ট্রাম্প কেন চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করলেন

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে নিজের ব্যর্থতা থেকে ভোটারদের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতেই চীনকে টার্গেট করেছেন - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৯ জুলাই ২০২০, ১৯:১১

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ক্রম-অবনতিশীল সম্পর্কের মধ্যেই আবার নাটকীয় উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের চাংতুতে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বেইজিং। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে নিজের ব্যর্থতা থেকে ভোটারদের দৃষ্টি অন্যত্র সরাতেই চীনকে টার্গেট করেছেন।

হংকং, দক্ষিণ চীন সাগর ও নতুন করোনা ভাইরাসের উৎস নিয়ে ওয়াশিংটন-বেইজিং টানাপোড়েনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র টেক্সাসের হিউস্টনে অবস্থিত চীনা কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মার্কিন ‘মেধাস্বত্ব সুরক্ষিত রাখার স্বার্থে’ এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপকে চীন ‘রাজনৈতিক উসকানি’ এবং ‘নজিরবিহীন স্পর্ধা’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশকে ‘গর্হিত’ কাজ এবং ‘অন্যায়’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে অবিলম্বে এ ভুল সিদ্ধান্ত বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছি। তারপরও তারা এই ভুল পথ থেকে না সরলে চীন এর কঠোর পাল্টা জবাব দেবে।’

হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধের তিন দিনের মাথায় চেংদুতে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে চীন। এক বিবৃতিতে চীন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘যোগ্য জবাব’ দিতে তারা এ সিন্ধান্ত নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ‘অকারণ ব্যবস্থা গ্রহনের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী প্রয়োজনীয় জবাব দিতেই’ কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যেখানে গিয়ে ঠেকেছে চীন সেটা দেখতে চায় না এবং এর দায়ভার সম্পূর্ণরূপে যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে। চীনা মুখপাত্র বলেছেন, আমরা আরো একবার যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের ভুল সিদ্ধান্তগুলো প্রত্যাহার করে নিতে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরির অনুরোধ করছি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘মার্কিন মেধাস্বত্ব এবং মার্কিনিদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার স্বার্থে আমরা চীনের হিউস্টন কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছি।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র আলাদা একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘চীন বহু বছর ধরেই অবৈধভাবে বড় ধরনের গুপ্তচরবৃত্তি এবং প্রভাববিস্তারের কাজ করে চলেছে। গত কয়েকবছরে তাদের এই তৎপরতা আরও বেড়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তারা হস্তক্ষেপ করছে।

ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত দূতাবাস ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে চীনের ৫টি কনসুলেট আছে; এর মধ্যে কেনো কেবল হিউস্টনেরটাই বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হল ওর্টেগাস সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলেননি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় রিপাবিলকান সিনেটর মার্কো রুবিও চীনের হিউস্টন কনস্যুলেটকে স্পাই সেন্টার বা গুপ্তচর কেন্দ্র বলে অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী চীনারা হংকং ও ম্যাকাওয়ে চীনা কনস্যুলটেকে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন।

কোভিড-১৯ এর টিকা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চীনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দুইজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের খবর প্রকাশ্যে আসার অল্প সময়ের মধ্যেই হিউস্টনের চীনা কনস্যুলেট বন্ধের এ নির্দেশ এল। ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশের পর হিউস্টনের ওই চীনা কনস্যুলেট চত্বরে নথি পোড়ানোর ভিডিও প্রকাশ করেছে স্থানীয় গণমাধ্যম। ধারণা করা হচ্ছে, চীনা কর্মকর্তারা তাদের নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেছেন।

হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধের বিষয়টি বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে হুমকির সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে চীন বলছে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কনস্যুলেট বন্ধের আদেশ আশ্চর্যজনক ও একটি বিদ্বেষমূলক উত্তেজনা।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মুখপাত্র ওয়াং ওয়েবিন বলেন, বেইজিং এ ঘটনায় কঠোরভাবে নিন্দা জানাচ্ছে, এটি আপত্তিজনক ও অবিচার; যা চীন-মার্কিন সম্পর্ককে তলানিতে নিয়ে ঠেকাবে।

এরপর চীনে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘বর্তমানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যেখানে গিয়ে ঠেকেছে চীন সেটা দেখতে চায় না এবং এর দায়ভার সম্পূর্ণরূপে যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে।’

১৯৮৫ সালে চেংদুতে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেটের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে সেখানে দুই শতাধিক কর্মী রয়েছেন। কনস্যুলেটটি তিব্বতের খুব কাছে হওয়ার কৌশলগত দিক দিয়েও সেটি যুক্তরাষ্ট্রেরর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাস বোমা হামলা এবং হত্যার হুমকি পেয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং ট্ইুট করেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেভাবে চীনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে তার পরিণতিতেই দূতাবাসকে লক্ষ্য করে বোমা ও হত্যার এই হুমকি।

মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই অভিযোগ করছে, ভিসা জালিয়াতি করে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা একজন চীনা বিজ্ঞানী গ্রেপ্তার এড়াতে সানফ্রানসিসকোর চীনা কনস্যুলেটে গিয়ে আত্মগোপন করেছেন। ক্যালিফোর্নিয়া আদালতে দায়ের করা এক মামলায় এফবিআই বলেছে, ঐ বিজ্ঞানী চীনা সেনাবাহিনীর পিএলএর সদস্য, কিন্তু ভিসার আবেদনপত্রে তিনি তা গোপন করেছেন। তারা দাবি করছেন, সেনাবাহিনীর বিজ্ঞানীদের ছদ্মবেশে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর যে কর্মসূচি চীনের রয়েছে তার অংশ হিসাবে ঐ বিজ্ঞানীকে পাঠানো হয়েছে।

জুয়ান ট্যাং নামে ঐ চীনা নারী ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় জীববিজ্ঞানের একজন গবেষক। চীন সরকার বলছে যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের বিজ্ঞানী, চীনা ছাত্র-ছাত্রী এবং কনস্যুলেটগুলোকে নানাভাবে হেনস্থা করছে। হিউস্টনে কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ নিয়ে বিতর্কের মাঝে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন তিনি চীনের আরো কনস্যুলেট বন্ধ করে দেবেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এই বিরোধ আকস্মিক নয়। বিশ্বে চীনের প্রভাব দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। তাই বেইজিংকে কোণঠাসা করতে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নানা তৎপরতা শুরু করেছে ওয়াশিংটন। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে সফরে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও প্রকাশ্যে চীনের কড়া সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, চীনকে মোকাবিলায় তাঁরা বৈশ্বিক জোট গঠন করতে চায়।

ব্রিটেনে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক নির্মাণকাজ থেকে চীনের প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় বরিস জনসনের উচ্চ প্রশংসা করেন পম্পেও। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন, বর্তমান চীনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু।

এর আগে করোনাভাইরাসকে ‘চীনা প্লে¬গ’ নাম দিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সত্য লুকিয়েছেন পেসিডেন্ট শি জিনপিং। পম্পেওর অভিযোগ, বেইজিং করোনাভাইরাস মহামারির সত্য ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছে এবং নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ‘কলঙ্কিত উপায়ে’ এটাকে ব্যবহার করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহ বৈরিতা সত্তে¡ও চীন এই মুহূর্তে কিছুটা বেকায়দায় রয়েছে।। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর পাল্টা পদক্ষেপ নিলে চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া করোনাভাইরাস সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চীন অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেটাকে আরো বাড়াতে চায় না বেইজিং। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতসহ বেশ কিছু দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খুবই খারাপ যাচ্ছে।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি লুকানোর অভিযোগ ছাড়াও হংকংয়ে চীনের সরাসরি শাসন, ফাইভ জি প্রযুক্তি নিয়ে ইউরোপের সঙ্গে বিরোধ, জিনজিয়াংয়ে মুসলিমদের ওপর নিপীড়নসহ নানা ইস্যুতে চীন ব্যাপক চাপে রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চীনা কর্মকর্তারা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ট্রাম্প এখন চীনের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন নির্বাচনী ফায়দা পেতে। চীন পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে তাকে সে সুযোগ দিতে চাইছে না। চীন কঠোর ব্যবস্থা নিলে একে রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার বানিয়ে ট্রাম্প করোনা সংকট মোকাবিলায় তার চরম ব্যর্থতা আড়াল করার সুযোপ পেয়ে যাবেন। তিনি জনগণের দৃষ্টি চীনমুখী করার চেষ্টা করবেন।

ওয়াশিংটন-বেইজিং টানাপোড়েনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র টেক্সাসের হিউস্টনে অবস্থিত চীনা কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে
ওয়াশিংটন-বেইজিং টানাপোড়েনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র টেক্সাসের হিউস্টনে অবস্থিত চীনা কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে

 

জনমত জরিপে ট্রাম্প তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের চেয়ে ডাবল জিডিটে পিছিয়ে রয়েছেন। তবে চীনও ট্রাম্পকে বেকায়দায় ফেলার ক্ষমতা রাখে। চীন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, ভুট্টা, শুকরের মাংসসহ বিভিন্ন পন্য আমদানি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। এখন চীন সেসব আমদানি বন্ধ করে দিলে বেকায়দায় পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের খামারিরা। এতে ট্রাম্পের ভোট ব্যাপকভাবে কমবে।

তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এ বিরোধ শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়, তার দীর্ঘমেয়াদী। এটা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে চীন এখন বিশ্বের আরেক সুপারপাওয়ার। তবে যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে, চীন যেন কোনোভাবেই তাকে ছাড়িয়ে যেতে না পারে। এটা আমেরিকার জাতীয় স্বার্থের ব্যাপার। এই জায়গায় আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি দীর্ঘমেয়াদে অপরিবর্তিত রয়েছে এবং থাকবে।

চীনকে মোকাবিলায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দিয়েছিলেন এশিয়াকে। ট্রাম্পও এখন সেই পথে হাটছেন। এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের অবস্থান কাছাকাছি। এ কারণে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন জয়ী হলেও চীনের সঙ্গে তাদের রেষারেষি শেষ হচ্ছে না।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে