আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের সাথে ভারতের সর্ম্পক

চীন-ভারত বৈরিতার ইতিহাসও একেবারে কম-পুরনো নয় - টুনসম্যাগ

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৩ আগস্ট ২০২০, ১৮:৪২

চীন-আমেরিকা বৈরিতার ইতিহাস বহু পুরনো। মাঝখানে সত্তর দশকের গোড়ায় এসে আমেরিকার নিক্সন প্রশাসনের উদ্যোগে দু'দেশের সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়। নতুন শতাব্দীতে এসে চীনের আর্থ-সামরিক ও প্রযুক্তিগত বিশাল উত্থান পশ্চিমাদের চোখ টাটিয়ে দেয়। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে এসে সম্পর্কটি আর টাল সামলাতে পারলো না। দক্ষিণ চীন সাগর, বাণিজ্য বৈষম্য ইত্যাদি নানা ইস্যুতে চীন ও আমেরিকা আর পাশাপাশি থাকতে পারলো না, দাঁড়িয়ে গেলো মুখোমুখি।

চীন-ভারত বৈরিতার ইতিহাসও একেবারে কম-পুরনো নয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত দু'দেশের ছিল দারুণ সুসম্পর্ক। ভারতে সে-সময় স্লোগান শোনা যেত- ''হিন্দি-চীনা ভাই ভাই''। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ এই 'ভাই ভাই' সম্পর্কটাকে একেবারে বদলে দেয়। এরপর দু'দেশের নানা আদান- প্রদান চলেছে বটে, তবে সম্পর্কটা আর কখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।

তা-ও যাহোক চলছিল এক রকম। কিন্তু মাঝখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঢুকে পড়ায় হয়তোবা, চীন-ভারত সম্পর্কটা আর টাল সামলাতে পারে না, লাদাখে এসে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দু'দেশ দাঁড়িয়ে পড়ে মুখোমুখি। চীনের বিরুদ্ধে এবার অলিখিত জোট বাঁধে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। তারই অংশ হিসেবে গত জুলাই মাসের শেষ দিকে ভারত মহাসাগরে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয় ভারত ও মার্কিন নৌবাহিনী।কোনো সন্দেহ নেই যে, এ মহড়ার লক্ষ্য ছিল চীনকে সুস্পষ্ট একটা বার্তা পৌঁছে দেয়া।

নৌ-মহড়ায় অংশ নেয় মার্কিন রণতরী নিমিৎস স্ট্রাইক ক্যারিয়ার এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজ। এটি অনুষ্ঠিত হয় মালাক্কা প্রণালীর কাছাকাছি অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে ঘিরে। মালাক্কা প্রণালী কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌপথ। চীনের সাথে ভবিষ্যতের যে-কোনো রকম সংঘর্ষে ভারত এটি বন্ধ করে দিতে পারে, যা চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য হবে বিপর্যয়কর।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের এ যৌথ মহড়া আরো একটি বৃহত্তর মহড়ার মঞ্চ প্রস্তুত করেছে। চলতি বছরের শেষের দিকে 'মালাবার এক্সারসাইজ' নামের এ বহুজাতিক মহড়াটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। 'চতুর্ভুজ' নামে পরিচিত সমমনা চারটি দেশ - যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং খুব-সম্ভব অস্ট্রেলিয়া ওই মহড়ায় যোগ দিতে পারে।

চীন মনে করে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নেতা হিসেবে তার উত্থান ঠেকাতে শত্রুরা জোট বেঁধেছে। তাই দেশটি নানারকম পাল্টা ব্যবস্থাও নিয়েছে। তবে চীনা পদক্ষেপের ফলে সৃষ্ট কৌশলগত শূণ্যতা পূরণের জন্যই যে এসব উদ্যোগ ও মহড়ার আয়োজন, তা কিন্তু নয়। তবে ওই চতুর্ভুজের মধ্যকার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, দূরত্ব ও ঐতিহাসিক অবিশ্বাসকে কাজে লাগাবে চীন, এতে আর সন্দেহ কী!

ক্ষমতায় আরোহনের সাত মাসের মাথায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্বাক্ষর করেন ''ইউএস-ইন্ডিয়া জয়েন্ট স্ট্র্যাটেজিক ভিশন ফর দ্য এশিয়া-প্যাসিফিক অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশান রিজিয়ন''। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে সম্পাদিত ওই চুক্তিতে গোটা অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে অবাধে জাহাজ ও আকাশে উড়োজাহাজ ওড়ার কথা বলা হয়।

ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সাল থেকেই যৌথ নৌ-মহড়া চালিয়ে এলেও এ চুক্তির মাধ্যমে ভারত প্রথম বারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার'রূপে স্বীকৃতি লাভ করলো। চুক্তিটি সম্পাদনের অল্প দিনের মধ্যেই দক্ষিণ চীন সাগরে জাপান-মার্কিন টাস্কফোর্সের সাথে যোগ দেয়ার জন্য যুদ্ধজাহাজের একটি বহর পাঠায় ভারত।

অতীতেও মালাবার এক্সারসাইজ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং কখনো-কখনো হয়েছে ভারতের জলসীমায়ও। এসব মহড়া ভারতকে সামরিক দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের অনেক কাছাকাছি এনে দিয়েছে । তারপরও এসব মহড়া থেকে নতুন কোনো যৌথ শক্তির জন্ম কবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

এর একাধিক কারণ আছে। যেমন, লাদাখের ঘটনায় মার্কিন কর্মকর্তারা কেবল বিবৃতি দিয়েই দায় সেরেছেন, ভারতের সাহায্যে সরাসরি এগিয়ে আসেননি। তাদের যুক্তি ছিল, চীনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়াটা ভারতের স্বার্থের অনুকূল নয়।

হিমালয় অঞ্চলে ভারতের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে চীন হয়তো এমনও ভেবেছিল যে, সমুদ্রে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ এবং ভারত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতার চাইতে ভারত এখন স্থলযুদ্ধের দিকেই বেশি মনোযোগ দেবে।

একটি ভারতীয় পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাতকারে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বিপিন রাওয়াত যা বলেছেন তাতে চীনা ধারণার বিপরীত চিত্রই ফুটে ওঠে। তিনি স্থলসীমান্ত রক্ষার উদ্যোগের পাশাপাশি নৌবাহিনীর জন্য আরো রণতরী সংগ্রহের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচিত সীমান্ত রক্ষা করা এবং সীমান্তে লড়াই চালিয়ে যাওয়া আর পাশাপাশি ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখা। এ কাজে রণতরীর চাইতে সাবমেরিন অনেক বেশি কার্যকর বলেও মনে করেন বিপিন রাওয়াত।

কিন্তু যদি চীনের লক্ষ্য হয় যে ভারত মহাসাগর থেকে ভারতের মনোযোগ সরিয়ে রাখবে প্রত্যন্ত হিমালয় অঞ্চলের দিকে, তাহলে ভুল হবে। হিমালয় অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সম্ভাবনাটিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ সম্ভাবনা মাথায় রেখেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলওসি সংলগ্ন এলাকায় সৈন্যসংখ্যা বাড়াচ্ছে ভারত। এ রেখার এপার-ওপারেই ভারত ও চীন অবস্থিত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের কাছে আরো অস্ত্র বিক্রির আগ্রহ দেখাতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ভারত কখনও চীনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ভারতের পক্ষে এগিয়ে আসবে আমেরিকা- এমনটি মনে করে না কেউ। এমনকি ভারতের প্রতিরক্ষা মহলেও এ নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে।

আর ভারতও তার কৌশলগত মিত্রদের কাছে আপন স্বাধীন সত্তা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নয়। তাই তো তারা আমেরিকার সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে চাইলেও পুরনো বন্ধু রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। আর তাই এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনার জন্য ২০১৮ সালে রাশিয়ার সাথে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ' কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি করে ভারত। এতে অবশ্য আঁতে ঘা লাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তারা হুঁশিয়ার করে দেয়, রুশ অস্ত্র বিক্রির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা ভারতের ওপরও আরোপ করা হতে পারে।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সরকারি বার্তা সংস্থা নোভস্তি এক সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে একটি খবর প্রকাশ করে। ওই কর্মকর্তা জানান, রাশিয়া ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ভারতের কাছে স্টেট-অব-দ্য-আর্ট উইপন প্ল্যাটফরম সরবরাহ করবে। সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার আওতাসম্পন্ন এ প্ল্যাটফরমকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্স সিস্টেম বলে গণ্য করা হয়।

নানা উত্থান-পতন সত্ত্বেও ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রয়েই গেছে রাশিয়া। এখনও ভারতের আমদানিকৃত অস্ত্রের ৫৮ ভাগই আসে রাশিয়া থেকে। আগে এ পরিমাণ ছিল ৭৬ শতাংশ। চীনের সাথে সাম্প্রতিক লাদাখ-কান্ডের পর ভারতের মোদি সরকার রাশিয়ার কাছ থেকে ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার দামে ৩৩টি নতুন জঙ্গি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে।

ভারতের এমন অস্ত্রসজ্জার মুখেও হিমালয় অঞ্চলে চীন উত্তেজনা বৃদ্ধির কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, যদিও তারা পুরোপুরি সশস্ত্র অবস্থায় সদাপ্রস্তুত- এ কথা বলেছে ভারতেরই বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত থিঙ্কট্যাঙ্ক তক্ষশীলা ইন্সটিটিউশন।

ভারত মহাসাগরে সাম্প্রতিক ভারত-মার্কিন যৌথ নৌমহড়ার পরও চীনকে নড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ হলো, চীন তার শত্রু চিহ্নিত করেছে এবং শক্তি ও ভীতি প্রদর্শনের নতুন স্ট্র্যাটেজিক পজিশন গ্রহণ করেছে। আর তারা এ-ও জানে যে, শত্রুরা তার বিরুদ্ধে সহজে এক হতে পারবে না।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, ''চীন যে দক্ষিণ চীন সাগরের অধিকাংশ এলাকা নিজের বলে দাবি করে, তা অবৈধ।'' তা তিনি বলেছেন বটে, তবে এ ক্ষেত্রে চীনকে ঠেকাতে মার্কিনীরা কত দূর যাবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।

চীনকে ঠেকাতে মার্কিনীরা কত দূর যাবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। ছবি : ইন্টারনেট

 

মিত্র হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের সন্দেহ করার যৌক্তিকতা এখানেই। এমন অবস্থায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন চতুর্ভুজে থেকেও ভারত ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে জাপানের। আমেরিকা সাথে আর না-ই থাক, নব্য স্নায়ুযুদ্ধের কালে ভারত মহাসাগরে ক্রমেই জোট বাঁধছে ভারত ও জাপান।

সব মিলিয়ে বলা যায়, নব্য স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে প্রত্যন্ত হিমালয় অঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ন জলরাশি পর্যন্ত। এ উত্তাপ আগুনে পরিণত হয় কি না, হলে তা কাকে পোড়ায়, এখন তা-ই দেখার অপেক্ষা।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে