তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান জোট গঠনের সম্ভাবনা

মাহাথির-ইমরান - সংগৃহীত

  • আলফাজ আনাম
  • ০৭ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:১৮


মুসলিম বিশ্বে একটি নতুন জোট গঠন নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ দীর্ঘদিন থেকে এমন জোট গঠনের কথা বলে আসছিলেন। গত জুলাই মাসে তিনি তুরস্ক সফরে গিয়ে স্পষ্ট ভাবে জানান যে তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান মিলে মুসলিম দেশগুলোর স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখতে পারবে। এরপর আর্ন্তজাতিক ফোরামে তিন দেশের নেতার মধ্যে যৌথ অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশনে তিন দেশ অনেকটা এক সূরে কথা বলে।


তুরস্ক সফরের সময় ড. মাহাথির মোহাম্মদ যে জোট গঠনের ইঙ্গিত দেন সে ব্যাপারে তুরস্ক ও মালয়েশিয়া দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। এ ধরনের জোট গঠিত হলে সম্ভবত আরো কিছু দেশ এর সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় যোগ হতে পারে মুসলিম বিশ্বের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ন আরো তিনটি দেশ ইরান, ইন্দোনেশিয়া এবং কাতার। ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ আরোপ করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাশিয়া ও চীনের সাথে ইরান ঘনিষ্ট সর্ম্পক বজায় রেখে চলছে। অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও প্রতিকুলতার মধ্যে দেশটি টিকে আছে।


মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পরমানু শক্তিধর দেশ পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ট মিত্র। দেশটির আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে অস্থিরতা থাকলেও চীনের সাথে সর্ম্পকে ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় একই রকম। অপরদিকে চীনের সাথে মালয়েশিয়ার ভালো বোঝাপড়া রয়েছে। দক্ষিন চীন সাগরে চীনের প্রভাব বজায় রাখার জন্য মালয়েশিয়ার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। কৌশলগত নিরাপত্তার জন্য মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান উভয় দেশ চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ন।


কাতর প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ এক দেশ। এখন চীনের জ্বালানী চাহিদার ৭০ ভাগ পুরন হয় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে। যা দেশটির পরিবেশের ওপর মারাত্নক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। চীন জ্বালানী খাতে কয়লা নির্ভরতা কমানো ও জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালয়েশিয়া ও কাতারের ওপর নির্ভর করতে পারে। মালয়েশিয়াও যথেষ্ট তেল ও গ্যাসের মজুদ রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া বড় আকারের কোনো তেল গ্যাস উৎপাদকারী দেশ নয়। তবে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে বিশেষ করে মালাক্কা প্রনালীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালয়েশিয়ার মতো ইন্দোনেশিয়াও কম গুরুত্পূর্ন নয়। অপরদিকে তুরস্ক বসফরাস প্রনালী নিয়ন্ত্রন করছে। যা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার জন্য কৌশলগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এর প্রভাব ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য সহ ইউরোপের দেশগুলোর জন্য।


জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশনে মুসলিম দেশগুলোর চলমান সমস্যা নিয়ে অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোগান। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তিনি যতটা জোরালো বক্তব্য রেখেছেন কোনো আরব নেতা এই সমস্যার কথা এভাবে তুলে ধরেননি। তিনি রোহিঙ্গা ও কাশ্মীর ইস্যুতেও কথা বলেছেন। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের মতো দেশ তুরস্ককে সম্ভবত মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে দেখার বিষয়ে একমত হয়েছে। ফলে এ ধরনের জোট হতে পারে ওআইসির চেয়ে বেশি কার্যকরী। প্রশ্ন হচ্ছে আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে এই তিন দেশের প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা আসলে কতটুকু ?


যদি তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান একটি জোট গঠন করতে পারে তার প্রভাব বিভিন্ন দেশের সাথে সর্ম্পকের ওপর পড়তে পারে। এ ধরনের জোটে যদি ইরানকে সম্পৃক্ত করা হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির হিসেব বদলে দিতে পারে। কারন মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক ও ইরানকে বাদ দিয়ে এ অঞ্চলের কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যু আড়াল করার যে প্রবনতা তা আর সম্ভব হবে না। এছাড়া এসব দেশের ভূকৌশলগত অবস্থান কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ন নয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে এ জোটে যদি ইরানকে সম্পৃক্ত করা যায় তাহলে বিশে^র সমুদ্র বানিজ্যর প্রধান কেন্দ্রগুলো এই দেশগুলোর নিয়ন্ত্রনে থাকবে। মালাক্বা প্রনালী, হরমুজ প্রনালী , বসফরাস সাগর ও ওমান উপসাগরের নিয়ন্ত্রন এ দেশগুলোর হাতে। সমুদ্র বানিজ্য এখন পর্যন্ত রেলের চেয়ে খরচ তিন গুন কম। যা বিশ্ব বানিজ্যে মুসলিম দেশগুলো শুধু সুবিধা পাবে না বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।


তুরস্ক ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান এক ধরনের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহন করেছেন। দীর্ঘদিন থেকে তুরস্কে পররাষ্ট্রনীতি আবর্তিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুসরন করে। কিন্তু তুরস্কের নীতি এখন অনেকটা বদলে গেছে। দেশটি একই সাথে রাশিয়া ও চীনের সাথে ঘনিষ্টতা বাড়াচ্ছে। আসিয়ান দেশগুলোতে তুরস্কের গুরুত্বপূর্ন তিনটি বানিজ্য অংশীদার দেশের একটি হচ্ছে মালয়েশিয়া। অপর দুই দেশ ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ড। অপরদিকে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশের দুয়ার হচ্ছে তুরস্ক। স্বাভাবিক ভাবে যে কোনো বানিজ্য নির্ভর দেশের কাছে তুরস্ক অনেক গুরুত্বপূর্ন।


মুসলিম বিশ্বের স্বার্থরক্ষা নিয়ে তুরস্ক যেভাবে সোচ্চার হয়েছে তাতে মুসলিম দেশগুলোতে আংকারার গুরুত্ব বেড়েছে। মুসলিম বিশ্বের বেশ কিছু ইস্যুতে মালয়েশিয়া এবং তুরস্ক যৌথ অবস্থান নিয়েছে। এরমধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যু, রোহিঙ্গা ইস্যু, কাশ্মীর ইস্যু এবং ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারনার মতো বিষয় রয়েছে। জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের অধিবেশনের ফাকে ইসলামোফোবিয়া নিয়ে এক সেমিনারে অংশ নিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোগান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম সর্ম্পকে যে ভুল ধারনা ও অসত্য প্রচারনা চলছে তার নিয়ে কথা বলেছেন দুনেতা। এরপর ঘোষণা দেয়া হয় তিন দেশ মিলে একটি টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ইসলাম সর্ম্পকিত বিভ্রান্তির জবাব দেয়া হবে। অনেকে মনে করছেন আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে মুসলিম বিশ^ বিশেষ করে মুসলমানদের প্রকৃত সমস্যাগুলো মোকাবিলার দিকে এই তিন নেতা একমত হয়েছেন।


এ ধরনের জোট গঠনের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার ওপর। এই মুহুর্তে বিশ্ব রাজনীতিতে এই দুনেতার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা ও আর্ন্তজাতিক রাজনীতির গতি প্রকৃতি বোঝার মতো পারঙ্গমতা ও সক্ষমতা এদের চেয়ে মুসলিম বিশ্বে আর কোনো নেতা নেই। দুনেতা দীর্ঘ সময় নিজ দেশ শাসন পরিচালনা করেছেন। উভয় দেশে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করতে পেরেছে। স্থিতিশীলতা ও জনমত তাদের পক্ষে আছে। সে তুলনায় ইমরান খান নবীন এবং পাকিস্তান নানা সমস্যায় জর্জরিত।


মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ গত জুলাইয়ে যখন আঙ্কারা সফর করেন তখন তাকে জমকালো সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই সফরে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। মাহাথির ও এরদোগান দুনেতার মধ্যে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, দুদেশের মধ্যে ঘনিষ্ট সর্ম্পক মুসলিম উম্মাহর সঙ্কট নিরসনে ভুমিকা রাখবে। তিনি বলেন মুসলিম বিশ্বের স্বার্থের জন্য তুরস্ক , পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ার মধ্যে একাত্নতা ও ঐক্যবদ্ধ সর্ম্পক জরুরি। মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, আমরা যদি অতীতে দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো মুসলিম বিশ্বের সঙ্কটে তুরস্ক ত্রানকর্তা হিসাবে আর্বিভুত হয়েছে। এরদোগান মালয়েশিয়াকে ডি-৮ এর গুরুত্বপূর্ন সদস্য এবং তুরস্কের কৌশলগত মিত্র বলে উল্লেখ করেন। মাহাথির মোহাম্মদ ও রিজেপ তাইয়েপ এরদোগান ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন। মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার নানা দিক আলোচনায় গুরুত্ব পায়। তুরস্ক সফরের আগে মাহাথির মোহাম্মদ গত মার্চে পাকিস্তান সফর করেন।


মাহাথির মোহাম্মদ তার্কিশ এরো স্পেস ইন্ডাস্টিজ পরিদর্শন করেন। তুরস্কের নির্মিত অ্যাটাক হেলিকপ্টার, মনুষ্যবিহীন বিমান ও ট্রেনিং এয়ার ক্রাফটের একটি মহড়া দেখেন। তুরস্ক বিভিন্ন দেশে এ ধরনের অ্যাটাক হেলিকপ্টার ও ড্রোন বিক্রি করছে। ধারনা করা হচ্ছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অংশ হিসাবে মালয়েশিয়া তুরস্ক থেকে বড় ধরনের সামরিক সরঞ্জাম কেনার চুক্তি করতে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে বানিজ্য বাড়ছে। যদিও মালয়েশিয়াতে তুরস্কের রফতানির পরিমান ৩৬৫ মিলিয়ন ডলার, মালয়েশিয়ার থেকে আমদানির পরিমান ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। তুরস্ক এখন মালয়েশিয়াতে রফতানি বাড়াতে চাইছে। এই রফতানির প্রধান খাত হতে যাচ্ছে এরোস্পেস খাত এবং সামরিক খাতে। এরমধ্যে যুদ্ধযান, ড্রোন এবং রিমোট কন্ট্রোল উইপন সিস্টেম আছে। মালয়েশিয়া তুরস্কের বিমান বন্দর পরিচালনা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় আকারের বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া হালাল ফুড ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্টান তুরস্কের দিকে ঝুকে পড়েছে।


বিশ্লেকরা বলছেন মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে সর্ম্পক জোরদার করছে তুরস্ক। মাহাথির মোহাম্মদও দীর্ঘদিন থেকে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ ভুমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছেন। মাহাথির মোহাম্মদের তুরস্ক সফরের পর দুদেশের মধ্যে ঘনিষ্টতা যেমন বাড়বে তেমনি আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে মুসলিম দেশগুলোর নেতৃতেও¡ বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারে।


তুরস্ক-মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানের জোট গঠন সম্ভবত এখনও ধারনাগত পর্যায়ে আছে। কিছু কিছু ইস্যুতে তিন দেশ এক সাথে কাজ করছে। ইরান এবং কাতারের সাথে তুরস্ক গভীর সর্ম্পক বজায় রেখে চলছে। এই পরিকল্পনা কতটা বাস্তব রুপ পাবে তা দেখার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।