মধ্যএশিয়া নিয়ে তুরস্কের স্বপ্ন

তুরস্ক এখন বিশ্বের ১৭তম বৃহৎ অর্থনীতি। সেদেশের আত্মবিশ্বাসে ভরপুর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান - এপি

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৬ আগস্ট ২০২০, ১৮:১০

বড় দেশ, জাতি ও তাদের নেতাদের অনেক রকম স্বপ্ন থাকে। রাশিয়ার আছে, চীনের আছে, তুরস্কেরও আছে। রুশ-চীনের স্বপ্নের কথা আমাদের অনেকেরই জানা। তার সে-কথা থাক। আজ বলা যাক তুরস্কের স্বপ্নের কথা।

মধ্য এশিয়ায় তুরস্ক উদীয়মান দেশ হিসেবে বিরাজ করছে আজ প্রায় তিন দশকের মতো। কিন্তু উভয়ের মাঝে জাতিগত সম্পর্ক অনাদিকালের। এক হাজার বছরেরও বেশিকাল আগে মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বসতি স্থাপন করে তুর্কী জনগোষ্ঠী। এটা আজকের আধুনিক তুরস্কের আনাতোলিয়ান ভূভাগে তাদের থিতু হওয়ারও আগের কথা।

সেই হিসাবে আজকের তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ান দেশগুলো একই বিশাল জনগোষ্ঠীরই অংশ। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে সাইবেরিয়া পর্যন্ত নানা গোত্র ও ভাষাগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে যারা, তারা আসলে তুর্কী জাতিরই মানুষ। তুর্কী ভাষা পরিবারে আছে ৩০টির বেশি ভাষা। এসব ভাষায় কথা বলে ১৭০ মিলিয়ন মানুষ। তুরস্কের বাইরেও তুর্কী বংশোদ্ভুত জাতিগোষ্ঠীর পাঁচটি দেশ রয়েছে - আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান। এর বাইরে পূর্ব রাশিয়া ও পশ্চিম চীনে রয়েছে সংখ্যালঘু তুর্কী জনগোষ্ঠী।

ঊনিশ শতকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা 'প্যান তুর্কিজম'কে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় ওসমানীয় সাম্রাজ্য, যদিও তখন মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করছে উদীয়মান শক্তি রাশিয়া, আর তাদের সাথে কিছুতেই পেরে উঠছে না ক্ষীয়মান ওসমানীয় সাম্রাজ্য। ১৯৯৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই তুরস্কের সামনে আবার সুযোগ আসে। একবিংশ শতাব্দীর সামনে দাঁড়িয়ে তুরস্ক তখন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তারা তখন শুধু সম্পদশালীই নয়, তুর্কী জাতির দেশগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ ও সবচাইতে ক্ষমতাশালী। এ প্রতাপের বলে তারা মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে, অর্থনৈতিক সহায়তা বাড়াতে এবং নিজেদের নেতৃত্বের আসনে আসীন করতে এগিয়ে যেতে থাকে।

দশকের পর দশক সোভিয়েত শাসনে থেকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো বেশ ভালোভাবেই রুশীকরণ ও ধর্মবিমুখ হয়ে গেছে। ওই আমলে কয়েকটি মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রের কতিপয় নেতা কখনোই তুরস্ককে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর ওসব নেতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন যারা, তারা নতুন প্রজন্মের জাতীয়তাবাদী, তুর্কীপন্থী এলিট। তারা নিজেদের তুর্কী জাতিভুক্তই মনে করেন, যা তুরস্কের জন্য একটি সুসংবাদ। এ রকম একজন নেতা হচ্ছেন উজবেকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরযিয়োয়েভ।

তুর্কী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের মতে, মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর স্বাধীনতাকে তুরস্কই সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯০ দশকের গোড়ার দিকে তুরস্ক ওই অঞ্চলে নিজ স্বার্থ সুরক্ষার তাগিদে এসব দেশের সাথে দ্রুত কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি ''হাই লেভেল স্ট্র্যাটেজিক কো-অপারেশন কাউন্সিল'' গঠন করে।

