ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান - সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ০৩ আগস্ট ২০২৩, ২১:২৪

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে এসেছে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে একইসাথে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক বিষয় প্রতিফলিত হচ্ছে। গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিপ্লবী চেতনা ও পশ্চিমাবিরোধী সেন্টিমেন্ট লালনকারী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির পরিবর্তনের সাথে সমন্বয় করে পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনছে। প্রবল শত্রুদেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান ইরানকে তার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বহুমুখী সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে তেহরান। নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করছে ইরান।

২০২১ সালের জুনে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত ইব্রাহিম রাইসি। তার ক্ষমতায় আসা ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। অন্যান্য অঞ্চলের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও কৌশলগত দৃশ্যপটেও এনেছে নতুন মাত্রা। তার সরকারের পররাষ্ট্রনীতির নতুন লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা। একইসাথে এশিয়ার শক্তিগুলো বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার সাথে ইরানের ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হুসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানকে বেছে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে ইব্রাহিম রাইসির নতুন পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাইসির নতুন দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিনিধিত্ব করছেন আমির আব্দুল্লাহিয়ান। পেশাদার এই কূটনীতিক আরবি ও ইংরেজি সাবলীলভাবে বলতে পারেন। আরব জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত দেশগুলোতে কূটনীতিক ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার ব্যাপক অভিজ্ঞতা আছে আমির আব্দুল্লাহিয়ানের।

ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ১৯৯৭ সালে তাকে প্রথম ইরানি দূতাবাসে পাঠানো হয়। এরপর তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইরাক সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি বাহরাইনে ইরানের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আরব ও আফ্রিকার দেশগুলোর দায়িত্বে ছিলেন আমির আব্দুল্লাহিয়ান।

পররাষ্ট্রনীতিকে পূর্বমুখী করা ইব্রাহিম রাইসির পররাষ্ট্রনীতির পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইরানের বৈদেশিক সম্পর্ক ব্যাপকভিত্তিক করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে চীন, ভারত ও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ইব্রাহিম রাইসির সরকার। এর মাধ্যমে এসব দেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি পররাষ্ট্রক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক নানা বাধা ও পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব কাটাতে এসব দেশের সমর্থন নিশ্চিত করাই ইরানের টার্গেট।

চীনের সাথে ইরানের সম্পর্ক এখন যথেষ্ট মজবুত। ২০২১ সালের মার্চ মাসে দুই দেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিকে ইরানের পূর্বদিকে বা এশিয়ামুখী কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখা হচ্ছে। চুক্তিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুগুলোকে। বিশেষ করে ইরানের উৎপাদন খাত, জ¦ালানি, অবকাঠামো সেক্টরে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির গুরুত্ব পাশাপাশি প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

চীনের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তিকে দেখছে তাদের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব কমানোর কৌশল হিসেবে। ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাওয়ার পর তেহরানের ওপর ওয়াশিংটন যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তা কাটিয়ে উঠতে চীনের সাথে এই চুক্তি যথেষ্ট ভুমিকা রাখে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরতা কমাতেই চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করে ইরান। চীনের বিশাল বাজারে নিজের জ¦ালানি তেল ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানির সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চায়নি ইরান।

অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে ইরানের সম্পর্ক বেশ জটিল ও বহুমুখী। বেশকিছু আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের ইতিহাস রয়েছে। এই বন্ধন আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। বিশেষ করে রাজনৈতিক, সামরিক ও জ¦ালানি সেক্টরে ইরান ও রাশিয়ার সহযোগিতার সম্পর্ক এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে জ¦ালানি সেক্টরে রাশিয়া ইরানের উল্লেখযোগ্য একটি অংশীদার। মূলধন, কারিগরি জ্ঞান ও সমর্থন দিয়ে ইরানের তেল ও গ্যাসের রিজার্ভ বাড়াতে ব্যাপক সহযোগিতা করছে মস্কো।

আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতেও নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে ইরান ও রাশিয়া কাজ করছে ঘনিষ্ঠভাবে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সার্বিক সমর্থন দিয়েছে দুই দেশই। যদিও কিছু কিছু বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে মতের অমিলও দেখা যায় মাঝে-মধ্যে।

এশিয়ার আরেক বড় দেশ ভারতের সাথেও ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে অনেক আগে থেকেই। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ এই দুই দেশ। ইরানের ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি থেকে তেল আমদানি করছে ভারত। ভারত ইরানের অন্যতম বৃহৎ তেল আমদানিকারক দেশ। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জ¦ালানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করছে।

ইরানের চবাহার বন্দরে রয়েছে ভারতের বিনিয়োগ। এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ফলে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়াকে এড়িয়ে ইরানের সাথে সহজেই বাণিজ্য করতে পারছে ভারত। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যু বিশেষত যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একযোগে কাজ করে আসছে ইরান ও ভারত।

দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশে^র নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা ইরান তার অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতেই পূর্বমুখী তথা এশিয়ামুখী কূটনীতির প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কারিগরি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে সুযোগ করে দিয়েছে ইরানকে। এশিয়ার দেশগুলো থেকে বড় ধরনের কূটনৈতিক সমর্থনও পাচ্ছে তেহরান। পশ্চিমা বিশে^র সাথে ইরানের বিরোধে এশিয়ার এই সমর্থন তেহরানের জন্য শক্তি ও স্বস্তি জোগাচ্ছে।

গত ৪ জুলাই আঞ্চলিক সংস্থা সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করেছে ইরান। রাশিয়া, চীন, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান ২০০১ সালে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে পাকিস্তান ও ভারত এতে যোগদান করে। বর্তমানে এসসিও বিশে^ একটি বৃহত্তম আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোট। এতে ইরানের অন্তর্ভুক্তিতে জোরারো সমর্থন দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। সংগঠনটি সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ সীমিত করে দিয়েছে চীন ও রাশিয়া।

রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে এই সংস্থার সদস্যরা পরস্পরকে সহযোগিতা করে থাকে। এই সংগঠনে ইরানের অন্তর্ভুক্তি দেশটির জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া ছাড়াও এখন থেকে আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করবে তেহরান।

কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইরানের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। চীনের মধ্যস্থতায় বেইজিংয়ে গত ১০ মার্চ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ৭ বছর পর ইরানের সাথে সৌদি আরবের কূটনেতিক সম্পর্ক জোড়া লাগে। যা এই অঞ্চলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।

সৌদি সরকার ২০১৬ সালে দেশটির শীর্ষস্থানীয় শিয়া আলেম নিমর আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলে ক্ষুব্ধ ইরানিরা তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা ও ভাংচুর করে। এরপর থেকেই ইরান-সৌদি সম্পর্কে তিক্ততা শুরু হয়। অবশেষে চীনের দূতিয়ালিতে দুই দেশের এই বিরোধের অবসান ও মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক উত্তেজনা ঘটে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বহুমুখী করা ও আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে ইরানের কর্মকর্তারা প্রতিবেশী দেশগুলোতে সফর করছেন। সৌদি আরবের সাথে সমঝোতার পর ইরানের এই তৎপরতা বেড়ে গেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সম্প্রতি সিরিয়া সফর করেন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক বিষয়াদি নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ইরাকের সাথেও ইরানের আলোচনা শুরু হয়েছে।

আরেক প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নিয়েছে ইরান। সম্প্রতি সীমান্ত বাজার উদ্বোধন করেছেন দুই দেশের নেতারা। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিসহ ইরানি নেতারা ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও ল্যাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। এসব দেশের সাথে সম্পর্ক ও সহযোগিতার ক্ষেত্র কিভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে কাজ করছেন ইরানের নেতারা। কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজের অবস্থান সংহত করতে চাইছে ইরান। সেজন্য কূটনীতিতে পরিবর্তন এনে এটাকে সময়োপযোগী একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ইব্রাহিম রাইসির সরকার।