মুসলিমদের ওপর এত নিষ্ঠুর চীন!


  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৫:০৬

চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের মুসলিমদের ওপর ‘নির্মম’ নির্যাতন চালাচ্ছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ রয়েছে- উইঘুর জাতিগোষ্ঠির এক কোটি ২০ লাখ লোককে নির্বাসিত করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশ মুসলিম। বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়েছে ৮০ লাখ মানুষকে। মুসলিম জনসংখ্যা যাতে না বাড়ে, সেজন্য নারীদের বন্ধ্যা করা হচ্ছে। ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। শিশুদেরকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। নির্যাতনে বন্দিশিবিরে মারা যাচ্ছেন অনেকে। আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘গণহত্যা’ চলছে উইঘুর মুসলিমদের ওপর। তাদের কান্নায় তো চীনা কর্তৃপক্ষের হৃদয় গলছে না; আন্তর্জাতিক চাপ, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন- কোনো কিছুতেই নিবৃত করা যাচ্ছে না চীনকে।

আলিমকান তুর্দিনিয়াজ উইঘুর মুসলিমদের একজন। তিনি যখন সিদ্ধান্ত নিলেন মাতৃভূমি ছাড়ার সময় এসে গেছে, তখন রৌদ্রস্নাত গ্রীষ্ম। যখন তিনি জানতে পারলেন, চীনা কর্তৃপক্ষ তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেছে, তিনি ভাবলেন, আর দেশে থাকার সুযোগ নেই। অথচ এই মাতৃভূমিতেই জীবনের পুরো সময় কেটেছে তার।

তুর্দিনিয়াজ বললেন, ‘২০১২ সালে যখন চীনা কর্তৃপক্ষ তার মেয়েকে হেফাজতে নিয়ে যায়, তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ। ধর্মীয় স্কুলে যাওয়ার কারণেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।

তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন, কারণ, তার পরিবার ঘুষ দিয়ে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিলেন। তুর্দিনিয়াজের বয়স এখন ৪৫। এখন তিনি তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে প্রায় আট বছর ধরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বসবাস করছেন। এখানে সমস্যা নেই, তবুও মনটা বেশ ভারী। জিনজিয়াংয়ে থাকা পরিবারের অন্য সদস্য এবং স্বজনদের কাছে ফিরে যেতে চাচ্ছে তার মন।

এ অঞ্চলে এখন এক কোটি উইঘুরের বাস। জিনজিয়াংয়ের জনসংখ্যার মধ্যে ৪৫ শতাংশেরও বেশি তার্কিক মুসলিম। সেখানে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি ইস্তাম্বুলের চীনা কনস্যুলেটের বাইরে প্রায় ১০০ লোক জড়ো হন। পরিবারের সদস্যদের খবরাখবর জানানোর দাবিতে ১৮ দিন ধরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন তারা। ২০১৭ সাল থেকে স্বজনদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই বলে জানান বিক্ষোভকারীরা।

তুরস্কের আনাদুলু বার্তা সংস্থাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তুর্দিনিয়াজ বলেন, চীনের তথাকথিত ‘রাজনৈতিক পুনঃশিক্ষা শিবিরে’ রাখা হয়েছে আমার বড়ভাই, দুই সন্তান ও স্বামীসহ আমার বড় বোন, অন্য বোনের মেয়েজামাই ও আমার এক বন্ধুকে।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চীনা কর্তৃপক্ষ তাদেরকে পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেয়।

তিনি বলেন, ‘এটা যে ফাঁদ ছিল, তা আমরা বুঝতে পারিনি। ওই বছর এবং পরে যারা বিদেশে গেছে, তারা সবাই এখন বন্দিশিবিরে কিংবা অন্য কোথাও। অনেকের হদিসও আমরা জানি না।

তুর্দিনিয়াজ জানান, কাউকে কাউকে কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, তারা পরিবারের সদস্যদের একনজর দেখার চেষ্টায় টিকটক এবং ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চেক করেন। যোগাযোগের অন্য কোনো মাধ্যম নেই।

তিনি বলেন, ‘আমার বড় ভাই নূরমেমেত শিক্ষিত। চীনে ব্যবসা আছে। তার শিক্ষার প্রয়োজন ছিল না। পরে জানলাম, তাকে দাড়ি রাখার কারণে আটক করা হয়েছে।’

তুর্দিনিয়াজের বোন হেলিমা এবং মেয়েজামাই ওসমান রোজিকে তাদের দুই সন্তানসহ বন্দিশিবিরে নেওয়া হয়। তার ছোট ভাইয়ের খবর নেই।

তুরস্কে ব্যবসা করা তুর্দিনিয়াজ ২০১৭ সাল পর্যন্ত চীন ও তুরস্কের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত ছিলেন।

অশ্রু ছেড়ে দিয়ে তিনি বলতে থাকলেন, ‘আমার ছোট ভাই এলজাত ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত আমার ব্যবসায় হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করছিল। আমাদের মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে ২০১৭ সালে বাড়িতে ফিরে যায় সে। চীনে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা জানি না, সে ক্যাম্পে, কারাগারে নাকি অন্য কোথাও।’

তুর্দিনিয়াজ অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলেন না, আর চীনে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের অবস্থা জানার জন্য সাহায্য ভিক্ষা করছিলেন।

২০১৫ সালের মার্চে দুই ছেলেকে নিয়ে তুরস্কে গিয়েছিলেন আমিনা ওয়াহিদ। তুর্দিনিয়াজের মতো ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনিও তুরস্কের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রফতানি করছিলেন।

এক সকালে তিনি দেখলেন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। চীনা-ভিত্তিক ম্যাসেজিং অ্যাপ উইচ্যাট ব্যবহার করে তিনি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। কিন্তু, ওইদিন আর যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, সবার মোবাইল থেকে অ্যাপটি সরিয়ে দেওয়া হয়, যাতে কেউ বিদেশে যোগাযোগ করতে না পারে।

আনাদুলুকে আমিনা বলেন, পরে জানতে পারি, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে চীনা কর্তৃপক্ষ আমার বড়ভাইকে নিয়ে যায়। খবরটি আমাকে উইচ্যাটের মাধ্যমে জানায় আমার বোন। এর একটু পর আমার বড় বোন এবং আরেক বড় ভাইকে নিয়ে যাওয়া হয়।

সর্বশেষ নিজ শহর জিনজিয়াংয়ে যাওয়ার পর তুরস্কে ফিরে আসাটাকে ‘একেবারে অলৌকিক’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। বলেন, ‘ব্যবসা আছে বলে যেতে হয়েছিল। বাড়ি বিক্রি করতে চেয়েছিলাম, পারিনি।’

আমিনার বোনকে প্রথমে ২০১৬ সালে ক্যাম্পে নেওয়া হয় এবং শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তিন মাস পর ছেড়ে দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, ‘নামার পর গোপনে হাসপাতালে বোনের সঙ্গে দেখা করি। চীনা কর্তৃপক্ষের নজরে আসার আগে তিনি আমাকে দেশ ছাড়তে বলেন। এরপর এক রাতের মধ্যেই তল্পিতল্পা গুছিয়ে তুরস্কের প্রথম ফ্লাইটে চলে আসি।’

বোনের বর্ণনা অনুযায়ী ক্যাম্পগুলো ‘ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো’। ১৬ বছরের তরুণী থেকে ৭০ বছরে বৃদ্ধা পর্যন্ত- সবাইকে আটকে রাখা হয়েছে সেখানে।

তিনি জানান, ‘আমার বোন বলল, প্রতিদিন সকালে এক ঘণ্টা দৌড়াতে বাধ্য করা হয়। বয়সের ভারে যারা হাঁটতে পারেন না, তাদেরও দৌড়াতে হয়। ক্যাম্পগুলোর কঠিন অবস্থার কারণে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। সকালে একটি বান দেওয়া হয়, বিকালে সুপ, রাতে আরেকটি বান। এর বাইরে আর কিছু দেয় না। সবসময় একই রকম খাবার। এই সামান্য খাবার পাওয়ার জন্য চীন সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসতে হয় এবং চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির গান গাইতে হয়।’

তার বোনকে ২০১৭ সালে আবার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর থেকে তার বোন কিংবা দুই ভাই কেমন আছেন, জানেন না আমিনা।

চীনের বিরুদ্ধে বিপুল উইঘুর নারীকে ক্যাম্পে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেখানে নারীদের সন্তান ধারণে অক্ষম করতে স্টেরিলাইজেশনে বাধ্য করার মতো ভয়ঙ্কর প্রতিবেদনও এসেছে।

চীনের জিনজিয়াং-নীতির সমালোচনায় সরব অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এক কোটি ২০ লাখ উইঘুরকে নির্বাসিত করার অভিযোগ রয়েছে দেশটির বিরুদ্ধে, যাদের অধিকাংশই মুসলিম।

৩৯ বছর বয়সী মির্জাহমেত ইলিয়াসোগলু ২০০৭ সাল থেকে তুরস্কে বসবাস করেন। পরে তিনি তুরস্কের নাগরিক হন। প্রয়াত বাবার স্বপ্ন পূরণে তিনি চীনে বিশ^বিদ্যালয় ডিগ্রি নিয়েছেন, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেছেন তুরস্কে।

ইলিয়াসোগলু ২০১৪ সালে ভাই ও মাকে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তারা ইস্তাম্বুলের পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণ করেন; এখানে তারা জিনজিয়াংয়ের অবরুদ্ধ জীবনের বদলে একটা মুক্ত জীবনের স্বাদ পান। ইলিয়াসোগলুর জীবনে দুঃস্বপ্ন নেমে আসে ২০১৭ সালে, যখন তুরস্ক ভ্রমণের পথে তার ভাই হেলেমেমেট ইলিয়াসকে আটক করা হয়।

পরে তিনি জানতে পারেন, তার শ্যালক আবদুর রহমানকেও চার বন্ধুসহ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অশ্রু সংবরণের চেষ্টা করে তিনি বলেন, ‘আমি বন্দি নই, তবু মনে হচ্ছে আমি বন্দিশিবিরে আছি। আমার সবাই তো বন্দিশিবিরে! চীন সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ করছে, এর অন্য কোনো সংজ্ঞা নেই। চীন দাবি করে, জিনজিয়াংও চীনের অংশ, কিন্তু নিজের নাগরিকদের মতো সমান চোখে কখনও তারা জিনজিয়াংকে দেখেনি।’

চীনের বিতর্কিত ক্যাম্পগুলোতে ইলিয়াসোগলুর এমন স্বজনও রয়েছেন, যার বয়স ৯০-এর ওপরে। দুই বছরের শিশুও আছে। এলাকা থেকে পাওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের জোর করে আলাদা করে রাখা হয়।

তুর্দিনিয়াজের বক্তব্য অনুযায়ী, জিনজিয়াংয়ের প্রায় ৮০ লাখ মানুষকে ‘পলিটিক্যাল রি-এডুকেশন ক্যাম্পে’ বন্দি করে রাখা হয়েছে।

শোকে মূহ্যমান ইলিয়াসোগলু বললেন, ‘ক্যাম্পগুলোতে মারা যাওয়াদের মধ্যে তুরস্কের একটি বিশ^বিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট করা আমার এক বন্ধুও আছে। পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের জীবন নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন বলে জানান তিনি।

তুর্দিনিয়াজ, আমিনা ও ইলিয়াসোগলু- সবাই আলাদাভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মুসলিমদের ওপর চীন সরকারের এ অমানবিক আচরণ নিয়ে কথা বলার আহ্বান জানান।

ইলিয়াসোগলু বলেন, ‘দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে নীরবতার অর্থ হলো অন্যায়কে অনুমোদন দেওয়া।’

মার্কিন কংগ্রেসনাল এক্সিকিউটিভ কমিশন অন চায়না সংক্ষেপে সিইসিসি’র প্রতিবেদনকে স্বাগত জানালেও ইলিয়াসোগলুর বক্তব্য, এটা বেশ দেরিতে আসা বিবৃতি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর ও অন্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চীন ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং সম্ভবত গণহত্যা’ চালিয়েছে।

এতে বলা হয়, চীন সরকার উইঘুর এবং অন্য সংখ্যালঘুদের পরিবার, তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় কার্যক্রম ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।

সিইসিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, উইঘুর এবং অন্য সংখ্যালঘু নারীদের জোরপূর্বক বন্ধ্যাত্বকরণের বিপুল প্রমাণ রয়েছে। প্রায় পাঁচ লাখ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুল-বয়সের শিশু রয়েছে, যাদের পরিবার থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, এসব নির্মম অপরাধের জন্য চীন সরকারই যে দায়ী, তা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট ঘটনা রয়েছে। উইঘুর, কাজাখ, তার্কিক এবং মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে গণহত্যাও রয়েছে এসব অপরাধের মধ্যে।

২০১৮ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে গণহারে আটক, নির্যাতন, জোরপূর্বক রাজনৈতিক শিক্ষাদান এবং জিনজিয়াংয়ের মুসলিমদের ওপর গণনজরদারির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বন্দিশিবির পরিচালনার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে চীন। তাদের ভাষায়, তারা উইঘুরদের নতুন করে শিক্ষাদান করছে।