মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের দাবার চাল

ইসরাইল-আমীরাত 'শান্তি' চুক্তির পর আঞ্চলিক দাবার বোর্ডে প্রথম চালটি চালিয়েছে তুরস্ক - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:৪৯

মধ্যপ্রাচ্য যেন একটি উত্তপ্ত কড়াই, অনবরত টগবগ করছে তো করছেই। ফুটন্ত কড়াইয়ে রসদ যোগান দেয়ার মতো পক্ষের অভাব হয় না কখনও। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সম্পন্ন হলো ইসরাইল-আমীরাত 'শান্তি' চুক্তি।

এ নিয়ে পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় ক্ষোভের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে, তা বেশ টের পাওয়া যায়, তবে কারো মুখে তেমন উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতিতে এর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে।

ইসরাইল-আমীরাত 'শান্তি' চুক্তির পর আঞ্চলিক দাবার বোর্ডে প্রথম চালটি চালিয়েছে তুরস্ক। গত ২২ আগস্ট ইস্তাম্বুলে ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েব এরদোয়ান। প্রতিনিধিদলে ছিলেন হামাস-নেতা ইসমাইল হানিয়াহ ও উপনেতা সালেহ আল-আরৌরি।

ইস্তাম্বুলের বাহদেতিন প্রাসাদে উভয় পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় রুদ্ধদ্বার বৈঠক। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তুর্কী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হাকান ফিদান, এরদোয়ানের দুই প্রধান সহযোগী - কমিউনিকেশন ডাইরেক্টর ফাহরেতিন আলতুন ও প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সাথে এ বৈঠকের রয়েছে বিশাল প্রতীকী তাৎপর্য। হানিয়া ও আরৌরি দু'জনেই যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড পার্সন। যাদের ধরার জন্য মূল্য ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। তাছাড়া সংগঠনটির সাথে তুরস্কের সম্পর্কও তুরস্ক-ইসরাইল সম্পর্কের ক্ষেত্রে পথের কাঁটা হয়ে আছে। হামাসের সাথে সম্পর্ক নিয়ে এমনকি তুরস্ক-ইসরাইল ঐতিহ্যবাহী ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভেঙে পড়ারও উপক্রম হয়েছিল।

সন্দেহ নেই যে, সংগঠনটি মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডেরই একটি শাখা বৈ আর কিছু নয়; নামটাই শুধু ভিন্ন। এই দলটির সাথে তুরস্কের শাসকদল এ কে পার্টির রয়েছে আদর্শিক ঐক্য। পক্ষান্তরে আমীরাতের শাসকগোষ্ঠীর চোখে সংগঠটি হলো জাতশত্রু।

এটা নিশ্চিত যে, ইসরাইল-আমীরাত 'শান্তি' চুক্তি নিয়ে অনেক বাছবিচার শেষে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এ চুক্তির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একটি লক্ষ্য হলো, ওই এলাকায় একটি নিউ রিজিওনাল অর্ডার বা নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যদিও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার সরে আসা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

এরদোয়ান হিসাব করে দেখেছেন যে, ইসরাইল-আমীরাত চুক্তির প্রধান টার্গেট হচ্ছে তুরস্ক। তিনি ভুলে যাননি, ২০১৬ সালে তাঁর সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে সংঘটিত ব্যর্থ অভ্যূত্থানের একটা বড় অংশীদার ছিল সংযুক্ত আরব আমীরাত। তাছাড়া তিনি এও জানেন, তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন কুর্দি গোষ্ঠীর সাথেও আমেরিকা, ইসরাইল ও আমীরাতের রয়েছে দহরম মহরম। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধেও জড়িত আছে তুরস্ক ও আমীরাত, তবে দুই দেশ দুই পক্ষে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তুরস্ক ও গ্রীসের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। সেখানেও গ্রীসের পক্ষ নিয়েছে আমীরাত।

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতাদের সাথে তুরস্কের বৈঠক অনুষ্ঠানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এর কড়া পাল্টা জবাব দিয়েছে তুরস্কও। দলটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিরস্কার করে তুর্কী মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এটি হচ্ছে সেই দল, যারা একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে গাজা-র ক্ষমতায় এসেছিল। এ দলটি ওই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একেবারে ধুয়ে দিয়ে তুরস্কের বিবৃতিতে বলা হয়, যে দেশ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে-র মতো সংগঠনকে প্রকাশ্য সমর্থন দেয়, ফতেউল্লাহ গুলেনের মতো সন্ত্রাসীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, এ বিষয়ে তৃতীয় কোনো দেশের সমালোচনার কোনো অধিকার তাদের নেই।

বিবৃতিতে দুঃখ করে বলা হয়, আমাদের অঞ্চলের বাস্তবতা থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানাবো যেন তারা আন্তর্জাতিক আইন, ন্যায়বিচার ও সমতার ভিত্তিতে ইসরাইল-প্যালেস্টাইন সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে কাজ করেন; কেবল ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ ও প্রভাব না-খাটান।

মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনের এই দলটির সাথে সম্পর্ক গড়ার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান নতুন কোনো গেইম প্ল্যান করছেন। তুর্কীরা ভাবছে, ইসরাইল-আমীরাত চুক্তির মধ্য দিয়ে আমেরিকা চাইছে মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে নতুন একটি বাস্তবতার উন্মেষ ঘটাতে, যেখানে ইসরাইল ও তার উপসাগরীয় ধনাঢ্য প্রতিবেশীরা পরস্পরকে স্বীকৃতি দেবে এবং তাদের মধ্যে থাকবে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ও পর্যটন। তবে এক্ষেত্রে প্যালেস্টাইনের স্বার্থ পুরোপুরি উপেক্ষা করা হবে। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় বিশ্বাস, ফিলিস্তিনীদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। ইসরাইলের কাছে তাদের আত্মসমর্পণ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

অপরদিকে তুরস্কের ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে বিপরীত। তারা অনেক নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছে বলেছে যে, ফিলিস্তিনীরা আত্মসমর্পণ করার বান্দা নয়। গত ৭০ বছরে তারা আত্মসমর্পণ করেনি, নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার বিসর্জন দিয়ে এখনও করবে না। আর তাই ফিলিস্তিনে গণপ্রতিরোধ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

ইসরাইলের সাথে তথাকথিত শান্তিচুক্তি করায় কঠিন ভাষায় আমীরাতী শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করেছেন ফিলিস্তিনের নেতারা। তারা মনে করছেন এবং বলছেনও যে, আমীরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ ফিলিস্তিনী জনগণের সাথে বেঈমানী করেছেন।

ফিলিস্তিনের এ ক্ষোভ কাছাকাছি নিয়ে আসছে ফাতাহ ও হামাসকে, যারা ছিল পরস্পরের কঠিন দুশমন। তারা এখন যৌথ রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, যিনি কিনা তাঁর সরকারে কোনো অংশীদার নেয়ার কথাই শুনতে চাইতেন না, তিনিই এখন হামাসের সাথে কাজ করার জন্য উদগ্রীব। আমিরাত-ইসরাইল চুক্তির পর দুই দলের সাধারণ সম্পাদক জিব্রিল রাজৌব এবং সালেহ আল-আরৌরিকে এক মঞ্চে দেখা গেছে। এতেই মনে করা হচ্ছে, উভয় পক্ষের সমঝোতা ও ঐক্য এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আমিরাত একটি ছক কষেছিল যে তারা নিকট-ভবিষ্যতে অন্যান্য আরব দেশ ও ইসরাইলের সমর্থন নিয়ে ফিলিস্তিনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট পদে বসাবে মোহাম্মদ দাহলানকে, যিনি এখন আবু ধাবিতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। কিন্তু প্রকল্পটি ভেস্তে গেছে। ফাতাহ ও হামাসের শত্রুতা থেকে কোনো রকম ফায়দা হাসিল করতে পারেননি দাহলান। বিক্ষুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা রামাল্লায় দাহলান ও বিন জায়েদ - দু'জনেরই কুশপুত্তলিকা পাশাপাশি পুড়িয়েছে।

তুরস্ক মনে করছে, ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে বিন জায়েদের বেঈমানীর বিরুদ্ধে আরব জনগণের এ ক্ষোভ ও ক্রোধের আগুন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে তা একটা পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে পারে। তার আভাস মিলেছে এক জনমত জরিপের ফলাফলে। দোহায় অবস্থিত আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ জরিপটি চালায়। এতে দেখা যায়, ২০১১ সালে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক গড়ার বিপক্ষে ছিল ৮৪ শতাংশ আরববাসী, ২০১৮ সালে তা বেড়ে ৮৭ শতাংশে পৌঁছায়।

এমন ঝড়ো পরিস্থিতির মাঝেও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান স্বপ্ন দেখেন একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের, যেখানে ফিলিস্তিনীরা পাবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, অবসান ঘটবে মধ্যযুগীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আর কায়েম হবে গণতন্ত্র।

এদিকে তার বিপরীতে গিয়ে আমীরাত শান্তি চুক্তি করছে ইসরাইলের সাথে। এরদোয়ান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, এ চুক্তি হচ্ছে বালির বাঁধ, একটি বড় ধাক্কা লাগলেই বাঁধটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।

মধ্যপ্রাচ্যে অভ্যূদয় ঘটছে তেল-পরবর্তী নতুন একটি অর্থব্যবস্থার আর তাতে ওই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব ক্রমেই কমে আসছে।

ফিলিস্তিনিদের পাশে দাড়ানোর এরদোয়ানের নীতি নি:সন্দেহে তার জন্য বড় ধরনের ঝুকি। কিন্তু এ কথাও সত্য তার এই অবস্থানের কারনে আরব বিশ্বে যে কোনো শাসকের চেয়ে তিনি বেশি জনপ্রিয় নেতা।

শুধু আরব বিশ্বে নয় বলা যায় পুরো মুসলিম বিশ্বে তিনি প্রধান নেতা হিসাবে আর্বিভুত হয়ে উঠেছেন। যা তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির বড় আকারের বাক বদল করা সাফল্যজনক দিকও বটে। তবে পরিবর্তনশীল বাস্তবতা মধ্যপ্রাচ্যকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে