ইসলামে পারিবারিক বন্ধন

-

  • ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৫০


আজকের আধুনিক জীবনে মূল্যবোধগুলো যেন উল্টে গেছে। বরাবরই পারিবারিক জীবন ছিল সমাজের প্রাণকেন্দ্র। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আরো অনেক ঐতিহ্যের মতো এটাও আজ আক্রান্ত।


তবুও, সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনো ‘তন্ত্র’ কখনো তা হটিয়ে দিতে পারবে না, যা মানুষের প্রকৃতির মাঝেই প্রোথিত। তা হলো, সামাজিক বন্ধনের প্রয়োজনীয়তা আর রক্তের বাঁধনের উষ্ণতা। আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন এটা বজায় রাখতে।


মুসলিম বিশ্বে পারিবারিক জীবন ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিধান উভয়ের মাধ্যমে এত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, আজ পর্যন্ত তাকে তেমন দুর্বল করা যায়নি। এই পরিবার বলতে কেবল স্বামী, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েই নয়, সেই সাথে অন্য সব আত্মীয়-স্বজনকেও বোঝানো হয়।


ইসলামের পারিবারিক জীবন চারটি ভিত্তির ওপর সংস্থাপিত। এগুলো নৈতিক মূল্যবোধকে স্থায়ী করে। পাশ্চাত্যের প্রথাগুলো এমন টেকসই হয় না। এসব ভিত্তি কুরআনের বিধিবিধান এবং নবী করীম সা:-এর সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আর এগুলো হস্তান্তরিত হয়ে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।


উপরে উল্লিখিত ভিত্তি চারটি হচ্ছে
(১) পারিবারিক জীবন মানবসমাজের লালনের ক্ষেত্রে দোলনাস্বরূপ। এটা সমাজের সব সদস্যের জন্য নিরাপদ, স্বাস্থ্যপ্রদ ও উৎসাহব্যঞ্জক আবাসের ব্যবস্থা করে থাকে।
(২) পারিবারিক জীবন হলো নর ও নারীর প্রকৃতিসম্মত যৌন আকাক্সক্ষার অভিভাবক। এর মাধ্যমে মানুষের এই শক্তিশালী তাড়না সঠিকভাবে ও সুষ্ঠু খাতে প্রবাহিত হয়।
(৩) পারিবারিক জীবন ভালোবাসা, দয়ামায়া, ক্ষমা ও করুণার মতো মানবিক গুণাবলির সৃজন ভূমি।
(৪) পারিবারিক জীবন মানুষের অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী, দু’ধরনের দুঃখ-কষ্ট থেকে আশ্রয়ের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।


ইসলামি পারিবারিক জীবনের সদা কার্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই চারটি স্তম্ভের শক্তি গড়ে ওঠে সিস্টেমের দ্বারা। আর অবশ্যই এটা ভুলে গেলে চরবে না, পারিবারিক জীবনের সুফল শুধু রক্তসম্পর্ক পর্যন্তই বিস্তৃত নয়। এর আওতা মুসলমানদের বিশ্বজনীন পরিবার তথা ইসলামি সৌভ্রাতৃত্ব জুড়ে।
‘রাহেম’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ ‘জরায়ু’। এর উৎপত্তি ‘রাহীম’ থেকে, যার অর্থ ‘দয়া করা’। আল্লাহ তায়ালার দু’টি নাম আর রাহমান ও আর রাহীমÑ একই উৎস থেকে এসেছে। শব্দটি ভাবার্থগতভাবে আত্মীয়-পরিজন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।


আল কুরতুবি বলেছেন, পারিবারিক যেসব বন্ধন অটুট রাখতে হবেই। সেগুলো একই সাথে সার্বজনীন এবং বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সার্বজনীন দিক হচ্ছে সম্পর্ক রাখার ইসলামি ধরন। যেমন, পারিবারিক সম্পর্ক অবশ্যই বজায় রাখতে হবে বন্ধুত্ব, উপদেশ, ন্যায়ানুগতা, সুবিচারের সাথে। বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলো আর্থিকভাবে সহায়তা, ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করা প্রভৃতি।


আল্লাহতায়ালা বলছেন, হে লোকেরা। তোমার প্রভুকে ভয় করো, যিনি তোমাদের একটি মাত্র শুক্রাণু থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার সঙ্গীকে বানিয়েছেন। আর ঐ দু’জন থেকে সৃজন করেছেন বহু নারী ও পুরুষ এবং ভয় করো আল্লাহকে যাঁর নামে তোমরা একে অন্যকে ডেকে থাকো এবং (সতর্ক থেকো) জরায়ুর ব্যাপারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর সর্বদা লক্ষ রাখছেন (আল কুরআন ৪:১)।


ইসলাম-পূর্ব জাহিলি যুগে রক্তবন্ধনকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। তবে এর মধ্যে আসলে নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ নারীই পারিবারিক বন্ধনের ‘কারণ’ ও ‘সূত্র’। জাহিলিয়াতের সময়ে প্রতিপক্ষ গোত্রের হাতে যাতে আটক হয়ে লজ্জার কারণ না ঘটায়, সে জন্য মেয়ে শিশুকে হত্যা করা হতো। স্ত্রীকে গণ্য করা হতো পণ্যরূপে। মনে করা হতো, সে হচ্ছে পুরুষ আত্মীয়দের উত্তরাধিকারলব্ধ সম্পত্তি কোনো বিষয়ে যার মতের থাকবে না কোনো গুরুত্ব। তখন সম্পত্তির ওপর নারীদের কোনো সুনির্দিষ্ট অধিকার ছিল না। জাহিলি আমলের উত্তরাধিকার প্রথা ছিল এ রকম যেসব পুরুষ আত্মীয় লড়াই করার এবং পরিবারকে রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে যোগ্য ছিল, তারা মৃত ব্যক্তির সবকিছু নিয়ে নিত। এমনকি কেউ স্ত্রী ও সন্তান রেখে গেলেও তাদের জন্য কিছুই রাখা হতো না বলা চলে।


ইসলাম এসে এসব কিছু বদলিয়ে দিলো। রক্তের বন্ধনকে শ্রদ্ধা করার যে রীতি আগে থেকেই চালু ছিল, ইসলাম তার নিশ্চয়তাই শুধু দেয়নি, বরং নারীকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হলো। তাদের ইসলাম দিয়েছে সম্পত্তি, উত্তরাধিকার, প্রভৃতির অধিকার; তাদের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হলো, পারিবারিক বন্ধনকে বোঝাতে রাহেম বা জরায়ু ব্যবহার করে নারীকেই ইসলাম গুরুত্ব দিলো।


রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন তোমাদের মা’কে বিরক্ত করা, তোমাদের কন্যাদের হত্যা করা।’
পারিবারিক বন্ধন বজায় না রেখে ছিন্ন করা হলে ইহকাল ও পরকালে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও বড় পাপগুলোর একটি।
আল্লাহ বলছেন, যারা তাতে যোগ দেয় যেখানে যুক্ত হতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদের প্রভুকে ভয় করে, আর হিসাব দেয়ার কষ্টকে ভয় করে (আল কুরআন ১৩:২১)।


অতএব, আসুন, আমরা আল্লাহকে মেনে চলি, আমাদের রক্তের বন্ধন অটুট রাখি। চিন্তা করলে অনুধাবন করা যায় যে, পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখা আমাদের শুধু আজকের নয়, সব সময়ের প্রয়োজন। এটা আমাদের মাঝে স্থিতিশীলতার বোধ এবং আধ্যাত্মিক প্রশান্তি এনে দেয়। আসুন, আমাদের পরিবার-পরিজনের, আমাদের আত্মীয়-স্বজনের ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকি। 


ভাষান্তর : মীযানুল করীম