ইসরাইল নিয়ে বিপাকে কুয়েত

ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দোটানায় কুয়েতের শাসকরা - সংগৃহীত

  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ০৫ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:৩৮

গত কয়েক মাসে গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল সংক্ষেপে জিসিসিভুক্ত তথাকথিত মধ্যপন্থী সুন্নি দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের বন্ধন দেখেছে বিশ্ব। মরক্কো, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ইসরাইল। সৌদি আরব সফর করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সৌদির সঙ্গেও ইসরাইলের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক হবে হবে করছে।

প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ, কোনোভাবেই এখনও তেলআবিবের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়নি জিসিসিভুক্ত দেশ কুয়েত। দেশটি এখন উভয়সংকটে। কী করবে কুয়েত? জিসিসির অন্য দেশগুলোর পথে হাঁটতে গেলে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তি ও আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হলে মার্কিন অংশীদারের তকমা হারাতে পারে দেশটি।

কুয়েতের রাজনীতি কিন্তু জিসিসিভুক্ত অন্যান্য প্রতিবেশীর চেয়ে একেবারে আলাদা। একটি সক্রিয় পার্লামেন্ট রয়েছে দেশটিতে। পার্লামেন্টকে বলা হয় মজলিসে আম। সেখানে অবাধ নির্বাচন হয়। তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর তুলনায় এ পার্লামেন্ট বেশ ক্ষমতাধর।

কুয়েত অর্ধগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক আমিরতন্ত্রের দেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতার জরিপে দেশটিকে ‘আংশিক মুক্ত’ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কুয়েত উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ‘আংশিক মুক্ত’ দেশ হিসেবে চিহ্নিত। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী অবশ্যই একটি নির্বাচিত আইনসভা থাকতে হবে। আমির হলেন রাষ্ট্রের প্রধান, যার ক্ষমতা সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে।

যেসব নাগরিকের বয়স একুশের ওপর, তারা ভোট দিতে পারেন। সংবিধান সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক দল গঠন করাকে সমর্থন করে, কিন্তু এরপরও এটা অবৈধ। কারণ, রাজনৈতিক দল অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কুয়েতে কোনো আইন নেই। এমপিরা সাধারণত স্বাধীনভাবে, আদর্শ, সামাজিক শ্রেণি কিংবা গোত্রভিত্তিক ডি ফেক্টো রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

মজলিসে আম হলো কুয়েতের আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ। সরকারের মন্ত্রীদেরকে অব্যাহতি দেওয়ার অধিকার রয়েছে মজলিসে আমের। এমপিরা প্রায় মন্ত্রীদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা দাবি করে তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করে থাকেন। মজলিসের এ ধরনের প্রশ্নোত্তর পর্ব কুয়েতি টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হয়। এমপিদের কোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যখ্যা দাবি করার অধিকারও আছে। এমনকি সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার ঘোষণাও তারা দিতে পারেন।

আমির পার্লামেন্টে ভেটো দিতে পারেন কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের ভিত্তিতে মজলিসে আম এই ভেটোকে অগ্রাহ্য করতে পারে। আমির নিয়োগ দেওয়ার কিংবা অনুমোদন করার সাংবিধানিক অধিকার মজলিসের রয়েছে।

অনেকগুলো রাজনৈতিক গোষ্ঠী নির্বাচনে ডি ফেক্টো রাজনৈতিক দল হিসেবে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে: জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট, পপুলার একশন ব্লক, হাদাস বা কুয়েতি মুসলিম ব্রাদারহুড, জাতীয় ইসলামী জোট এবং জাস্টিস অ্যান্ড পিস অ্যালায়েন্স।

দেশটির অর্ধগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মজলিসে আমের ক্ষমতা এবং ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মতো কুয়েত চাইলেই ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না।

সম্প্রতি আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের পর কুয়েতের এমপিরা নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শ ভুলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে একাট্টা অবস্থান নেন। দেশটির সঙ্গে যে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টার বিরুদ্ধে এক যৌথ বিবৃতি দেন তারা। কুয়েতের রাষ্ট্রীয় অবস্থানও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিরুদ্ধে। সঙ্গত কারণেই, রাজনৈতিক দলগুলোর একাট্টা অবস্থানকে উপেক্ষা করে এ সম্পর্ক বিবেচনা করতে গেলে হুমকির মুখে পড়বেন শাসকরা।

ফিলিস্তিন নিয়ে রাজনৈতিক সংহতি ও সমঝোতা রয়েছে দেশটির দল-উপদলগুলোর মধ্যে। ক্ষমতাসীন এলিটরা যদি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পথে হাঁটেন, তবে বিরোধী ও সরকারপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যরে পথ তৈরি হবে। এতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন এলিটদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। সংস্কার ও দুর্নীত তদন্ত নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যাবেন তারা। কোনো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে গেলে শাসকগোষ্ঠি ও রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার ভারসাম্যে সমস্যা তৈরি হতে পারে।

মিডল ইস্ট অ্যান্ড নর্থ আফ্রিকা সংক্ষেপে মেনা অঞ্চলে বিশেষ করে উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের মধ্যে কুয়েতের অবস্থান ‘নিরপেক্ষ নায়কের’ মতো। মধ্যস্থতাকারী শক্তি হিসেবে পরিচিত তারা। ইয়েমেন সংকট, কাতার অবরোধ এবং ইরান-সৌদি সমস্যায় সে অবস্থান প্রমাণিত। এ সার্বিক অবস্থান জিসিসি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকার কারণেই তৈরি হয়েছে। বিশেষত, সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না হলে এটা সম্ভব হতো না।

এ অবস্থায় কোন পথ বেছে নেবে দেশটি, ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় যে কোনো সিদ্ধান্তে স্থির হওয়া বেশ কঠিন। হ্যাঁ, ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক না করা পর্যন্ত এ পথে পা না বাড়ানোর পক্ষে একটা যুক্ত খাড়া করতে পারবে দেশটি। কিন্তু, সৌদি আরব যদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করে? তাহলে রক্ষা নেই, টাগ অব ওয়ারে যেতে হবে কুয়েতকে। দুটি অপশন থেকে একটি অপশন বেছে নিতেই হবে তাদের, যার জন্য বড়সড় মূল্যও দিতে হতে পারে।

কুয়েত যদি ‘বড়বোন’ সৌদি আরবের পথে হাঁটে, তাহলে আপনাআপনি মধ্যপন্থী সুন্নি দেশগুলোর ইরানবিরোধী বলয়ে চলে যাবেন তারা। এজন্য আঞ্চলিক সামরিক সঙ্ঘাতের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে দেশটি। শিয়া সংখ্যালঘু নাগরিকদের সমর্থন তো নিমিষেই হাতছাড়া হয়ে যাবে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, কুয়েতের শাসকরা শিয়াদের দূরে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি সহজে নেবেন না। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে রাজকীয় পরিবারের অনুগত শক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তারা।

অন্যদিকে, সৌদি পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে না গিয়ে কুয়েত যদি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ-বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রাখে, সৌদি আরব তাদের ইরানের নেতৃত্বাধীন ‘প্রতিরোধের অক্ষে’ ফেলে দেবেন। এ তকমা বহন করা আঞ্চলিকভাবে তো বটেই, অভ্যন্তরীণভাবেও জটিল হবে দেশটির জন্য। কুয়েতের রয়েছে উপজাতীয় ও ধর্মীয় মিশেলে নানাধর্মী সামাজিক রং, এ বলয়ের সঙ্গে সৌদি সম্পর্ক বেড়েছে। ইরানের পক্ষের শক্তিতে যদি দেশটির নাম যুক্ত হয়ে যায়, কুয়েতি সামাজিক গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে আক্রোশ দানা বাঁধার ঝুঁকি রয়েছে।

কুয়েত ইরানপন্থী নীতিতে চলছে বলে এর আগেও অভিযোগ করেছিলেন রাজনীতিবিদরা। উপজাতীয় ও ইসলামপন্থী আইনপ্রণেতারা প্রধানমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করেছিলেন এই বলে যে, তিনি কুয়েতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন এবং ইরানের পক্ষাবলম্বন করে জিসিসি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করছেন। যদিও সামাজিক গোষ্ঠিগুলো এখন ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিপক্ষে, এরপরও জিসিসি দেশগুলোর চেয়ে ইরানের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ুক, সেটাও হয়তো তারা চাচ্ছেন না। ২০১৯ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ৪২ শতাংশ কুয়েতি মনে করেন, দেশটির স্থিতিশীলতার জন্য ইসরাইলের চেয়ে ইরানই বড় হুমকি।

গত সেপ্টেম্বরে, কুয়েতের আমিরের ছেলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল হোয়াইট হাউজ সফর করে। সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা বলেন কুয়েতকে। এ নিয়ে ট্রাম্পের একটা বিবৃতিও আসে। তখন এ বিবৃতি নিয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল কুয়েতের জনগণ এবং সরকার।

কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলেছিলেন, কুয়েত তার অবস্থান বদলাবে না। বলেছিলেন, যতদিন না আরব ও মুসলিমদের কাছে ফিলিস্তিনই প্রথম ও প্রধান ইস্যু হবে, ততদিন ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে থাকবে কুয়েত। এ বিবৃতির ভাষায় যেটা বোঝা গিয়েছিল, সেটা হলো, মার্কিন চাপ সামাল দিতে প্রয়াত আমিরের পথেই হাঁটবে দেশটি।

বাইডেনের জয় আপাতত স্বস্তি হয়ে এসেছে কুয়েতের জন্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প যে ধরনের চাপ প্রয়োগের কৌশল নিতেন, সে জায়গা থেকে সরে আসবে বাইডেন প্রশাসন। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বলে আসছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন ছাঁচে রাখতে চান তিনি।

বাইডেনের পলিসি এজেন্ডার প্রথম দিকেই রয়েছে ইয়েমেন যুদ্ধ, জিসিসিভুক্ত তিন দেশ ও কাতারের মধ্যে সম্পর্ক এবং ইরানের মতো ইস্যুগুলো, যে ইস্যুগুলোতে সক্রিয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় এসে বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে কুয়েত।

বাইডেন প্রশাসন এ সমস্যাগুলোর সমাধানে কুয়েতকে মিত্র হিসেবে পাবে, এটা সত্য। এরপরও, সৌদি-ইসরাইল বন্ধুত্ব পাকাপোক্ত হওয়ার পর দোটানায় পড়তে পারে কুয়েত। বাইডেন প্রশাসন হয়তো ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে কুয়েতকে জোরালো চাপ দেবে না, তবুও, গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন অংশীদার হিসেবে যে মর্যাদা পায় দেশটি, তা হয়তো হারিয়ে যাবে। এর যথেষ্ট মূল্যও দিতে হতে পারে কুয়েতকে।