তুরস্কের প্রভাবের প্রধান স্তরগুলো হচ্ছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সফট পাওয়ার বা আর্থ-সাংস্কৃতিক প্রাধান্য। সোভিয়েত-উত্তর সময়ে মধ্য এশিয়ায় নিজের ব্র্যান্ড তৈরির কাজে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তুরস্ক। সেসব দেশে তুর্কী টেলিভিশন ও সংবাদপত্র চালু হয়। তুরস্কে পড়াশোনার জন্য মধ্য এশীয় শিক্ষার্থীদের বিপুল হারে বৃত্তি দেয়া হয়। তুর্কীরা মধ্য এশিয়াবাসীকে তাদের দীর্ঘ দিনের হারানো ভাই হিসেবে আর নতুন সময়কে পুনর্মিলনের সুযোগ হিসেবে দেখতে থাকে।

মধ্য এশিয়ার নেতৃবৃন্দ এ ক্ষেত্রে তুরস্কের উদ্যোগকে স্বাগত জানান। শুধু অর্থনীতি নয়, মধ্য এশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বচ্ছন্দ করতে নানা রকম সংগঠনের এক বিশাল নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছে তুরস্ক। তারা গড়ে তুলেছে টার্কিক ইউনিভার্সিটি অ্যাসোসিয়েশন। পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে ইতিহাস বিষয়ক একটি সাধারণ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে, যে ইতিহাস হবে তুর্কী ভাষ্যেরই অনুরূপ।

ওই অঞ্চলে অসংখ্য তুর্কী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য একটি হলো কাজাখস্তানের টার্কিশ-কাজাখ ইন্টারন্যাশনাল হোকা আহমেত ইয়েসেভি ইউনিভার্সিটি। ২০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে এটি এখন ওই দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া রাজধানী আলমাতি-তে আছে ২৮টি কাজাখ-টার্কিশ হাই স্কুল, একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি প্রাইমারি স্কুল এবং একটি তুর্কী ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র।

কিরগিজস্তানের অন্যতম অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়, মানাস ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তুরস্কের অর্থানুকূল্যে। সেদেশের রাজধানী বিশকেকের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অসংখ্য টার্কিশ হাই স্কুল ও তুর্কী ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র। এর চাইতেও বেশি আছে তুর্কী কাবাব ঘর ও খাবার ঘর।

১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে তুর্কীভাষী দেশগুলোর সরকার প্রধানদের শীর্ষ সম্মেলন। এর থেকেই উদ্ভব হয়েছে একটি শক্তিশালী জোট দ্য টার্কিক কাউন্সিলের। ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে এর যাত্রা শুরু হয়। এর সচিবালয় স্থাপিত হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। ইতিহাসে প্রথম বারের মতো তুর্কী জাতিগোষ্ঠীর দেশগুলো স্বেচ্ছায় এ কাউন্সিলের মাধ্যমে জোটবদ্ধ হয়।

এ কাউন্সিলের গুরুত্ব বোঝা যায় এর দিকে তাকালে। এর সদস্য দেশগুলোর মিলিত জনসংখ্যা ১৪৪ মিলিয়নেরও বেশি। এসব দেশের মোট আয়তন ৪০ লাখ বর্গকিলোমিটার আর মোট জিডিপি এক দশমিক ১৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে দ্য টার্কিক কাউন্সিল কতোটা প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে। এমনিতেই মধ্য এশিয়া থেকে প্রতি বছর লাখ-লাখ মানুষ তুরস্কে বেড়াতে আসে, তার ওপর মধ্য এশিয়ার সব দেশ থেকে আগতদের ভিসা ছাড়াই প্রবেশের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে তুরস্ক। তুরস্কের জাতীয় বিমানসংস্থা টার্কিশ এয়ারলাইন্স মধ্য এশিয়ার সব বড়-বড় নগরীতে ফ্লাইট পরিচালনা তো করেই, এমনকি অনেক ছোট শহরেও তাদের যাতায়াত আছে। তুরস্কের কিছু ব্যয়সাশ্রয়ী বিমানসংস্থাও ফ্লাইট পরিচালনা করছে মধ্য এশিয়ায়।

মধ্য এশিয়া 'অভিযানে' পিছিয়ে নেই তুরস্কের সংস্কৃতি ও মিডিয়াও। ১৯৯০এর দশকের শুরুতে তুরস্কের 'জামান' পত্রিকার কিরগিজ সংস্করণ প্রকাশের মধ্য দিয়ে এর সূচনা হয়। এরপর আরো অনেক সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল অনুসরণ করে 'জামান'কে। যদিও 'হানিমুন পিরিয়ড' কেটে যাওয়ার পর তাদের দর্শক কিছু কমেছে, তবে পুরো মধ্য এশিয়ায় তারা এখনো জনপ্রিয়। বেসরকারী চ্যানেলগুলো প্রতিদিন দেখিয় চলেছে তুর্কী নাটক, মিউজিক ভিডিও, সিনেমা ও নিউজ বুলেটিন। সংবাদ প্রচার করা হয় তুর্কী ও স্থানীয় - উভয় ভাষায়। তবে আজারবাইজানে সংবাদ পাঠ করা হয় কেবলই তুর্কী ভাষায়। অনুবাদের সাহায্য ছাড়াই স্থানীয় লোকজন তা সহজে বুঝতে পারে।

আজারবাইজানের সাথে তুরস্কের ঘনিষ্টতা দিন দিন বাড়ছে। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সর্ম্পকের গন্ডি পেরিয়ে দুদেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বাড়ছে। আর্মেনিয়ার সাথে বিরোধে আজারবাইজানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক। এমনকি আর্মেনিয়াকে হুশিয়ার করে দিয়েছে। দুদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে নিয়মিত সামরিক মহড়া অনুষ্টিত হচ্ছে। তুরস্কের সৈন্যরা প্রশিক্ষন দিচ্ছে আজারবাইজানের সৈন্যদের। তুরস্ক নানা ধরনের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করছে আজারবাইজানের কাছে। মধ্যএশিয়ার অন্যদেশগুলোর সাথেও সামরিক সর্ম্পক বাড়ানোর চেষ্টা করছে তুরস্ক।

তবে মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের অবাধ গতি নিরবচ্ছিন্ন সুখের নয়। অনেকে মনে করছেন, এভাবে বহিরাগতদের আনাগোনা স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। তাছাড়া দীর্ঘদিন এসব দেশ থেকেছে নাস্তিক্যবাদের আবহে। সেখানে ইসলামী মুল্যবোধকে সামনে রেখে তুরস্কের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অনেকে মন থেকে মেনে নেবে না।

একে পার্টির হেডকোয়ার্টারের সামনে এরদোয়ান সমর্থকরা। ছবি : এএফপি
একে পার্টির হেডকোয়ার্টারের সামনে এরদোয়ান সমর্থকরা। ছবি : এএফপি

 

তুরস্ক হয়তো এ মুহূর্তে এবং নিকট-ভবিষ্যতেও মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া ও চীনের মতো প্রভাব বিস্তারকারী দেশ হতে পারবে না। কারণ, মস্কোর শেকড় এখানে অনেক গভীরে প্রোথিত আর বেইজিং-এর আছে পকেটভর্তি টাকা। তুরস্ক যে এই দিকটি বোঝে না তা নয়। এখনই কিছু করে বসাটা তুরস্কের লক্ষ্য নয়। তাদের দৃষ্টি সুদূরে।

এটি হচ্ছে সেই এলাকা, যেখানে রাশিয়া দীর্ঘকাল কর্তৃত্ব করেছে আর চীন এখন প্রবেশের পথ তৈরি করছে। আর এখানেই তুরস্ক তার জাতিভাইদের সামনে নিজেদের তুলে ধরছে ওদের বিকল্প হিসেবে। তুরস্ক এখন বিশ্বের ১৭তম বৃহৎ অর্থনীতি। সেদেশের আত্মবিশ্বাসে ভরপুর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তাঁর এ কে পার্টি আমেরিকা বা রাশিয়া কাউকেই ভয় না-পেয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাওয়ার গেম খেলে চলেছে আর খুব নীরবে বানিয়ে চলেছে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশের পথ।

মধ্যশিয়ার জনগোষ্টীর সাথে তুরস্কের ছিন্ন হওয়া সর্ম্পক নিবিড় করার দিকে দেশটির মনোযোগ বেশি। একটি বিস্তীর্র্ন ''টার্কিক ওয়ার্ল্ড'' গঠনে দিকে যেতে পারে। এক্ষেত্রে মস্কোর ''রুশকি মির'' বা রাশিয়ান ওয়ার্ল্ড এবং বেইজিং-এর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে মধ্যএশিয়াকে সম্পৃক্ত করার বিপরীতে তুরস্কের এই পরিকল্পনা।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে