ সালের জানুয়ারি সফরকালে শি পিং মিয়ানমারের সাথে ৩৩টি সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করেন। এর মধ্যে ১৩টি অবকাঠামো কেন্দ্রিক। পশ্চিমা অনেক দেশ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের সাথে সর্ম্পকের ক্ষেত্রে জটিল অবস্থায় রয়েছে। জাপান চেষ্টা করছে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে। চীনের বিরুদ্ধে গিয়ে মিয়ানমারে বিদ্রোহ দমনে জাপানসহ যেসব দেশ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করার চেষ্টা করছে তা খুব একটা কাজে আসবে না। আপাতত মিয়ানমার বিষয়ে শেষ কথা হলো চীন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে