ইসলাম : গণতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিত্ব

-

  • সাদেক জাওয়াদ সুলাইমান
  • ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:৪৬

ইসলামি সাংবিধানিক কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে রয়েছে উম্মাহ, খিলাফত, বায়াত, সূরা এবং ভিকালাহ বা প্রতিনিধিত্ব। এর সাথে আছে কিফায়াহ ও ওয়াজিব। এগুলো ইসলামে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মূলনীতিকে আরো নির্দিষ্ট করে তুলে ধরে।
কিফায়াহর আইনি বিধি মোতাবেক মানুষের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলো ভাগ করা যায় দু’ভাগে : ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক। ব্যক্তিগত দায়িত্ব আরেক জনের ওপর অর্পণ করা যায় না। যেমন- জাকাত দেয়া। এ ধরনের করণীয় ‘ফরজে আইন’ হিসেবে পরিচিত। আর ফরজে কিফায়াহর অন্তর্ভুক্ত ওই সব সামষ্টিক ধর্মীয় ও সামাজিক বাধ্যবাধকতা, যেগুলো অন্যের ওপর অর্পিত হতে পারে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে জনপ্রতিনিধিত্ব, তা ফরজে কিফায়াহ। অতএব, ইসলামের দৃষ্টিতে এটা এক ধরনের অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব।
আর ‘ওয়াজিব’-এর অর্থ বাধ্যবাধকতা। সংক্ষেপে বলা যায়, ইসলামের নির্দেশ মানার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ কিংবা উপায় অবলম্বন করতে হয়, সেগুলোও ধর্মীয় দায়িত্ব বলে পরিগণিত। শর্ত হলো, এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের পন্থাটি ইসলামি আইনমাফিক যথাযথ হতে হবে অবশ্যই।
ইসলামে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সরকার গঠন করতে বলা হয়েছে। অন্য দিকে এই দাযিত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্যক্রমে জনগণের সবার অংশগ্রহণ অসম্ভব। তাই উম্মাহর সদস্যদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্বমূলক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাও ইসলামের দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয়।
এরপর জনগণের অবাধ্যতার অধিকার প্রসঙ্গ। যখন দেখা যায়, শাসক ইসলামের কয়েকটি মৌলিক বিষয় লঙ্ঘন করছেন, তখন এই অধিকার প্রয়োগের কথা আসে। সাংবিধানিক প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, এই পরিস্থিতিতে যেখানে সম্ভব, শান্তিপূর্ণ উপায়ে বায়াত প্রত্যাহার করে নেয়াই বিধেয়। তা করা হবে অভিশংসন (ইমপিচমেন্ট) এবং পদ থেকে অপসারণের মাধ্যমে। জনগণের এই অধিকার প্রকাশ্যে তুলে ধরেছিলেন প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন মতৈক্যের ভিত্তিতে। এরপর মদিনার মসজিদে সমবেত সবার উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আমাকে আপনাদের ওপর কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যতক্ষণ আমি আল্লাহতায়ালাকে মেনে চলি, ততক্ষণ আমাকে মান্য করবেন। আর যখনই আমি আল্লাহকে অমান্য করব, আমার আনুগত্য করা আর আপনাদের জন্য বাধ্যতামূলক থাকবে না।’
একই মূলনীতি তুলে ধরে দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা: বলেছিলেন : যে ক্ষেত্রে আমি সঠিক কাজ করব, আমাকে সাহায্য করুন। যখন আমার ভুল হবে, আমাকে সংশোধন করে দিন।’
তাই বলা যায়, সাংবিধানিকতা এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ধারণা ইসলামের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীরভাবে নিহিত। ন্যায়বিচার, সাম্য এবং মানুষের মর্যাদার মতো ইসলামি নৈতিক নির্দেশনায় প্রোথিত এর ভিত্তি। তদুপরি সুপ্রতিষ্ঠিত আইনি বিধানের দিক দিয়েও এটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্বীকার করতে হবে, এসব বিষয়কে অতীতে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। আর প্রথম চারজন খলিফার আমলের পর এ বিধানগুলোর প্রয়োগ ঘটেছে কদাচিৎ। আবার এগুলোকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ কিংবা অস্বীকার করা হয়নি শাসক গোষ্ঠী অথবা ধর্মীয় মহল থেকে।
আধুনিক যুগের ইসলামি মনীষীরা এসব ব্যাপারে ব্যাপকতর উপলব্ধির প্রয়াস পেয়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, শতবর্ষ আগে মিসরে মুহাম্মদ আবদুহু, রশিদ রিদা প্রমুখ সংস্কারমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এরপর শূরার যথার্থতা শুধু যে আরো ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হচ্ছে, তা নয়। সেই সাথে শূরার বিধানের প্রয়োগের পরিসরকে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। গণতন্ত্রের মূল উপাদানগুলোর মধ্যে আছে রাজনৈতিক বন্ধুত্ববাদ, বাকস্বাধীনতা, জনগণ সম্পৃক্ত- এমন নির্বাচন, ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ সহকারে ক্ষমতার পৃথককরণ, আইনসম্মত বিরোধিতা প্রভৃতি।
ইসলাম ও গণতান্ত্রিক সরকার
গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ করে ইসলামি ভিত্তির অনুসন্ধান কি মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য? আমি মনে করি- হ্যাঁ, এটা করতে হবে দু’কারণে।
প্রথমত, মুসলমানদের বেলায় ধর্ম জীবনের সব দিকই ঘিরে রেখেছে। অতএব, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুকে চূড়ান্ত পর্যায়ে অবশ্যই ইসলামের মৌলিক ধারণার সাথে সম্পর্কিত হতে হবে। অপর দিকে প্রস্তাবিত কোনো নীতি বা নির্দেশনা সর্বাধিক নিন্দনীয় হবে, যদি তা হয় ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিজ্ঞান সম্পর্কে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। তখন মুসলিম সংস্কারকরা কুরআনের ভিত্তিতে প্রমাণ করলেন, নিঃসন্দেহে সব ধরনের জ্ঞানই এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে। এবং বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞানের এমন শাখা, যা আল্লাহ বলেছেন মুসলমানদের অর্জন করতে। যখন বিশেষ করে মেয়েদের আধুনিক শিক্ষাকে সন্দেহের চোখে দেখা হলো, সংস্কারকরা দলিল-প্রমাণ সহকারে রাসূল সাঃ-এর সে নির্দেশ মনে করিয়ে দিয়েছেন : ‘পুরুষ কিংবা নারী, প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই জ্ঞানার্জন করা অবশ্য কর্তব্য।’
সাম্পতিক কালে কোনো কোনো মুসলিম দেশে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ আইনগত সংস্কার সাধিত হয়েছে। এটা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনা ও মতামত, তথা ইজতিহাদের সাহায্যে। অতীতে এই সংস্কার করা ছিল খুব কঠিন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যাচার-নিপীড়ন, দুর্নীতি, শোষণ ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে ইসলামের মহান মানবিক নীতিমালা বরাবরই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
দ্বিতীয়ত, বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রে পার্লামেন্ট চালু হয়েছিল। তখন প্রত্যাশা ছিল, এই ব্যবস্থা ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতা রোধ, বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বন্ধ এবং জাতীয় স্বাধীনতা সুসংহত করবে। কিন্তু ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজ দেশে গণতান্ত্রিক হলেও বিদেশে ঠিক এর বিপরীত আচরণ করেছে। তারা এসব মুসলিম দেশে স্বৈরাচারী শাসকদের চাপিয়ে দিয়েছিল। মিসর, সিরিয়া, ইরাকে জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা মোতাবেক স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয়নি। বৈদেশিক শক্তিই এই শাসকদের চালাত। ফলে জনগণ গণতন্ত্রের ‘ব্যর্থতা’র অভিজ্ঞতাই অর্জন করল। এর আগে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও ইরানে পরামর্শ পরিষদের ব্যর্থতা দেখা গিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অবিশ্বাস জন্ম নেয়। যা-ই হোক, নীতিগতভাবে মুসলমানদের- বিশেষত আরবদের গণতন্ত্র অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তাদের আপন ইসলামি ঐতিহ্যে নিহিত আদর্শ যে সভ্যজীবনের ধারক, সেটাই গণতন্ত্র কায়েমের তাগিদ দেয়।
রক্ষণশীল আরব উপদ্বীপে মজলিসে শূরা নামে আধাগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান চালু আছে। এর উদ্দেশ্য, জনগণের মধ্যে শাসকদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। হয়তো মনে করা হয়, শূরাকে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানরূপে ভূমিকা রাখতে হবে না। বাস্তবে এমনটি হলে তা হতাশা সৃষ্টি করবে। ইসলামি সুধীমহলের অভিমত, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শূরা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করা উচিত।
শূরা যথাযথ ভূমিকা রাখা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অন্যান্য মুসলমানের মতো আরবরাও ইসলামের সামাজিক নৈতিকতা থেকে দীর্ঘদিন ছিল বঞ্চিত । ফলে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামি দায়িত্ব সম্পর্কে তারা ছিল বেখবর। ইসলামি মূলনীতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সার্বক্ষণিক সচেতনতা অপরিহার্য। মুসলমানদের এর সর্বোত্তম বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে ব্যক্তিগত ও সামাজিকসহ জীবনের সব ক্ষেত্রেই। উম্মাহর ভেতরে এবং অন্যদের সাথে উম্মাহর লেনদেনে এটা ফুটিয়ে তুলতে হবে। ইসলামের মূল্যবোধ ও মূলনীতিগুলো বিশ্বজনীন ও স্থায়ী। যেমন- ন্যায়বিচার, সাম্য ও মানবিক মর্যাদার মতো মূলনীতি। আর আস্থা, যুক্তি, সত্যনিষ্ঠা, জ্ঞান, সহযোগিতা ও সততার মতো মূল্যবোধ। স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়, শূরার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের আওতায় এই মূল্যবোধ ও মূলনীতি ক্রমশ বিকশিত হওয়া সম্ভব। বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিকতাপুষ্ট ইসলামি সমাজ এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের মধ্যে যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান, তা আরবসহ মুসলিম বিশ্ব আজো যথেষ্ট উপলব্ধি করেনি।
আমি আশাবাদী, শূরার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটা সম্ভব হবে। বিশেষভাবে বলব আরব বুদ্ধিজীবীদের কথা, যারা ইসলামকে নতুন করে দেখছেন। তারা ইসলামের মূল বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক দিকগুলোর বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তারা শূরা পরিচালিত সরকারকে যথার্থ মনে করেন। আরব বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এসব বিষয়ে আগ্রহ ও উদ্যম অব্যাহত থাকলে তারা উপলব্ধি করবেন যে, ইসলামের শূরাব্যবস্থা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রসম্মত। এটা প্রগতিশীলতার অনুকূল। ইসলাম চৌদ্দ শ’ বছর আগেই আরবদের আহ্বান জানিয়েছিল শূরাভিত্তিক সরকার পরিচালনার দিকে। তখন বাকি দুনিয়া গণতন্ত্র সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা রাখত।
আমি মনে করি, শূরাব্যবস্থাকে অস্বীকার, অবজ্ঞা, বিকৃত কিংবা শিথিল করা হলে ইসলামের প্রতি ওয়াদা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রে ওমানের সাবেক রাষ্ট্রদূত
ভাষান্তর : মীযানুল করীম