তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে যুদ্ধপরিস্থিতি, সুবিধাজনক অবস্থানে আনকারা

গ্রিসের সঙ্গে এই বিরোধে তুরস্ক বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:০৩

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্যাসের অনুসন্ধান ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। তুরস্ক বলেছে, গ্রিস অযৌক্তিক দাবি থেকে সরে না এলে সে তার ধ্বংসের পথ রচনা করবে। তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে এই বিরোধে বিভক্ত হয়ে পড়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো। তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতির নানা দিক নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।

পূর্ব ভূমধ্যসাগর দ্রুতবেগে সামরিকীকরণ হচ্ছে। জ্বালানি সংগ্রহ নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার ফলে ন্যাটোর সদস্য এই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফ্রান্স, মিশর ও আরব আমিরাতের সমর্থন নিয়ে গ্রিস নতুন যে পানিসীমা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে তাতে তুরস্ক পানিসীমা সঙ্কুচিত করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রিসের এমন দাবিকে তুরস্ক দেশটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে দাবি করেছে।

দুই দেশের এই উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতা করছে জার্মানি। কিন্তু সে উদ্যেগ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। কারন জার্মানীর প্রভাবাধীন ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের বিরুদ্ধে অবরোধের হুমকি দিয়েছে। ফলে দুই পক্ষ মুখোমখি দাড়িয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউয়িননের সদস্য ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস ও ইতালি রণতরী ও যুদ্ধ বিমান নিয়ে সাইপ্রিয়ট উপকুলে সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে। তারা খোলাখুলিই বলছে যে বিতর্কিত এলাকায় তুরস্কের জ্বালানি অনুসন্ধান ঠেকানোই এ মহড়ার লক্ষ্য।

এসব দেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই সেখানে রণতরী ও যুদ্ধবিমানের মহড়া দিয়ে যাচ্ছে। গ্রিসের পক্ষে বড় সমর্থন নিয়ে নেমেছে ফ্রান্স। তারা রণতরী ও যুদ্ধ বিমান পাঠিয়েছে। ফ্রান্স ও তুরস্ক উভয়ই ন্যাটোর সদস্য হলেও তাদের মধ্যে বিরোধ পুরনো। লিবিয়া সংকটে উভয়ের বিপরীত মেরুতে অবস্থানে উত্তেজনা আরও বেড়েছে।

তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যকার এই উত্তেজনায় ইইউতে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। ফ্রান্স, গ্রিস ও সাইপ্রাস চাচ্ছে এই জোট তুরস্কের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিক। এমনকি তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করুক। বিপরীতে জার্মানি, স্পেন ও ইতালি চাচ্ছে সমঝোতামুলক কিছুটা নমনীয় বলে মনে করা হচ্ছে। অপরদিকে পূর্ব ইউরোপের হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার মতো দেশগুলো আছে তুরস্কের পক্ষে। তবে এসব তৎপরতার বিপরীতে তুরস্ক স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে পূর্ব ভূমধ্যসাগর নিয়ে তারা কোনো ছাড় দেবেন না।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়্যেপ এরদোয়ান বলেছেন, কৃষ্ণসাগর, এজিয়ান ও ভূমধ্যসাগরে তাদের অধিকার রক্ষার জন্য যা করার প্রয়োজন তিনি তা করতে পিছপা হবেন না। গ্রিসের সামরিক মহড়ার জবাবে তুরস্ক ১ ও ২ সেপ্টেম্বর পূর্ব ভূমধ্যসাগরে লাইভ অ্যামুনেশন মহড়া চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। সাইপ্রাসের পূর্ব উপকূলে এই মহড়া চালানো হবে।

গ্রিসের সঙ্গে উত্তেজনার পেছনে ফ্রান্সকে দায়ী করে তুরস্ক বলেছে, শক্তিমতা দেখিয়ে তাদের বাধা দেওয়া যাবে না। তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্তী হুলুসি আকর বলেছেন, তুরস্কের সশস্ত্র বাহিনীর মহড়াকে ভন্ডুল করার স্বপ্ন কারো পূরণ হবে না। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, আন্তর্জাতিক চুক্তি লংঘন করে ফ্রান্স সাইপ্রাসে যুদ্ধ বিমান পাঠিয়েছে। ফ্রান্সের আশকারা পেয়ে গ্রিস ও সাইপ্রাস বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

গ্রিসের মদতে সাইপ্রাসে একটি অভ্যুত্থানের পর ১৯৭৪ সালে তুরস্কও সেখানে অভিযান চালায়। বর্তমানে গ্রিক সাইপ্রিয়টরা দেশটির দক্ষিণে আর তুর্কি সাইপ্রিয়টরা উত্তরে বাস করেন। দক্ষিণের অংশের নাম রিপাবলিক অফ সাইপ্রাস ও উত্তরের অংশের নাম তার্কিশ রিপাবলিক অফ নদার্ন সাইপ্রাস।

রিপাবলিক অফ সাইপ্রাস ভূমধ্যসাগরে প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধানের জন্য ইতালির ইএনআই ও ফ্রান্সের টোটালকে অনুমতি দিয়েছে। এতে তার্কিশ সাইপ্রাসের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে তুরস্ক জানিয়েছে। ফ্রান্স ও মিশরের সমর্থন নিয়ে গ্রিস তার কন্টিনেন্টাল সেলফ ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে চায়। যা আগের সব সমাঝোতার লঙ্ঘন। গ্রিসের এই ধরনের যে কোনো পদক্ষেপ তুরস্ক দেখছি দেশটির সমুদ্রসীমায় দখলের প্রচেষ্টা হিসাবে। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক হুশিয়ারি উচ্চারন করেছে এমন পদক্ষেপ নিলে যুদ্ধ অনিবার্য। ইতোমধ্যে তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াদ ওকতাই খুব স্পষ্টভাবে বলছেন যুদ্ধ ছাড়া তাদের সামনে আর কী করার আছে? তিনি বলছেন গ্রিসকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্কের প্রতিপক্ষ যেন এমন কোনো ভুল না করে যা তাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। তিনি বলেছেন, আমরা কারো ভূখন্ডের দিকে নজর দিচ্ছি না। তবে যেটা আমাদের সেটা নিয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে কোনো আপোস করব না। এজন্য যা করার দরকার তাই করব।

তুরস্ক বলেছে, গ্রিস একটা বেয়ারা সন্তান। তা সত্ত্বেও তারা সৎ মধ্যস্ততা ও সংলাপ চায়। তবে গ্রিস সংলাপের জন্য পূর্বশর্ত দিলে এবং অনমনীয় থাকলে সত্যিকারের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। তুরস্ক ও গ্রিসের এই বিরোধে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ব্যবহার করতে চায় ফ্রান্স। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ইইউর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূখন্ড নিয়ে তুরস্ক, গ্রিস ও বিভক্ত সাইপ্রাসের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। তবে ভূমধ্যসাগরে প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান সবকিছুকে বদলে দিয়েছে। বৃহৎ এই ভূরাজনৈতিক রণক্ষেত্রে ইইউ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা আঞ্চল জড়িয়ে পড়তে পারে।

ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের গবেষণার বলা হয়েছে, পূর্ব ভূমধ্যসারের উপকুলে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি ব্যারেল তেল ও ১২২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উত্তোজনযোগ্য মজুদ আছে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরের এলাকায় তুরস্কের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের ফলে গ্রিস ও পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তুরস্কের উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। তবে এরদোগান বলেছেন, ‘তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ইস্যুতে আমরা শতভাগ সঠিক অবস্থানে আছি।

মিশর- ফ্রান্স- আরব আমিরাত জোটের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, আমরা জলদস্যুদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। আমরা এমন কোনো দেশ আমাদের শিশুদের জন্য রেখে যেতে পারি না যেখানে তারা নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পারবে না, যেখানে তাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকবে।

ভূরাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় প্রভাব বৃদ্ধির লড়াইয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে কাজ করছে ফ্রান্স তার ঘনিষ্ঠ মিত্র আরব আমিরাত। পূর্ব ভূমধ্যসাগরকে তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করে। ফ্রান্স ও আমিরাত এখানেই বাধা হয়ে দাঁড়াতে চায়। সম্প্রতি গ্রিস ও তুরস্কের রণতরীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আবার এ ধরনের সংঘাত হলে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।

১৯৯৬ সালেও তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছিল। তখন গ্রিস বেকায়দায় পড়লে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মধ্যস্থতায় উত্তেজনা প্রশমিত হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্রিস তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার মতো হটকারি সিদ্ধান্ত নিলে ভূমধ্যসাগরে তার অনেকগুলো দ্বীপ আংকারার দখলে চলে যেতে পারে।

গ্রিসের সঙ্গে এই বিরোধে তুরস্ক বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক হিসাব নিকাশ তুরস্কের পক্ষে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন। এ সময় দেশটি আন্তর্জাতিক বিরোধ থেকে দূরে থাকে। তাছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সম্পর্ক তুলনামূলক ভালো।

জার্মানির সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলেও সম্প্রতি জার্মানীর ভুমিকা নিয়ে সন্দিহান তুরস্ক। যদিও সরাসরি তুরস্কের বিরুদ্ধে জার্মানির অবস্থান নেয়া কঠিন। তুরস্ক জার্মানির কাছ থেকে বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে। বিপরীতে রফতানি করে ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। জামার্নির অনুকুলে ৪ বিলিয়ান ডলারের বেশি বাণিজ্য। তাছাড়া জার্মানিতে বাস করে বিপুলসংখ্যক তুর্কি নাগরিক। জার্মান সরকারের ওপর তারা চাপ সৃষ্টি করে থাকে। এছাড়া পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ সরাসরি তুরস্ককে সমর্থন দিতে পারে। যার মধ্যে হাঙ্গেরীও রয়েছে। যা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন বাড়াতে পারে।

তুরস্কের ওপর চাপপ্রয়োগ করার চেষ্টা করলে রাশিয়ার দিকে আরো বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়তে পারে আংকারা। এমনকি রাশিয়া-চীন ও তুরস্কের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য প্রক্রিয়া এগিয়ে যেতে পারে। যাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে এমন অবস্থা নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার ওপর।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার দেশটিকে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তবে এতে তার বৈরিশক্তি আরও প্রবল শক্তি নিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ইরান ও রাশিয়ার বড় জ্বালানি বাজার তুরস্ক। তুরস্ক এ দুটো দেশ থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে দিলে তাদের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তুরস্ক ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে সহজেই। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সঙ্গে আকাংরা তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট আলোচনায় গ্যাস আমদানি ইস্যু কাজে লাগাতে পারবে। আর রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় থাকলে ইইউ, ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলানো তুরস্কের পক্ষে কঠিন হবে না।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইইউ, ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র হয়তো শেষ পর্যন্ত চাইবে না তুরস্ক রাশিয়ার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ুক।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে