কাতারকে কেনো এত গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রথম নেতা হিসেবে বাইডেনের আমলে হোয়াইট হাউজ সফর করেন শেখ তামিম - ছবি : সংগ্রহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:১৮

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো-বহির্ভূত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে উপসাগরীয় দেশ কাতার। মাত্র কয়েক বছর আগে প্রতিবেশী দেশগুলোর দিক থেকে অবরোধের মুখে পড়েছিল দোহা। অভিযোগ আনা হয়েছিলো সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন করছে কাতার। সেই অবরোধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও ছিল; কিন্তু সেই অবস্থা থেকে উঠে এসেছে কাতার। আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর বিদায় ও তালেবানদের সাথে সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দোহা। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক ভূমিকা রাখছে কাতারের দূতাবাস। যুক্তরাষ্ট্র যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে গুটিয়ে আনতে চাচ্ছে, এ রকম পরিস্থিতিতে কাতারের মতো মিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রথম নেতা হিসেবে বাইডেনের আমলে হোয়াইট হাউজ সফর করেন। ৩১ জানুয়ারি তিনি এই সফর করেন। এই সফর বিশেষ কারণে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, কাতার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো-বহির্ভূত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন কাতারকে কৌশলগত অংশীদারের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শক্তিশালী করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ২০১৭ সালে বেশ কিছু ঘটনার কারণে এই সম্পর্ক গতি পায়।

যুক্তরাষ্ট্র বাছাইকৃত কিছু দেশকে ন্যাটো-বহির্ভূত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। এই সম্পর্কের মধ্যে মিত্র দেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রতিশ্রতি থাকে না।

কাতারের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে। দোহা প্রায় দুই দশক ধরে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের অগ্রবর্তী সদর দপ্তরের জন্য দেশের মধ্যে জায়গা করে দিয়েছে। তারপরও অংশীদারিত্বের এই স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। এর বেশ কিছু সামরিক ও আর্থিক তাৎপর্য রয়েছে। যেমন, অস্ত্র হস্তান্তরের জন্য এই মর্যাদা দেয়া দেশগুলোকে অনেক কম কংগ্রেসের শুনানির ভেতর দিয়ে যেতে হবে। রোনাল্ড রিগ্যান থেকে শুরু করে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টরা এ পর্যন্ত মাত্র ১৮টি দেশকে এই মর্যাদা দিয়েছেন।

উপসাগরীয় এলাকায় কাতারের আগে বাহরাইন আর কুয়েত যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো-বহির্ভূত মিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে পরিচালিত মার্কিন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের শুরুর দিকে ২০০২ আর ২০০৪ সালে বাহরাইন আর কুয়েতকে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়।

আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছিল কাতার। তারা ২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তালেবানদের সরাসরি আলোচনার আয়োজন করেছিল। এই আলোচনার ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে এসে দোহা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়ার সময়সীমা ঠিক করে দেয়। পরে ২০২১ সালের আগস্টে যখন মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে যেতে শুরু করে, তখন সেখানে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সে সময়েও অনেক সহায়তা দেয় কাতার।

কাতার ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রাখছে। কাবুলের কাতার দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট একটি শাখা চালু রয়েছে। অন্যদিকে, দোহায় অবস্থিত তালেবানদের রাজনৈতিক অফিসের মাধ্যমে তালেবান নেতাদের সাথেও যোগাযোগ বজায় রেখেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।

২০২১ সালের নভেম্বরে কাতারের সাথে 'প্রটেকটিং পাওয়ার' চুক্তি স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সে সময় কাতারের প্রশংসা করেন। আফগানিস্তান ছেড়ে যারা চলে যাচ্ছিলেন, তাদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য কাতার সে সময় ফ্লাইট পরিচালনা করে। একই সাথে যারা যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ অভিবাসনের জন্য আবেদন করেছিল। ভিসা প্রক্রিয়ার সময়ে তাদেরকেও আশ্রয় দিয়েছিল কাতার।

বছর পাঁচেক আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপে কাতারের নেতারা হতভম্ব হয়ে যান। তখন মনে হয়েছিল কাতারের উপরে অবরোধ আরোপের জন্য ট্রাম্প সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমীরাতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। তিনি ঘোষণাও দিয়েছিলেন, কাতার সন্ত্রাসবাদের উচ্চ পর্যায়ে অর্থায়ন করছে। দোহা অবশ্য এই অভিযোগ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে।

ট্রাম্পের এই অবিশ্বাস্য বিবৃতি সবাইকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। কারণ তার এই বক্তব্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র আর কাতারের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্বের সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। অথচ উপসাগরীয় এলাকার ছয়টি দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্পের পদক্ষেপের কারণে এ ধরণের প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে আরও হয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আবকাইকের তেলক্ষেত্রে হামলার পর ট্রাম্প বলেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র আর সৌদি আরবের স্বার্থ আলাদা। সৌদি আরব ও আরব আমীরাতের ধারণা ছিল, ওয়াশিংটনের দিক থেকে তারা একটা নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি পাবে; কিন্তু ট্রাম্পের ওই বক্তব্যের পর দুই উপসাগরীয় দেশের নেতারা প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন।

২০১৭ সালের জুনে কাতার আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন গতি পায়। দোহা দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কয়েকদিনের মধ্যেই কাতার আর মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা ১২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে। চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৫ জঙ্গি বিমান কিনবে কাতার। এই অস্ত্র ক্রয় নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়া ট্রাম্পের হঠকারি মন্তব্যের আগেই শুরু হয়েছিল। পরে বোঝা যায় মার্কিন সরকারের সব স্তরের কর্মকর্তারা ট্রাম্পের অবস্থানের সাথে একমত নয়।

সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে কাতার আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। অথচ, কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের কারণ হিসেবে চারটি দেশ দোহার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগ এনেছিল। কাতার-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির পরপরই ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়াশিংটনে দুই দেশের মধ্যে সন্ত্রাস দমন বিষয়ক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। একই সাথে আরও বড় পরিসরে বার্ষিক কৌশলগত সংলাপের সূচনা হয়। যার প্রথম বৈঠক হয়েছে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে।

এই সব প্রচেষ্টার সুফল মিলেছিল। ট্রাম্পও শেষ পর্যন্ত তার অবস্থান বদল করেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজ থেকে কাতারের আমীর তামিমের সাথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টেলিফোন আলাপের তথ্য জানানো হয়। বিবৃতিতে জানানো হয়, সব ধরণের সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা দমনের জন্য কাতার যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোর কারণে কাতারের আমীরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের আগের অবস্থান থেকে এটা ছিল পুরোপুরি উল্টা।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে টেলিফোন আলাপের পর কাতারের আমীর তামিম ২০১৮ সালের এপ্রিলে এবং ২০১৯ সালের জুলাইয়ে হোয়াইট হাউজ সফর করেন। এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সংলাপের পরই প্রথমবারের মতো কাতারকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো-বহির্ভূত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি সামনে আসে।

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক কাতারের জন্য ইতিবাচক হয়েছিল। এমন সময় ওই বৈঠক হয়েছিল, যখন মোহাম্মদ বিন জায়েদ বা মোহাম্মদ বিন সালমানের কেউই যুক্তরাষ্ট্র সফরে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। তাদের সেই সক্ষমতাও ছিল না। কাতারের উপর অবরোধ আরোপকারী দেশগুলোর নেতারা তখন সুযোগ পাননি। কাতারের নেতাই বরং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে মুখোমুখি বৈঠকের সুযোগ পান।

এই প্রতিবেদনের ভিডিও দেখুন: 

 

কাতার যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক মেরামত ও সেটাকে সংহত করার জন্য সময় ও শ্রম দিয়েছে, সে কারণে ওয়াশিংটনে যখন ক্ষমতা বদলের সাথে সাথে নতুন প্রশাসনের ভূমিকা কাতারের অনুকূলেই এসেছে। এর আরেকটি কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন কূটনীতি আর আঞ্চলিক উত্তেজনা ও সঙ্ঘাত নিরসনের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। যদিও সে প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি।

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কাতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র কোন ভূমিকা রাখতে না পারলেও দোহা কূটনৈতিক সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে পরিকল্পনা করেছিল, সেখানে কাতারের কর্মকর্তারা মার্কিন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন এখন মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা প্রবাহে সরাসরি অংশগ্রহণের মাত্রা কমিয়ে আনতে চাচ্ছে। এ অবস্থায় তারা কাতারের মতো দেশের উপর নির্ভর করতে পারে। কাতার শুধু মার্কিন সেনাবাহিনীকে জায়গায় দেয়নি। একই সাথে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক ভূমিকাও পালন করতে সক্ষম।

ইরানের বিষয়টিকে এখানে উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। ইরানের পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা যখন একটা অনিশ্চিত পরিণতির দিকে যাচ্ছে, তখন তেহরান সফরে যান কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তেহরান সফরের চার দিন পরেই তিনি ওয়াশিংটন সফরে যান।
কাতারের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র আর ইরানের কর্মকর্তাদের মধ্যে বার্তাবাহকের কাজ করতে পারেন। যাতে দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ না হয়। যাতে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে প্রয়োজনে আবার আলোচনা শুরুর সুযোগ থাকে।

পাঁচ বছর আগে যে দেশটি তার বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের দিক থেকে অবরোধের মুখে পড়েছিল এবং কূটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে যাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। সেই দেশটিই এখন এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্রে পরিণত হয়েছে। এই অর্জনকে কোনভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।