যুক্তরাষ্ট্রের কবল থেকে বের হয়ে যাচ্ছে ইসরাইল!

চীনের ইসরাইলপ্রীতি - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ২৬ মে ২০২০, ২৩:৪৬

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে ইসরাইল। ঘনিষ্ট হচ্ছে আমেরিকার ঘোষিত শত্রু চীনের সাথে। একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা উপেক্ষা করে ইসরাইল চীনের সাথে বিভিন্ন ধরনের চুক্তি করে যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি খাতসহ ইসরাইলের বড় বড় অবকাঠামোতে চীনকে বিনিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে ইসরাইল।

কয়েক বছর ধরে ইসরাইলের সাথে চীনের বহুমাত্রিক সর্ম্পক গড়ে উঠছে। ইসরাইল ভূমধ্যসাগরে গুরুত্বপূর্ণ হাইফা বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়েছে চীনা একটি কোম্পানিকে। এই বন্দরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ নৌ বহর। ট্রাম্প প্রশাসন বারবার ইসরাইলকে মৌখিকভাবে এ বিষয়ে সতর্ক করলেও তা আমলে নেয়নি ইসরাইল।

এছাড়া চীনকে দেয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ রেল অবকাঠামো নির্মানের কাজ। ইসরাইলে চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিষয়ক সব ধরনের সতর্কতা। এমনকি যে করোনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অভিযুক্ত করছে চীনকে সেই করোনা বিষয়ক সহায়তার জন্যও ইসরাইল চুক্তি করেছে চীনা প্রতিষ্ঠানের সাথে।

চীনের সাথে ইসরাইলের দিন দিন ঘণিষ্ট সর্ম্পক ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য উদ্বেগের কারন হয়ে দেখা দিয়েছে। ইসরাইল প্রযুক্তি ক্ষেত্রে খুবই উন্নত একটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা ইসরাইলের সাথে ঘণিষ্ঠতার সুযোগে ইসরাইলের উন্নত প্রযুক্তি পুরোপুরি হাতিয়ে নিতে পারে চীন। আর সেটা চীন কাজে লাগাতে পারে সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে।

নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি ঘোষণা করেছেন চীন তার পুননির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে যা যা করার দরকার তার সবই করবে। ট্রাম্প সরাসরি বলেছেন, চীন চাইছে না আমি আবার হোয়াইট হাউজে ফিরে আসি। চীন চাইছে জো বাইডেন এ নিবাচনে জিতুক। এ কারনে ট্রাম্প প্রশাসন আগামী নির্বাচনে চীনকে শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শঙ্কা ইসরাইলের প্রযুক্তি চীনের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে। ইসরাইল- চীন সম্পর্কের কারনে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা যাতে হুমকির মুকে না পড়ে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরে অভিযোগ করে আসছে ইসরাইল বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা মেনে চলছে না। ইসরাইলী প্রযুক্তি ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালে ইসরাইলে বড় ধরনের ১৭টি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তির ৬টি সম্পন্ন হয়েছে চীনের সাথে। এ চুক্তির মূল্যমান ৩২৫ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। কিভাবে চীনমুখী ইসরাইলকে নিয়ন্ত্রন করা যায় তা নিয়ে দেশটির সাথে আলোচনা শুরু করেছে।

কঠোর লকডাউনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও ১৩ মে ছুটে গেছেন ইসরাইলে। তার ইসরাইল সফরের কারন হিসেবে বলা হয়েছে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ইসরাইলের সাথে যুক্তকরণ। ইরান প্রসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন পম্পেওর ইসরাইল সফরের মূল কারন এটা নয়। মূল কারন চীন।

২০১৯ সালে মাইক পম্পেও সর্তক করে বলেন, বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইসরাইল সতর্ক না হলে দুই দেশের মধ্যে গোয়েন্দা সহযোগিতা সঙ্কুচিত হতে পারে। এ ছাড়া নিরাপত্তা সহযোগিতাও সঙ্কুচিত হতে পারে।

বিদেশি বিনিয়োগ যাচাই করার জন্য ইসরাইল একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এ টাস্কফোর্স অর্থনীতি, যোগাযোগ, পরিবহন, জ্বালানিসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখবে। তবে চীন সরকারের অনুরোধে উচ্চ প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের বিষয়টি টাস্কফোর্সের পরীক্ষার আওতা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

ইসরাইল সরকারের উচ্চ পদস্থ অনেকে মনে করেন নিরাপত্তা বিষয় নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কৌশল নিয়েছে। ইসরাইলকে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সাইবার এবং রোবটিক্স শিল্পের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল করতে চায়। ইতোমধ্যে ইসরাইলের অর্থ মন্ত্রনালয় থেকে গত বছরের শেষে সতর্ক করে বলা হয় প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বিনিয়োগের ওপর মাত্রতিরিক্ত নির্ভরশীল। অপরদিকে বিদেশী বিনিয়োগ যাচাই বাছাই থেকে প্রযুক্তি খাতকে বাদ দেয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন তেল আবিবের ওপর অসন্তুষ্ট ।

ইসরাইলের এই চীনমুখী নীতিকে ওয়াশিংটন দেখছে দেশটির নিরাপত্তা ভাবনা উপেক্ষা হিসাবে। বিশেষ করে ভ‚মধ্যসাগরে ষষ্ঠ নৌ বহরের অবস্থান নিয়ে মুলত শঙ্কা বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত চীনা সম্ভাব্য গোয়েন্দা কার্যক্রম থেকে রক্ষার জন্য ষষ্ঠ নৌবহর অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হতে পারে। এমন আলোচনাও আছে।

ইসরাইলের কর্মকর্তারা বলছেন, হাইফা বন্দর ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যে চীনা প্রতিষ্ঠানটি খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। চীনা প্রতিষ্ঠানটি এ বন্দরকে একটি অটো সিস্টেম বন্দরে পরিণত করেছে। এর ফলে শ্রমিক ছাড়াই বছরে কমপক্ষে ৪ কোটি ২০ লাখ শিপিং কনটেইনার ইউনিট ওঠা নামা করবে অটোমেটিক সিস্টেমে। এতে মানুষের সহয়তা লাগবে খুবই ন্যূনতম।

আমেরিকানদের আপত্তি উপেক্ষা করে ইসরাইল চীনের সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করেছে। সেটি হলো রেড-মেড প্রজেক্ট। এটি ৩০০ কিলোমিটার রেললাইন প্রকল্প। ভ‚মধ্যসাগর এলাকার শহর আশকেলন থেকে এ রেললাইন পৌছবে রেড সি’র ইলাত বন্দর পর্যন্ত। এতে চীন ২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার বিনিয়োগ করছে।

চীনের সাথে এ চুক্তির বিষয়ে ইসরাইলের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকেও বিরোধীতা করা হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতির বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে নেতানিয়াহু প্রশসানকে। কিন্তু তা আমলে নেয়া হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসন থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে এ রেল নেটওয়ার্ক চীনা বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পের সাথে যুক্ত হতে পারে। চীনা মহা এ রেল প্রকল্পকে আমেরিকা বিশ্বব্যাপী তার আধিপত্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে।

ইসরাইলে চাইনিজ নেভি ডকস। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
ইসরাইলে চাইনিজ নেভি ডকস। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

 

এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র করোনা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য চীনকে সরাসরি দোষারোপ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইসরাইলে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা উপকরণ সরবরাহ এবং এ বিষয়ক অবকাঠামো তৈরির জন্য ইসরাইল চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বেইজিং জেনোমিক ইনস্টিটিউটের সাথে। যা যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুদ্ধ করছে।

চীনের সাথে মুক্ত বানিজ্য চুক্তি নিয়ে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল । দেশটির আভ্যন্তরিন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে এই আলোচান পিছিয়ে যায়। নেতানিয়াহু ইসরাইলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করার পর এ আলোচনার উদ্যোগ আবার শুরু হয়েছে।

চীনের সাথে ইসরাইলের এ বানিজ চুক্তি হলে ইউরোপয়ী ইউনিয়নের ওপর ইসরাইলের নির্ভরতা কমবে। ইসরাইলের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক অনেক দিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। পশ্চিম তীরের দখলকৃত অংশ ইসরাইলের সাথে যুক্ত করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এতে ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর ইসরাইল নাখোশ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাথে কিছু বানিজ্য চুক্তিও হুমকির মুখে রয়েছে।

তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ আরো জটিল হয়ে উঠছে। চীন-ইসরাইল ঘনিষ্ট সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চিন্তিত মুলত প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার কারনে। ইসরাইল প্রযুক্তির দিক দিয়ে একটি উন্নত দেশ। আর চীন -ইসরাইল সম্পর্কের কারনে সম্ভাবনা রয়েছে ইসরাইলের এ উন্নত প্রযুক্তি চীনা সামরিক এবং বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসনের আশঙ্কা চীন দুই ভাবে ইসরাইলের এ প্রযুক্তি হস্তগত করতে পারে। ইসরাইলের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্পর্ক বাড়ছে। এরফলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়বে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সর্তকতা উপেক্ষা করার কারনে তেলআবিব ঝুকির মধ্যে আছে। অনেকের মতে ইসরাইল রশির ওপর হাটছে ।

জাতিসংঘের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষাসহ ইসরাইলকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলের আজকের শক্তির মূল উৎস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে এভাবে একের পর এক উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শত্রæর সাথে ইসরাইলের এভাবে ঘণিষ্ঠতায় ইসরাইলকে মুল্যদিতে হকে পারে। আবার অনেকের মতে ইসরাইল চীনা উত্থানকে অস্বীকার করতে পারছে না।

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন ইসরাইল এখন নিজের শক্তির ওপর দাড়িয়েছে। এখন দেশটি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে স্বাধীনভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তৈরির দিকে জোর দিয়েছে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে চীন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বদ্বী। বিশ্বে আধিপত্যে বিস্তারের ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী হতে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। সে কারনে ইসরাইল এখন প্রকাশ্যভাবেই ট্রাম্প প্রশাসনকে উপেক্ষা করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খারাপ খবর হলো তার একান্ত অনুগত ইসরাইল যদি এভাবে পক্ষপুট থেকে বের হয়ে যায় তাহলে এর প্রভাব অন্য মিত্র দেশগুলোর ওপর পড়বে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে