ক্যাট স্টিভেন্সের ইসলাম গ্রহণের বিস্ময়কর গল্প

-

  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ১৫ জানুয়ারি ২০২১, ১০:১৯

নির্যাতনের বাহন হিসেবে চিত্রায়িত করে ইসলামকে যুদ্ধবিগ্রহ ও অন্যায়-অবিচারের জন্য দায়ী করা এখন ওয়েস্টার্ন ফ্যাশন। ইসলামের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ যে অমূলক, তা বিবেকবানরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন। তারপরও পৃথিবীতে মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটে, যা আমাদের চোখে সত্য ও মিথ্যার ব্যবধানকে পরিচ্ছন্ন করে তোলে। পপ-তারকা ক্যাট স্টিভেন্সের জীবন বদলানোর ঘটনাও এ-রকম। তিনি এখন ইউসুফ ইসলাম।

১৯৬৯ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন স্টিভেন্স। তার শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ হয়ে পড়ে যে, চিকিৎসকরা তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছিলেন। প্রায় এক বছর হাসপাতালে থাকার পর তার মধ্যে বড়সড় মানসিক পরিবর্তন ঘটে। শুরুতে বৌদ্ধ ধর্ম, পরে প্রাচ্যের নানা ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর তার গানের ভাবধারা বদলে যেতে থাকে এবং সেগুলো হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক অর্থবহ।

১৯৭৬ সাল। আমেরিকার ম্যালিবু সৈকতে সাঁতার কাটতে গিয়ে প্রায় ডুবতে বসেছিলেন তিনি। মৃত্যুর ভয়ে চিৎকার করছিলেন- Oh God! If you save me I will work for you. বলতে না বলতেই অপ্রত্যাশিত উল্টো একটি ঢেউ তাকে তীরে আছড়ে ফেলে। এই ঘটনার পর থেকে ক্যাট স্টিভেন্সের মনে আমূল পরিবর্তন আসে। পাশ্চাত্যের জড়বাদী জগতের পেছনে না দৌড়ে আধ্যাত্মিক সত্য অনুসন্ধানের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি।

স্টিভেন্সের জন্ম ১৯৪৮ সালে, ব্রিটেনের এক খ্রিস্টান পরিবারে। তার বাবা ছিলেন গ্রিক অর্থোডক্স ও মা সুইডিশ ক্যাথলিক। অথচ, স্টিভেন্স জীবনযাপন করতেন প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত অনুযায়ী। মায়ের উৎসাহ পেয়ে স্টিভেন্স গান শেখেন। ১৮ বছর বয়সে তার সুপারহিট একক ‘আই লাভ মাই ডগ’-এর মধ্য দিয়ে পপ সংগীতাঙ্গনে তার আত্মপ্রকাশ। তারপর থেকেই একের পর এক হিট অ্যালবাম আসতে থাকে বাজারে। ২০ বছর বয়স হওয়ার আগেই তার অ্যালবামগুলো ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করে।

ইসলাম গ্রহণের আগে যেসব অ্যালবাম স্টিভেন্সকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ টি ফর দ্যা টিলারম্যান, টিজার অ্যান্ড ফায়ারক্যাট, মনা বৌন জ্যাকন, ক্যাচ বুল অ্যাট ফোর, বুদ্ধ অ্যান্ড দ্য চকোলেট বক্স, ফরেইনার, ম্যাথু অ্যান্ড সান এবং হ্যারল্ড অ্যান্ড মাউড।

জানার প্রতি স্টিভেন্সের আজন্ম আগ্রহ। তাই, ভাই ডেভিড গর্ডন জেরুজালেম ঘুরতে গিয়ে তার জন্য একটি পবিত্র কুরআন নিয়ে আসেন। ধারণা করা হয়, তখন থেকেই স্টিভেন্সের ইসলামকে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। কুরআন পড়ে স্টিভেন্স এতই অভিভূত হন যে, তিনি ইসলাম সম্পর্কে সার্বিক গবেষণা ও পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নেন। স্টিভেন্সের ভাষায়Ñ ‘পবিত্র কুরআনের যে দিকটি সব কিছুর আগে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা হলো, এ মহাগ্রন্থের মলাটে লেখকের নাম নেই। শুরু করলাম কুরআন অধ্যয়ন। যতবারই এ মহাগ্রন্থ পড়তাম ততবারই প্রশান্তি অনুভব করতাম। মনে হতো, এ কুরআন যেন আমার জন্যই লেখা হয়েছে, তাই বারবার পড়েও তৃষ্ণা মিটত না। কুরআন পড়ে বুঝতে পারলাম যে, ইসলামই সেই ধর্ম, যার সন্ধান আমি করছিলাম। কারণ, আমার মনের সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছি এ মহান ধর্মে।

স্টিভেন্স বলেন, কুরআন পড়ার আগে পার্থিব জীবনকে আমার কাছে ধাঁধা মনে হতো। এ জগতের যে একজন স্রষ্টা রয়েছেন, তা বিশ্বাস করতাম। কিন্তু জানতাম না, এই যে স্রষ্টা, যাকে চোখে দেখা সম্ভব নয়, তিনি কে। এটা জানার জন্য অনেক চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কোনো ফল পাইনি। এমন এক নৌকায় অবস্থান করছিলাম, যা উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। কিন্তু যখন পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করলাম, তখন অনুভব করলাম যে, এ বই যেন আমার সঙ্গে কথা বলছে।

এমন সময় ছুটিতে স্টিভেন্স মরোক্কো ঘুরতে গিয়ে প্রথম আজানের ধ্বনি শুনতে পান। মনে যাদের সঙ্গীত, আজান কেন জানি তাদের অন্যভাবে টানে! মরক্কোয় আজানের ধ্বনি শুনে অভিভূত হন স্টিভেন্স। জানতে চান, ‘এটা কিসের শব্দ?’ উত্তরে জানতে পারেন, ‘এটা আজান, ঐশ্বরীয় বার্তা। যার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে মুসলমানদের মসজিদে আহ্বান করা হয়।’ স্টিভেন্স ভাবেন, জীবনে টাকার জন্য গান করতে শুনেছি, গান হয়েছে খ্যাতির জন্য, ক্ষমতার জন্য, কিন্তু ঐশ্বরিক গান? ধারণাটা তার কাছে অসাধারণ মনে হয়।

সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৭ সালে স্টিভেন্স খ্রিষ্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন। নিজের নাম রাখেন ‘ইউসুফ ইসলাম’। ইউসুফ নামটি যোসেফ নামের আরবি রূপ। এই নামটি বেছে নেওয়া প্রসঙ্গে ইউসুফ ইসলাম বলেন, ‘আমি সব সময়ই যোসেফ নামটি পছন্দ করতাম। যে স্কুলে আমি প্রথম ভর্তি হই, সেই স্কুলের নাম সেন্ট যোসেফ। অবশ্য, এই নাম বেছে নেওয়ার মূল কারণ হলোÑ কুরআনের সুরা ইউসুফ অধ্যয়ন। এই সুরা দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে আমার মনকে।’

ইসলাম গ্রহণের পর ইউসুফ ইসলাম মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস শহর সফর করেন। এই পবিত্র শহর সফরের কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এই পবিত্র স্থানে আমার ভাইয়ের সফরের সুবাদেই আমি ঈমানের সম্পদ পেয়েছি। এ পবিত্র স্থান মুসলিম বিশ্বের হৃৎপিণ্ড। যতদিন এ হৃৎপিণ্ড অসুস্থ থাকবে, ততদিন গোটা মুসলিম বিশ্ব অসুস্থ থাকবে। এই মসজিদুল আকসাকে দখলমুক্ত করা আমাদেরই দায়িত্ব।’

মুসলিম হওয়ার পর তিনি কিছু দিন গান গাওয়া ও অ্যালবাম করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বিয়ে করার পর তিনি ব্রিটিশ মুসলিম সমাজের সেবায় নিয়োজিত হন। পপ তারকা হিসেবে তার বার্ষিক আয় ছিল দেড় মিলিয়ন ডলার। তার জমানো সেইসব অর্থ ও ভবিষ্যৎ আয়কে লন্ডন ও অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিমদের শিক্ষার কাজে ও অন্যান্য দাতব্য খাতে ব্যয় করার পরিকল্পনা করেন।

প্রায় ২৮ বছর পর ‘অ্যান আদার কাপ’ অ্যালবাম নিয়ে আবার পপ সংগীত জগতে ফিরে আসেন তিনি। এ সময় আমূল পরিবর্তন আসে গানের বিষয়ে। অ্যালবামের মলাটেও শিল্পীর নাম বদলে হয়ে যায় ইউসুফ ইসলাম। অ্যালবামের শিরোনাম হয়ে যায়Ñ দ্য লাইফ অব দ্যা লাস্ট প্রোফেট, প্রেয়ার অব দ্যা লাস্ট প্রোফেট, এ ইজ ফর আল্লাহ, বিসমিল্লাহ, ফুটস্টেপস ইন দ্যা লাইট, ইত্যাদি। এ অ্যালবামগুলোও সুপারহিটের তালিকায় স্থান করে নেয়।

সঙ্গীতে ফিরে আসার পর তিনি বিষয়ভিত্তিক ‘ইসলাম’ নিয়ে গান করতেন। সেখানে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র না রেখে হালকা পারকাশনের ব্যবহার ছিল। নিজের বিনিয়োগ করা ‘মাউন্টেন অব লাইট স্টুডিও’-তে বিভিন্ন মুসলিম গায়কের গান রেকর্ড করার সুযোগ করে দেন।

ইসলাম গ্রহণের পর তিনি কিছু অ্যালবামে ‘ইউসুফ ইসলাম’ এবং কিছু অ্যালবামে ‘ইউসুফ’ ব্যবহার করেন। ২০১৭ সালে ‘দ্য লাফিং অ্যাপল’ এবং ২০২০ সালে ‘টি ফর দ্য টিলারম্যান-টু’ অ্যালবামে তিনি ইউসুফ ও ক্যাট স্টিভেন্স দুই নামই ব্যবহার করেছেন। তিনি জানান, ‘ভক্তদের প্রতি দায়বদ্ধতা’ থেকে তিনি আবার সঙ্গীতে ফিরেছেন।

মানবিকতা ও শান্তির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অনেক আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন সংগীত শিল্পী ইউসুফ ইসলাম। এর মধ্যে আছে, ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল অ্যাওয়ার্ড, ম্যান ফর পিস অ্যাওয়ার্ড, গ্লুসেস্টারশায়ার ইউনিভার্সিটি থেকে অনারারি ডক্টরেট, দ্য মেডিটারেনিয়ান প্রাইজ ফর পিস, এক্সিটার ইউনিভার্সিটির অনারারি ডক্টরেট এবং জার্মান সাসটেইনেবিলিটি অ্যাওয়ার্ড।

২০১৪ সালে আমেরিকার ‘রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম’ নামক শিল্পবিষয়ক জাদুঘরে তার জীবনী অন্তর্ভুক্ত হয়। গানের জন্য তিনি অনেক আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হন। এর মধ্যে রয়েছেÑ সঙ রাইটার অব দ্য ইয়ার, পাস্ট ম্যাগাজিনের হানড্রেড বেস্ট লিভিং সঙ রাইটার, ‘সঙ রাইটার হল অব ফেইমে’ মনোনয়ন, ‘বিবিসি রেডিও-টু ফোক অ্যাওয়ার্ডসে’ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার, বেস্ট ফোক অ্যালবামের জন্য ‘গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড’-এ মনোনয়ন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ‘সঙ রাইটার হল অব ফেইম’-এ ভূষিত হন তিনি।

তার ‘পিস ট্রেন’ গানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রয়েছে। ২০০৬ সালে ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূস নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণের সময় ইউসুফ ইসলাম নোবেল পিস প্রাইজ কনসার্টে গানটি গেয়েছিলেন।

শিশুদের ইসলাম শিক্ষা নিয়ে কাজ করেছেন ইউসুফ ইসলাম। ১৯৮৩ সালে লন্ডনে ‘ইসলামিয়া প্রাইমারি স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৯ সালে ‘ইসলামিয়া গার্লস সেকন্ডারি স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করে অভূতপূর্ব সাফল্য পান। ইউসুফ ইসলাম ‘ব্রন্ডেসবারি কলেজ’ নামে আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।

ইউসুফ ইসলাম ‘ইউকে ইসলামিক এডুকেশন ওয়াকফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এ প্রতিষ্ঠান মূলত ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। তিনি ‘অ্যাসোসিয়েশন অব মুসলিম স্কুলস’-এর চেয়ারম্যান। ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডে তার তত্ত্বাবধানে ‘ওয়াকফ আল-র্বি এডুকেশনাল ট্রাস্ট’ নামে একটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান নথিভুক্ত হয়। ১৯৯৪ সালে ইউসুফ ইসলাম ‘মাউন্টেইন অব লাইট’ প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থাটি মূলত দাওয়াতি তথ্য উপকরণ, প্রচারের বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি করে থাকে।

১৯৮৫ সালে ইউসুফ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ‘মুসলিম এইড’। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম সাহায্য সংস্থার সঙ্গে মিলিতভাবে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। ‘ক্যাট স্টিভেন্স মিউজিক’-এর বার্ষিক আয় প্রায় দেড়শ মিলিয়ন ডলারের পুরোটা ইসলাম প্রচার-প্রসার এবং বিভিন্ন ত্রাণকাজে ব্যবহার করা হয়।

ইউনিসেফের বিশেষ দূত হয়ে ইউসুফ ইসলাম ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, পটুয়াখালি, ভোলা, রংপুর ইত্যাদি স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

মুসলিম ব্যক্তিত্ব হওয়ার কারণে তাকে অনেক প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিতে হয়েছে। ‘সন্ত্রাসী’ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে অজুহাতে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে রেকর্ডিংয়ের কাজে লন্ডন থেকে ওয়াশিংটনে যাওয়ার পথে তাকে আটক করা হয়। ফিলিস্তিনি সংস্থা ‘হামাস’-কে সাহায্য করার কারণে ২০০০ সালে ইসরাইল সরকারও তাকে ইসরাইলে ঢুকতে দেয়নি। ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার জন্য সালমান রুশদির মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি।

যিনি পার্থিব জীবনের মোহ ছেড়ে ইসলামের নির্মোহ ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন, সেই মোহ তাকে দৃশ্যত আচ্ছন্ন করতে পারেনি। ভক্তদের ভালোবাসায় সঙ্গীতে ফিরে গেলেও কোনো কিছুই পরিবর্তিত মৌলিক বিশ্বাস থেকে তাকে টলাতে পারেনি। ইসলাম ও সঙ্গীত— দুটি নিয়েই বেশ ভালো আছেন ৭৩ পার করা ‘দ্য আর্টিস্ট বয়’, ইউসুফ ইসলাম।