ভূমধ্য সাগরে মুখোমুখি গ্রীস-তুরস্ক

মুখোমুখি গ্রীস-তুরস্ক - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ২৮ জুলাই ২০২০, ২০:৪০

পূর্ব ভূমধ্য সাগরে তেল গ্যাস আহরণ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাড়িয়েছে গ্রীস-তুরস্ক। পূর্ব ভূমধ্য সাগরে মজুদ বিপুল তেল গ্যাস আহরণে গ্রীসের সাথে জোট বেধেছে মিশর, ইসরাইল আর গ্রিক সাইপ্রাস। অপর দিকে তুরস্কের সাথে রয়েছে লিবিয়া এবং উত্তর সাইপ্রাস। পূর্ব ভ‚মধ্য সাগরে যেসব এলাকায় তুরস্ক সর্বশেষ তেল গ্যাস অনুসন্ধান জরিপ পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে তাতে তুরস্কের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা সমর্থন করছে গ্রীসের দাবিকে।

পূর্ব ভূমধ্য সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান জরিপ পরিচালনার জন্য সার্ভে এলার্ট জারি করেছে তুরস্ক। তুরস্কের এ সার্ভে এলার্টে উদ্বিগ্ন গ্রীস পাল্টা নেভল এলার্ট জারি করেছে । গ্রীস প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন জার্মান চ্যাঞ্চেলর এঞ্জেলা মার্কেলের সাথে। তুরস্ক ঘোষণা দিয়েছে দক্ষিন উপকূলে জরিপ অপারেশন পরিচালনা করবে। এ লক্ষ্যে সেখানে রণতরী পাঠাবে । তুরস্ক এ জরিপ কাজ পরিচালনা করবে গ্রীসের একটি দ্বীপের কাছে। গ্রীস ও তুরস্ক উভয় দেশ একই এলাকায় টহল পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ নিয়ে পূর্ব ভূমধ্য সাগরে উত্তেজনা চলছে ।

তুরস্ক জানিয়েছে তাদের পুরো কন্টিনেন্টাল শেলফজুড়ে সার্ভে শিপ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গ্রীস একে অবৈধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তুরস্কের সার্ভে এলার্টের মধ্যে রয়েছে সাইপ্রাস এবং ক্রেট দ্বীপের মধ্যবর্তী অঞ্চল। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তুরস্ক এবং গ্রীক রণতরী গ্রীক আইল্যান্ড অব কাস্টেলোরিজোর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ দ্বীপ তুরস্ক মেইনল্যান্ড থেকে বেশ কাছে।

তুরস্কের জরিপ উদ্যোগকে গ্রীস তার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী কারিয়াকোস মিতসোটাকিস তুরস্কের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেলের সাথে। কারিয়াকোস বলেছেন তিনি দেশের রাজনীতিবিদদের সাথেও এ বিষয়ে বৈঠক করবেন।

বিভিন্ন ইস্যুতে তুরস্ক -গ্রীস বরফ শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে অনেক দিন ধরে ধরে। অভিবাসীদের প্রতি গ্রীসের আচরনে ক্ষুব্ধ তুরস্ক। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রুপান্তর করায় গ্রিসের প্রতিক্রিয়ায় তুরস্ক ভালো ভাবে গ্রহন করেনি।

তুরস্ক ও গ্রিস উভয় দেশ ন্যাটো সদস্য। দুদেশের সর্ম্পকের প্রভাব ফেলছে অন্য দেশগুলোর ওপর। সম্প্রতি সাইপ্রাস থেকে দূরে বিপুল পরিমান গ্যাস মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ সম্পদ আহরন নিয়ে এক দিকে অবস্থান নিয়েছে সাইপ্রিয়ট সরকার, গ্রিস, ইসরাইল এবং মিশর। পূর্ব ভ‚মধ্য সাগরের তেল গ্যাস আহরনের জন্য তারা পরষ্পর চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী ভ‚মধ্য সগারের মধ্য দিয়ে ১ হাজার ২শ মাইল পাইপ লাইনের মাধ্যমে তেল গ্যাস নিয়ে যাবে ইউরোপের বাজারে।

অপরদিকে তুরস্কের সাথে রয়েছে লিবিয়া। ২০১৯ সালের নভেম্বরে তুরস্ক লিবিয়ার সাথে চুক্তি করে। এ চুক্তি অনুযায়ী তুরস্কের দক্ষিন উপক‚ল থেকে লিবিয়ার উত্তর-পূর্ব উপক‚ল পর্যন্ত বিশেষ অর্থনৈতিক জোন বা ই ই জেড গঠন করা হয়েছে।

মিশর এবং গ্রীস অবস্থান নিয়েছে তুরস্ক-লিবিয়ার এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। মিশর আর গ্রীস তুরস্ক লিবিয়ার এ অর্থনৈতিক জোনকে অবৈধ দাবি করছে। এখানে তুরস্কের সাথে গ্রীসের বিরোধ চলছে ক্রেট দ্বীপ নিয়ে।

ভূমধ্য সাগরে তুরস্ক -লিবিয়া যেমন অর্থনৈতিক জোন গঠন করেছে তেমনি সাইপ্রিয়ট সরকারও গঠন করেছে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন। আর এতে যুক্ত রয়েছে মিশর, লেবানন এবং ইসরাইল।

২০১৯ সালে তুরস্ক সাইপ্রাসের পশ্চিমে সার্ভে অভিযান পরিচালনা করে। ভ‚মধ্য সাগরে অবস্থিত সাইপ্রাস দ্বীপ দুই ভাগে বিভক্ত। উত্তর সাইপ্রাস নিয়ন্ত্রন করছে তুরস্ক। দক্ষিন সাইপ্রাসে রয়েছে সাইপ্রিয়ট সরকার। তুরস্কের দাবি সাইপ্রাস দ্বীপ আর দ্বীপ বলয়ের যে সমুদ্র সীমা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ তাতে দুই দেশের সমান অধিকার রয়েছে।

তুরস্ক ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে সামনের মাসগুলোতে তারা ভ‚মধ্য সাগরের পশ্চিমের অন্যান্য এলাকায়ও অনুসন্ধান শুরু করবে। এতে গ্রীস এবং দক্ষিন সাইপ্রাস উদ্বেগ প্রকাশ করে। পূর্ব ভ‚মধ্য সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান আর আহরনের জন্য তার্কিশ পেট্রোলিয়ামকে কয়েকটি লাইসেন্স দিয়েছে তুরস্ক। এর মধ্যে রোডস এবং ক্রেট দ্বীপও রয়েছে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সবচেয়ে দীর্ঘ উপকূল রেখা রয়েছে তুরস্কের। তুরেস্কর দাবি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীস্বাভাবিকভাবে তুরস্ক এখানে শক্তিশালী প্রার্থী যার আসন নির্ধারিত।

তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় বলেছেন, সবার এটা মেনে নেয়া উচিত যে, তুরস্ক এবং তার্কিশ রিপাবলিক অব নর্দান সাইপ্রাসকে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ২০১৯ সালে এক ঘোষণায় বলেছেন এ অঞ্চলে তুরস্কের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসম্ভব।

এজিয়েন এবং পূর্ব ভূমধ্য সাগরের অনেক দ্বীপ নিয়ে তুরস্ক এবং গ্রীসের মধ্যে বিরোধ চলছে। অপর দিকে এজিয়েন সাগর এবং পূর্ব ভ‚ মধ্য সাগরে গ্রীসের কিছু দ্বীপ রয়েছে যেগুলোর অবস্থান তুরস্ক উপকূলের কাছে। ফলে সমুদ্র সীমার বিরোধ নিয়ে তুরস্ক -গ্রীস অতীতে অনেকবার যুদ্ধের দ্বরাপ্রান্তে এসে দাড়ায়।

গ্রীসের অভিযোগ কাস্টেলোরিজো দ্বীপের কন্টিনেন্টাল সেলফের বিশাল এলাকা তুরস্ক দাবি করছে। তুরস্ক পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেভলুত কাভুসগ্লু জুন মাসে বলেছেন, গ্রীসের যেসব দ্বীপ মূল ভ‚খন্ড থেকে অনেক দূরে আর তুরস্কের কাছে সেগুলোর কন্টিনেন্টাল সেলফ নেই।

যে মানচিত্র তুরস্ককে শুধু স্থল সীমানায় সীমাবদ্ধ করার জন্য আকা হচ্ছে তুরস্ক সে মানচিত্র ছিড়ে ফেলেছে। আর তুরস্ক ভূমধ্য সাগরে যা করছে তা করছে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুসারে। ভ‚মধ্য সাগরে তুরস্কের সাথে বিরোধে গ্রীসের পক্ষে রয়েছে তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলো। জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাইকো মাস এথেন্স সফরে এসে তুরস্কের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ভ‚মধ্য সাগরে উসকানীমূলক কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নও পক্ষ নিয়েছে গ্রীসের। তুরস্কের সর্বশেষ উদ্যোগের বিপক্ষে বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, তুরস্ক ভুল বার্তা পাঠিয়েছে। গত বছর আগস্টে তুরস্ক যখন সাইপ্রাস দ্বীপের উপক‚ল থেকে দূরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান চালায় তখনো ইইউ এর বিরোধীতা করে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ভ‚মধ্য সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান সমর্থনে উত্তর সাইপ্রাসে সামরিক ড্রোন বিমান পাঠায় তুরস্ক। সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান জাহাজের নিরাপত্তায় এ মিলিটারি ড্রোন মোতায়েন করেছে তুরস্ক।

ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত তৃতীয় বৃহত্তর দ্বীপ সাইপ্রাস। সাইপ্রাস দ্বীপের উত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে তুরস্ক। এর নাম তার্কিস রিপাবলিক অব নর্দান সাইপ্রাস বা টিআরএনসি। উত্তর সাইপ্রাস তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল । স্বাধীনতা ঘোষণার পর একমাত্র তুরস্কই তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এর রক্ষাকারী বর্তমানে তুরস্ক । তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একে সাইপ্রাসের অংশ দাবি করে আসছে।

তুরস্ক ও গ্রিস উভয় দেশ ন্যাটো সদস্য। দুদেশের সর্ম্পকের প্রভাব ফেলছে অন্য দেশগুলোর ওপর
তুরস্ক ও গ্রিস উভয় দেশ ন্যাটো সদস্য। দুদেশের সর্ম্পকের প্রভাব ফেলছে অন্য দেশগুলোর ওপর

 

১৫৭১ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্য সাইপ্রাস দখল করে। ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত এ দ্বীপ ওসমানীয়দের নিয়ন্ত্রনে ছিল। গোটা সাইপ্রাসকে গ্রীসের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ১৯৭৪ সালে গ্রিক সাইপ্রিয়ট জাতীয়তাবাদী এবং গ্রিক মিলিটারি জান্তা অভ‚ত্থ্যান ঘটায়। এর জবাবে তুরস্ক সেখানে পাল্টা সামরিক অভিযান চালায় এবং দখল করে উত্তর সাইপ্রাস। তখন থেকে উত্তর সাইপ্রাস তুরস্কের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে রয়েছে তুরস্কের সবচেয়ে দীর্ঘ উপকূল রেখা। সেখানে রয়েছে তুরস্কের বেশ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন। তুরস্কের অভিযোগ গ্রিক সাইপ্রিয়ট প্রশাসন সম্প্রতি উত্তর সাইপ্রাসের অধিকার পুরোপুরি উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ একতরফাভাবে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সমস্ত বিশেষ অর্থনৈতিক জোনকে নিজের দাবি করেছে । তারা সেখানে আন্তর্জাতিক তেল ও ড্রিলিং কোম্পানীকে অনুসন্ধানের আমন্ত্রণও জানিয়েছে। শুধু তাই নয় গ্রিক সাইপ্রিয়টের এ ঘোষনায় তুরস্কের বিশেষ অর্থনৈতিক জোন বা ব্লকও লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে দাবি তুরস্কের।

তুরস্কের অভিযোগ গ্রিক সাইপ্রিয়ট সরকার একতরফাভাবে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের পুরো ১৩টি তথাকথিত বøককে নিজেদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করেছে । অথচ এর অধিকাংশ ব্লক উত্তর তার্স্কিস রিপাবলিক অব নর্দান সাইপ্রাস ঘোষিত বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের সাথে সাংঘর্ষিক। এছাড়া গ্রিক সাইপ্রিয়ট প্রশাসন একতরফাভাবে ঘোনায় তুরস্কের নিজের অংশের বøকও লঙ্ঘন করেছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে