মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের চোখে ঘুম নেই

পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, রূপকথার মতো অকল্পনীয়ভাবে ট্রাম্প যদি আরো চার বছরের জন্য ক্ষমতায় ফিরে আসেন, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারতেন। কার্টুনটি করেছেন সাবানেহ - মিডলইস্ট মনিটর

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২২ নভেম্বর ২০২০, ১৪:১৫

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল মানা-না-মানা নিয়ে উত্তপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কোনো প্রমাণের তোয়াক্কা না-করেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্রমাগত বলে চলেছেন, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। প্রকৃত ভোট গণনা হলে তিনিই জয়ী হবেন, বাইডেন নন। আর প্রেসিডেন্টের কথাকে ধ্রুব সত্য জ্ঞান করে রাজপথে বিক্ষোভ করতে নেমে পড়েছে রিপাবলিকান দলের উগ্র সমর্থকরা। নির্বাচনের ফল নিয়ে এমন বিক্ষোভ আগে কখনো দেখেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মজার ব্যাপার হলো, মার্কিন নির্বাচন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের এমন টেনশনও আগে কখনো দেখেনি বিশ্ব। কেন এই টেনশন। আসুন জেনে নেই

নির্বাচনে ডেমোক্র্য্যাট পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী ঘোষণার সময় যতই এগিয়ে আসছে, আরব বিশ্বের কতিপয় স্বৈরশাসকের মাথাব্যথা ততোই বেড়ে চলেছে। কেননা, স্বৈরশাসক হয়েও তাঁরা ''গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা'' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শর্তহীন সমর্থন পেয়েছিলেন।

এখন সেই ট্রাম্পেরই গদি উল্টে যাওয়ায় কী হবে তাঁদের! তাঁরা ভাবছেন, বাইডেন প্রেসিডেন্টের আসনে বসে যাওয়া মানেই তাদের সাথে আমেরিকার সম্পর্কের খোলনলচে বদলে যাওয়া। ট্রাম্প তাঁদের সব রকম অপকর্মকে যেভাবে চোখ বন্ধ করে সমর্থন দিতেন, বাইডেন কি তা দেবেন?

মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের অনেক অপকর্মের দিকে তাকাতেনই না ট্রাম্প, এমনকি আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে তাদের অনেক বিতর্কিত পদক্ষেপকে তিনি সমর্থনই জানাতেন। যেমন ধরা যাক, সাংবাদিক জামাল খাসোগী হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি জড়িত থাকার দায়ে মার্কিন কংগ্রেসে সউদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের তীব্র সমালোচনা থেকে তাঁকে সুরক্ষা দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বলেছিলেন, ''আমি আমার 'প্রিয় গাধাকে' রক্ষা করেছি''। মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফত্তাহ আল-সিসি সম্বন্ধে কথা উঠলেই ট্রাম্প বলতেন ''আমার প্রিয় স্বৈরশাসক''। এভাবে আরব স্বৈরশাসকদের প্রতি তাঁর মহব্বতের কথা কখনোই লুকাতেন না ট্রাম্প।

সউদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং মিশরের স্বৈরশাসক আল-সিসি কি সে-কথা ভুলতে পারেন? পারেন না বলেই তাঁরা এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সংযুক্ত আরব আমীরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের মতো আরো কেউ-কেউ আশায় বুক বেঁধে ছিলেন যে ''তাদের লোক'' ট্রাম্পই শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউসে টিকে যাবেন।

মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকরা কেন বাইডেনকে এত ভয় পাচ্ছেন? এর জবাব খুঁজতে খুব বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারাভিযানের কথা মনে করলেই হবে। ওই সময় ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর বা বড়-বড় কথার বিপরীতে অবস্থান নেন বাইডেন।

বাইডেন কোনো রাখঢাক না-রেখেই হুমকি দেন যে নির্বাচিত হলে দু'টি ইস্যুকে কেন্দ্র করে সউদি-মার্কিন ''সম্পর্ক পুনর্নিমাাণ'' করা হবে। ইস্যু-দু'টি হলো, সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যা এবং ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরুর পেছনে সউদি আরবের ভূমিকা, যে যুদ্ধকে জাতিসংঘ বলেছে ''বিশ্বের নিকৃষ্টতম মানবিক সঙ্কট''।

গত ২ অক্টোবর জামাল খাসোগীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে এ কথা বলেন বাইডেন। তিনি বলেন, আমরা সরকারে গেলে সউদি-মার্কিন ''সম্পর্ক পুনর্নিমান'' যেমন করা হবে, তেমনই ইয়েমেন যুদ্ধে সউদি আরবের প্রতি মার্কিন সমর্থনও বন্ধ হবে। আর এটাও নিশ্চিত করা হবে যে অস্ত্র বিক্রি বা তেল কেনার স্বার্থে আমেরিকা তার মূল্যবোধের বিপরীতে অবস্থান নেবে না।

বাইডেনের এ অবস্থান ট্রাম্পের একেবারে বিপরীত মেরুতে। ট্রাম্প ইয়েমেন যুদ্ধে শুধু সউদি আরবের পক্ষেই দাঁড়াননি, তিনি এ বিষয়ে সিনেটে কয়েকটি প্রস্তাবে ভেটোও দিয়েছেন। এসব প্রস্তাবে ইয়েমেন যুদ্ধে মার্কিন সামরিক সমর্থন ও সংশ্লিষ্টতা প্রত্যাহার করতে বলা হয়। সব-ক'টি প্রস্তাব ভেটো দিয়ে নাকচ করে দেন ট্রাম্প। যুক্তি দেখান, এতে অস্ত্রশিল্পের অনেক লোক চাকরি হারাবে, যার বিরূপ প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

তবে বাইডেনের লম্বাচওড়া কথা শুনে তাঁকে শান্তিবাদী মহাপুরুষ ভাবার কোনোই কারণ নেই। তিনি যে সউদি আরবের পেছন থেকে পুরোপুরি সরে আসবেন, এমনও নয়। ইয়েমেন যুদ্ধে সউদি আরব যখন জড়িয়ে পড়ে, তখন অর্থাৎ ২০১৫ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওবামা প্রশাসন। আর সেই প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন আজকের হবু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইয়েমেন যুদ্ধে সউদিদের জড়িয়ে পড়ার পেছনে মার্কিন মদদ ছিল। তখন কোথায় ছিলেন বাইডেন?

তারপরও কেউ-কেউ ক্ষীণ আশা করে যাচ্ছেন যে বাইডেন প্রশাসন হয়তো সউদি আরবের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন আর দেবে না। এছাড়া ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে সরে আসার জন্য মার্কিন সরকারের প্রতি সিনেট ও কংগ্রেসের ভেতর থেকে প্রচন্ড চাপও রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এসব চাপ প্রশমিত করতেই বাইডেন নতুন সুরে গান গাইছেন। বাইডেন বড়জোর সউদি সরকারের ওপর কিছু কড়াকড়ি আরোপ করবেন হয়তো, কিন্তু দু'দেশের সম্পর্কে আমূল পরিবর্তন ঘটে - এমন কিছু করবেন না।

আরো মজার ব্যাপার হলো, সউদি আরবের অনেক পশ্চিমা সমালোচকের মতো বাইডেনও সংযুক্ত আরব আমীরাতের প্রতি তুলনামূলকভাবে নমনীয়। অথচ আমীরাতেও সউদি আরবের মতোই অনেক নিপীড়নমূলক নীতি চালু আছে এবং ওই দেশটিও ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িত।

আমিরাত যখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি করে তখন বলা হয়েছিল, এর বিনিময়ে পশ্চিম তীরে ইসরাইলী বসতি স্থাপন বন্ধ করা হবে। আসলে ইসরাইল কিন্তু ওই অন্যায় কাজটি এখনো চালিয়েই যাচ্ছে। তবে ইসরাইলের সাথে তথাকথিত শান্তি চুক্তি করে মার্কিন প্রশাসনের কাছে বেশ আদরণীয় হয়েছে আমীরাত।

মনে করা হচ্ছে, বাইডেন প্রশাসনের কাছেও আমীরাতের এই কদর থাকবে। ফলে ইয়েমেন বা লিবিয়া, যে-কোনো দেশের গৃহযুদ্ধেই আমীরাত জড়িত থাক, সেদিকে আর নজর দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এর মানে দাঁড়ালো, হতভাগ্য ইয়েমেনবাসীর দুঃখের দিনের অবসান শিগগিরই ঘটছে না।

উপসাগরীয় এলাকায় আমিরাত দেশটির 'প্রতি বিপ্লবী কার্যক্রমে'র প্রতিও নতুন মার্কিন প্রশাসন নজর দেবে না বলেই মনে করা যায়। এ কার্যক্রম হলো ওই অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বৈরশাসকদের সমর্থন প্রদান।

আমীরাতের যুবরাজ যেহেতু ট্রাম্পের কাছ থেকে অনেক উপকার পেয়েছেন, তাই বাইডেনের বিজয়ে স্বভাবতই তিনি পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করবেন অর্থাৎ সামনের দিনগুলোতে রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করবেন। এতে করে অনেক বিষয়ে আমেরিকার মুখের দিকে চেয়ে থাকা কমবে দেশটির।

এখন দেখা যাক নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরাইলের ব্যাপারে কী নীতি নেন। তিনি কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত 'ইসরাইল নীতি' থেকে সরে আসবেন, নাকি ট্রাম্পের বিতর্কিত পদক্ষেপগুলো বহাল রাখবেন?

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বাইডেন যেহেতু প্যালেস্টাইন সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান অর্থাৎ ইসরাইল ও স্বাধীন প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী, তাই তিনি হয়তো প্যালেস্টাইন ভূখন্ডে ইসরাইলী বসতি স্থাপন কাজের কিছুটা হলেও লাগাম টেনে ধরতে পারেন।

প্যালেস্টাইন সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান করার জন্য পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা বার বার আহবান জানালেও তা কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। আমেরিকা বরাবরই ইসরাইলকে চোখ বন্ধ করা সমর্থন দিয়ে গেছে। আসলে বহু রকম স্বার্থ ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র - এ দু' রাষ্ট্রকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, মার্কিন সামরিক সহায়তার সিংহভাগই পায় ইসরাইল।

কাজেই বলা যায়, বাইডেনের বিজয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সামান্য ক্ষতি হলেও ইসরাইলের কোনো ক্ষতি হবে না। ইসরাইল ও তার দখলদারী নীতিকে সবসময়ের মতোই দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দিয়েই যাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্পের আরেক পেয়ারা দোস্ত, মিশরের প্রেসিডেন্ট আল-সিসির ব্যাপারে কেমন নীতি নেবে বাইডেন প্রশাসন? এর জবাব পাওয়া যায় বাইডেনের একটি টুইট থেকে। গত জুলাই মাসে সিসি সরকার যখন বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল, তখন বাইডেন টুইটারে লিখেন, ''ট্রাম্পের 'প্রিয় স্বৈরাচারকে' আর কোনো ব্ল্যাংক চেক অর্থাৎ যা খুশি তা করার একচেটিয়া অধিকার দেয়া হবে না''। মিশরের সিসি সরকারের প্রতি এ ছিল একটি কঠোর বার্তা।

তবে এটা ছিল নির্বাচিত হওয়ার আগের কথা। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন মিশরের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর ওপর কতোটা চাপ প্রয়োগ করবেন বা করতে পারবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে মনে হয় তিনি মিশরকে দেয়া সামরিক সাহায্য কিছুটা কাটছাঁট করবেন। ইরান প্রশ্নে বলা যায়, অন্যান্য মার্কিন নেতার মতো জো বাইডেনও ইরানকে সহ্য করতে পারবেন না।

পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, রূপকথার মতো অকল্পনীয়ভাবে ট্রাম্প যদি আরো চার বছরের জন্য ক্ষমতায় ফিরে আসেন, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারতেন। কিন্তু তা তো আর হওয়ার নয়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে