ট্রাম্প কি নির্বাচনে হেরে যাবেন!

বাইডেন থেকে ট্রাম্পের পিছিয়ে পড়ছেন জাতীয় পর্যায়েও - মানি ডটকম

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩১ জুলাই ২০২০, ১৭:৩৭

করোনা ভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খবর এখনও সারা দুনিয়ায় তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। তবে মার্কিন মুলুকে কিন্তু নির্বাচনী ডামাডোল জোরেশোরেই বাজতে শুরু করেছে। নভেম্বরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে যাচ্ছেন বলে জনমত জরিপে আভাস পাওয়া গেছে। তবে নজিরবিহীনভাবে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে পরাজিত হলেও তিনি ক্ষমতা নাও ছাড়তে পারেন। জনমত জরিপে এগিয়ে থাকা ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন বলেছেন, তিনি মুসলিমদের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়বেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নানা দিক থাকছে আজকের প্রতিবেদনে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে জনমত জরিপে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছেন। অতি সম্প্রতি রয়টার্স ও ইপসোসের জরিপে দেখা গেছে, ১৩ পয়েন্টের ব্যবধানে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

করোনা ভাইরাস মহামারি এবং পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া মার্কিনিরা ট্রাম্পের প্রতি ক্রমেই বিরূপ হয়ে উঠতে থাকায় তার সমর্থন কমছে। ১০ জুন থেকে ১৬ জুন পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, নিবন্ধিত ভোটারদের ৪৮ শতাংশ বলেছেন, তারা নির্বাচনে বাইডেনকে সমর্থন দেবেন; আর ৩৫ শতাংশ বলেছেন, তারা ট্রাম্পকে সমর্থন করবেন। এই জরিপে দেখা যায়, গত কয়েক মাসের মধ্যে বাইডেন এবারই প্রথম সবচেয়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।

এদিকে এ মাসের শুরুর দিকে সিএনএন- এর একই ধরনের একটি জরিপেও দেখা গেছে, নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের চেয়ে ১৪ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন বাইডেন।

রয়টার্স ও ইপসোস জরিপে আরও দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্কদের ৫৭ শতাংশই ট্রাম্পের কাজকে সমর্থন করেননি। মাত্র ৩৮ শতাংশ মানুষ তাকে সমর্থন দিয়েছেন। গত বছর নভেম্বরের পরে এটাই ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থনের সর্বনিম্ন রেটিং। ট্রাম্পের জন্য স্পষ্টতই এ এক বিপদসংকেত। জরিপের ফলে ট্রাম্পের সমর্থনের ভিতি টলে যাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। নিজ দল রিপাবলিকানদের মধ্যেও ট্রাম্পের সমর্থন মার্চ থেকে জুনের মধ্যে ১৩ পয়েন্ট কমেছে।

এদিকে নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজের করা সা¤প্রতিক জরিপের ফলাফল বলছে, ইলেকটোরাল কলেজ ভোটেও বিপর্যয় হতে পারে ট্রাম্পের। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের জোরে পপুলার ভোটে হেরেও প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ট্রাম্প।

এবার ট্রাম্পের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ছয়টি অঙ্গরাজ্যেই জো বাইডেনের থেকে বড় ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েছেন তিনি। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, উত্তরের যে তিন অঙ্গরাজ্যে আগেরবার ট্রাম্প হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে ১০ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন, সেই শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্যেই এখন বাইডেন থেকে তিনি ২১ শতাংশ ব্যবধানে পিছিয়ে আছেন।

নিউইয়র্ক টাইমসের জরিপের তথ্যমতে, শুধু অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে নয়, বাইডেন থেকে ট্রাম্পের পিছিয়ে পড়ছেন জাতীয় পর্যায়েও। এ ক্ষেত্রে বাইডেনের প্রতি ৫০ শতাংশ ভোটার সমর্থন জানিয়েছেন। আর ট্রাম্পের পেছনে আছেন ৩৬ শতাংশ ভোটার। এ হিসাব অক্ষণ্ন থাকলে আসন্ন নির্বাচনে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ইলেকটোরাল ভোট পাবেন জো বাইডেন।

তাকানো যেতে পারে গ্যালাপের সর্বশেষ জরিপের দিকেও। এ ক্ষেত্রেও বাইডেন থেকে ঢের পিছিয়ে আছেন ট্রাম্প। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ট্রাম্পের অ্যাপ্রুভাল রেটিং কমছে। অধিকাংশ মানুষই তাঁর প্রেসিডেন্সিতে আর সন্তুষ্ট নয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে সমর্থন করেন এমন লোকের সংখ্যা ৩৮ শতাংশে নেমে গেছে। একজন প্রেসিডেন্টের পুনর্নির্বাচনের জন্য এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান। অথচ মে মাসেও তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন জরিপে অংশ নেওয়া ৪৯ শতাংশ মানুষ।

কিন্তু এরপর আন্দোলন, সহিংসতা, কনফেডারেট ভাস্কর্য রক্ষার ঘোষণা, অর্থনৈতিক সংকট, করোনাভাইরাসের ফিরে আসা ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ বিপাকে পড়েন ট্রাম্প। এখন তো তার প্রেসিডেন্সির প্রতি জনসমর্থনের রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায়ের কাছাকাছি। ২০১৭ সালে দায়িত্ব গ্রহণের বছরই তার প্রতি জনসমর্থন ৩৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল।

একই চিত্র দেখা যাচ্ছে পিউ রিসার্চ সেন্টারের সা¤প্রতিক জরিপের ফলাফলেও। গত মার্চেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে যারা ট্রাম্পকে সমর্থন করতেন তাদের মধ্যে ১৭ শতাংশই এখন তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এই পরিবর্তন শুধু স্বাধীন বা ডেমোক্রেট ভোটারদের মধ্যেই হয়েছে- এমন নয়। অন্তত ৫০০ কাউন্টিতে জরিপ করে গবেষণা সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজনৈতিক মত যেমনই হোক, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের প্রতি আস্থায় পরিবর্তন প্রায় একই রকম।

মোটাদাগে বিভিন্ন জরিপকারী সংস্থার ফলকে বিবেচনায় নিলে বলতেই হবে যে, ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় সাম্প্রতিক সময়ে বিরাট ধস নেমেছে। যেকোনো জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থনের হার এখন ৪০ শতাংশের নিচে। নির্বাচনের বছরের মাঝামাঝি এসে এমন অবস্থান কারো জন্য সহায়ক নয়। এর আগে এমন পর্যায়ে এমন সমর্থন পাওয়া দুই প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ ও জিমি কার্টার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।

শেষ পর্যন্ত ভোটের হারে এতো বেশি ব্যবধান হলে ট্রাম্প যেমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করবেন তেমনি তার দল রিপাবলিকান পার্টিও বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। আমেরিকার জনমিনিবিন্যাসের কারণে রিপাবলিকানরা গত দুই দশক ধরে সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ ও ইলেকটোরাল ভোটে যে বিশেষ সুবিধা ভোগ করতো, তাও শেষ হয়ে যাবে। শেতাঙ্গদের মধ্যেও ট্রাম্পের সমর্থন কমেছে। এতোদিন রিপাবলিকান প্রার্থীরা শেতাঙ্গদের বেশি সমর্থন পেয়েছে।

হিসেব বলছে, বাইডেন যদি ১০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন তবে তিনি ৩৭৫টি ইলেকটোরাল কলেট ভোট পাবেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ৫৩৮টি। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে হলে দরকার ২৭০টি।

তবে এত সব দুঃসংবাদের মধ্যেও ট্রাম্পের জন্য একটি সুখবর হতে পারে এই, তার সমর্থকদের অধিকাংশই একেবারে গোড়া। অন্যদিকে বাইডেনের ক্ষেত্রে হিসাবটি ঠিক উল্টো। ট্রাম্পের বিরোধী বলেই বাইডেনকে সমর্থন জানাচ্ছে ৬৭ শতাংশ মানুষ। খাঁটি বাইডেন সমর্থক মাত্র ৩৩ শতাংশ।

প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যমে ট্রাম্পের পরাজয় নিশ্চিত ধরেই প্রতিবেদন ও কলাম প্রকাশ হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের মত পত্রিকায় জো বাইডেন জয়ী হলে প্রথম দিনই কী কী করা উচিত তার ফর্দ প্রকাশ করেছে।

তবে ট্রাম্প হাল ছাড়ার পাত্র নন। পরাজিত হলে তিনি আগামী নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমেরিকার ইতিহাসে যা আগে কখনো হয়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, নির্বাচনে হেরে গেলে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে অস্বীকার করতে পারেন ট্রাম্প।

এ ছাড়া ভোট গণনায় বিলম্ব হতে পারে, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে মামলা হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। আমেরিকার রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে মামলা আগেও হয়েছে। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী করবেন- তা নিশ্চিত কওে কেউ বলতে পারছেন না। তিনি একসময় বলেছেন, হারলে ক্ষমতা ছেড়ে অন্য কাজ করবেন। আবার বলেছেন, এ বিষয়ে এখনই তিনি কিছু বলতে পারছেন না। প্রভাবশালী গণমাধ্যম সিএনএন বলছে, ফলাফল নিয়ে সম্ভাব্য মতবিরোধের জের ধরে পরিস্থিতি নাজুক হতে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটে কারচুপির কথা আগে থেকেই বলে আসছেন। নির্বাচনের ফলাফল তার পক্ষে না এলে ট্রাম্প কী বলবেন, তা অনুমান করা যেতে পারে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে।

২০১৬ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েও ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি ইলেকটোরাল ভোটের মারপ্যাচে। এর আগেও জর্জ বুশ ও আল গোরের মধ্যকার নির্বাচনে আদালতের হস্তক্ষেপ হয়েছিল। সেখানেও ডেমোক্রেটদের বিপক্ষে গিয়েছিল ফল। ইলেকটোরাল কলেজ ব্যবস্থা ও জনমিতি বিন্যাসের কারণে রিপাবলিকান প্রার্থীরা কম ভোট পেয়েও বারবার মসনদে বসছেন।

এদিকে মার্কিন নির্বাচন এবার কারচুপির জোরালে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। জো বাইডেন বলেছেন, তাঁর একমাত্র দুশ্চিন্তা হলো ট্রাম্প নির্বাচনে চুরি করার চেষ্টা করবেন। বাইডেন বলেছেন, আমার গভীর উদ্বেগ হচ্ছে যে নির্বাচনে ট্রাম্প চুরি করার চেষ্টা করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এমনকি হেরে গেলেও অফিস ছাড়বেন না।'

বাইডেনের আশঙ্কা, জর্জিয়াসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ভোটাররা যেন ভোট দিতে না পারে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বাইডেনের এই মন্তব্যকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে আখ্যা দিয়েছে হোয়াইট হাউজ।

এদিকে জো বাইডেন মুসলিমদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। বাইডেন প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবেন।

নির্বাচনে বাইডেনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়। সম্প্রতি পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি এমগেজ আয়োজিত এক সমাবেশে বাইডেন বলেছেন, ট্রাম্প চার বছর ধরে আমেরিকার মুসলমান সম্প্রদায়কে অসম্মান করছেন।
২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রথমেই ইরান, ইরাক, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নির্বাহী আদেশ জারি করেন। বাইডেন এটাকে শয়তানি বলে মন্তব্য করেছেন। বাইডেন বলেছেন, ট্রাম্প তার কথাবার্তা এবং কাজকর্মের মাধ্যমে দেশে ঘৃণার আগুন ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকার নীতি নির্ধারণে মুসলিমদের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটবে বলেও অঙ্গীকার করেছেন বাইডেনে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে