মধ্যপ্রাচ্যের ভয়াল ভবিষ্যৎ

খালি চোখে কিছু দেখা যায় আর কিছু দেখা যায় না - এফটি ডটকম

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৮ আগস্ট ২০২০, ১৮:৪৫

একসময় অনেক দেশের অস্বচ্ছল অভাবী মানুষদের স্বপ্ন ছিল মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া। মধ্যপ্রাচ্য মানেই তখন সোনার হরিণ, যার নাগাল একবার পেলেই অভাব-অনটন বলে আর কিছু থাকবে না, জীবনে নেমে আসবে সুখের ঝর্ণাধারা। কিন্তু চিরদিন কারো সমান যায় না, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোরও যাচ্ছে না। নানা কারণে দেশগুলোর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা ২০১০ সালে যতটা খারাপ ছিল, ২০২০ সালে এসে তার চাইতে আরো খারাপ হয়েছে। এবং তা এতোটাই খারাপ যে, যদি কেউ মনে করে, দীর্ঘ এক যুগের সংঘাত ও হানাহানির রেশ মুছে ফেলে ওই অঞ্চলটি আবার ঠিক আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা ক্রমেই খারাপ থেকে ভয়ঙ্করের দিকে মোড় নিয়েছে, যার কোনো সমাপ্তিরেখা চোখে পড়ছে না। খালি চোখে কিছু দেখা যায় আর কিছু দেখা যায় না। এমনসব আন্তর্জাতিক দাবার ঘুটির চালে সবকিছু এমন জটিল রূপ নিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্য এগিয়ে চলেছে আরো সংঘাতময় ও গোলযোগপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে।

হানাহানি কোথাও-কোথাও হয়তোবা বন্ধ হতেও পারে, কিন্তু দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ক্ষত তাতে সেরে যাবে না। করোনা মহামারী কারনে অর্থনৈতিক দুর্দশা,ওই ক্ষতকে আরো দগদগে করবে। মোটের ওপর, খালি চোখে যতটা দেখা যাচ্ছে, বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের দুর্দশা তার চাইতে অনেক বেশি।

মধ্যপ্রাচ্যের পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালের দিক থেকেই, তবে তা ছিল নিঃশব্দ। এখন বিষয়টি আর চাপা নেই। একই রকম, কিন্তু অপেক্ষাকৃত নমনীয় পরিস্থিতিই যেখানে ওই অঞ্চলকে ঠেলে দিয়েছিল একটি সহিংস ও ধ্বংসাত্মক দশকের দিকে, সেখানে আজকের পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যকে আরো ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আসন্ন দুর্যোগের আভাস পেয়ে ২০১০ সালের নভেম্বরে একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক লিখেছিলেন, ''আসন্ন বসন্তকালটি হবে উষ্ণ। আবহাওয়ায় তাপমাত্রা কমলেও তা রাজনৈতিক উত্তাপ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো কাজেই লাগবে না। মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর ও অচল দেশগুলোতে উত্তেজনা যেভাবে বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি একটা বড় ধরনের সমস্যা, সংঘাত এবং সম্ভবত ভয়াল সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।'

এ ধরনের দেশের তালিকাটি দীর্ঘ, তবে তাদের সমস্যার বৈশিষ্ট্যগুলো অভিন্ন - এসব দেশে বিভাজন গভীর হচ্ছে, জনমনে হতাশা বাড়ছে, সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হচ্ছে, বাড়ছে অনিশ্চয়তা এবং দেশের ভেতরে-বাইরে সংঘাত ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার হুমকি।

বিগত শতাব্দীতেও এ অঞ্চল সমস্যায় ভোগেনি, এমন নয়। কিন্তু একুশ শতকের প্রথম দশকের মতো এমন দুর্যোগ মধ্যপ্রাচ্য আগে কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না। শাসকগোষ্ঠী এত রূঢ়, উত্তেজনা এমন তুঙ্গে এবং দারিদ্র্য এতোটা ব্যাপক। এরই ফল দেখা গেলো কয়েক মাসের মধ্যেই। গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে গেল সবখানে, যাকে বলা হলো 'আরব বসন্ত'। এর ঝড়ো বাতাসে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়লো।

ঠিক সেদিনের মতো আজকেও প্রতিটি রাস্তার কোণে-কোণে ক্রোধ ও অসন্তোষ ধূমায়িত হতে দেখা যাচ্ছে। আগের দশকের মতো চলতি দশকটি যখন অতিক্রান্ত হওয়ার পথে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের ধাক্কা এসে লেগেছে এ অঞ্চলের গায়ে। এ ধাক্কা তারা সামাল দেবে কিভাবে? এসব দেশ যেমন অযোগ্যতা, নিপীড়ন ও দুর্নীতির শিকার, তেমনি শিকার অপদার্থ ও লাগামহীন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির, যা মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের মদদ এবং সেখানে অস্থিতিশীলতাকে উস্কানি দিয়ে চলেছে।

এই ক্রমাগত উস্কানির ফল হয়েছে , গত দুই যুগের সিভিল ওয়ার, প্রক্্িরওয়ার ও ইম্পেরিয়াল ওয়ার সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও ইরাককে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে।

২০১০ সালে ইসরাইল-প্যালেস্টাইন ''শান্তি প্রক্রিয়া'' অচল হয়ে পড়ে, আর তা এখন মৃত। এদিকে ইসরাইল অধিকৃত প্যালেস্টাইনের তৃতীয় আরো একটি ভূখন্ড গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে, যা ওই অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা বাড়িয়েছে।

সিরিয়া ও ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে দেশ-দু'টির বিশাল অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, লাখ-লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে আর ছিন্নমূল হয়েছে সমসংখ্যক মানুষ। এ যুদ্ধে ইরানের জড়িয়ে পড়াও প্রতিবেশীদের সাথে দেশটির উত্তেজনা বাড়িয়েছে।

আর গত চার বছর ধরে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন উপসাগরীয় এলাকা ও নিকট-প্রাচ্য উভয় অঞ্চলের উত্তেজনার আগুনে কেবল ইন্ধনই যুগিয়ে গেছে। তারা ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতিকে সমর্থন দিয়েছে, ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে এবং ইরানের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে কঠোর অবরোধ।

আগামী নভেম্বরে হতে চলেছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে যদি ট্রাম্প জয়ী হন, তাহলে ইরানের বিরুদ্ধে একটা প্রতিশোধমূলক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা ব্যাপকভাবে করা হচ্ছে। সেই যুদ্ধের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ কেমন কবে, তা কল্পনা করাও মুশকিল।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ার কারণে উত্তর আফ্রিকা ও সাহেল অঞ্চলে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহ, খরা ও আঞ্চলিক বিরোধ। এমনকি তিউনিসিয়া, লেবানন ও জর্দানের মতো যেসব অপেক্ষাকৃত ছোট দেশকে 'শান্তির দ্বীপ' বলে মনে করা হতো, সেসব দেশও এখন অস্থিতিশীলতা ও অসন্তোষের মুখোমুখি হচ্ছে।

অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ওই অঞ্চলে ''পুলিসী রাষ্ট্র'' ও অশোভন অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। লিবিয়া থেকে ইয়েমেন - সবখানেই তারা খেলছে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়াশীলের ভূমিকায়।

সুখে নেই 'আরব বসন্তেরর' সূচনাকারী দেশ তিউনিসিয়াও। রাজনৈতিক গোলযোগ ও অর্থনৈতিক দুর্দশা তাদের আঁকড়ে ধরেছে। সামাজিক অস্থিরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে লেবাননে ও জর্দানে।

তেলের ভয়াবহ দরপতন এ অঞ্চলের সব দেশকেই আঘাত করেছে এবং পোড়াচ্ছে, তা সে হোক আলজেরিয়া থেকে সউদি আরব হয়ে ইরাক পর্যন্ত। তেল-উৎপাদক থেকে রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল ওই অঞ্চলের দেশের অবস্থা সুখকর নয়। এর ফল হিসাবে ওসব দেশে দেখা দিয়েছে ব্যাপক বেকারত্ব, পাবলিক সার্ভিসের হীন দশা এবং সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তার।

এসব পরনির্ভর দেশের একটি হলো মিশর। দশকের পর দশক আরব দুনিয়ার সবচাইতে জনবহুল এ দেশটি শাসিত হয়ে এসেছে একটি অযোগ্য স্বৈরশাসক গোষ্ঠীর দ্বারা। আর এখন শাসিত হচ্ছে একটি নিষ্ঠুর ও অদক্ষ স্বৈরশাসকের হাতে। এ স্বৈরাচার কয়েক লাখ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছে।

জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকারকে সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে হটিয়ে দিয়ে ২০১৩ সালে মিশরের ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান আবদেল ফত্তাহ আল-সিসি। তার অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনে মিশর নামের প্রাচীন সভ্যতার দেশটি ক্রমেই পঙ্গু হতে থাকে আর তলিয়ে যেতে থাকে মন্দার গভীরে।

সিসিকে নিয়ে পশ্চিমা কিছু দেশ আশা করেছিল যে সিসি হবেন চিলি-র সাবেক সামরিক শাসক পিনোশে-র মতো। পিনোশের শাসন ছিল নির্দয়, কিন্তু তার আমলে দেশটি এক ধরনের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। কিন্তু মিশরের বেলায় দেখা গেলো, আল-সিসি শাসক হিসেবে পিনোশের মতোই নির্দয় বটে, তবে যোগ্য নন। ফলে তার উপসাগরীয় মদদদাতারাও তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তার ব্যাপারে তারা যেমন আগ্রহ হারিয়েছেন, তেমনি এটাও বাস্তব যে, সিসিকে আগের মত বিলিয়ন ডলার দেয়ার ক্ষমতাও তাদের নেই। এ অবস্থায় মিশরের সামনে অপেক্ষা করছে ব্যাপক মানবিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট।

লোহিতসাগর উপকূলের শহর জেদ্দাহ সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। ছবি : এএফপি
লোহিতসাগর উপকূলের শহর জেদ্দাহ সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। ছবি : এএফপি

 

নৈতিক, আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে এ রকম দেউলিয়া হয়ে গেলে সব দেশে সব কালে স্বৈরশাসকরা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় আর পুরোপুরি নির্ভর করে বিদেশীদের ওপর। সিরিয়ার রক্তপিপাসু বাশার সরকারের ইরান-রুশ নির্ভরতা, মিশরের আল-সিসি সরকারের সউদি-আমীরাত নির্ভরতা, চরমপন্থী ইসরাইল সরকারের মার্কিন নির্ভরতা, লিবিয়ার জঙ্গি নেতা খলিফা হাফতারকে আমীরাত-মিশর এবং ইয়েমেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে আমীরাতের সমর্থন এরই জ্বলন্ত সাক্ষ্য।

গোটা মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে পরিস্থিতি এতই অবনতি হয়েছে যে, অনেকে বলে থাকেন, আসমানী সাহায্য ছাড়া এ ক্ষতি পোষানো সম্ভব নয়। যদি এমনও হয় যে, অলৌকিকভাবে সব স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটলো আর তাদের বিদেশী মদদদাতারাও লেজ গুটিয়ে ফিরে গেলো, তাতেও আরব দেশগুলোর হারানো সুখের দিন ফিরে পেতে বহু বছর, এমনকি কয়েক দশকও লেগে যেতে পারে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জনগণই পারে নিজেদের অঞ্চলকে গভীর খাদের কিনার থেকে সরিয়ে আনতে। গত দু' দশকে তারা দেখিয়েও দিয়েছে যে, শান্তিপূর্ণ ও সহিংস - উভয় পন্থায় বিদ্রোহ ও বিপ্লব করতে তারা সক্ষম। নিজেদের মাথার ওপর চেপে থাকা এ বোঝা তারা কোন পদ্ধতিতে নামাবে - তার ওপরই নির্ভর করছে তাদের অনাগত দিনগুলো কেমন হবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে