সাবাশ আমিরাত, সাবাশ

সবকিছু ঠিকঠাকমতো চললে পৃথিবী থেকে ৪৯৩ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মঙ্গলগ্রহে পৌঁছাতে মহাকাশযানটির সময় লাগবে আনুমানিক সাত মাস - আমিরাত মার্সমিশন

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৮ জুলাই ২০২০, ২০:২৪

মধ্যপ্রাচ্য কিংবা উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর কথা বলতে পৃথিবীবাসীর মনের সামনে গতানুগতিকভাবে ভেসে ওঠে ধূসর মরুময় কিছু দেশের ছবি, যেসব দেশে আছে তেলসম্পদ আর ওই তেল বিক্রির টাকায় তারা নিত্যই বিলাসব্যসনে মত্ত একদল মানুষ। বিদ্যাচর্চা, জ্ঞানসাধনা ওসব দেশে বুঝি তেমন-একটা নেই। ওসব দেশের একশ্রণির ধনাঢ্য মানুষের বেলায় কথাটা খানিকটা সত্য হলেও এ ছবির যে একটা উল্টো পিঠও রয়েছে, তা আমাদের জানা নেই, দেখাও নেই। উপসাগরীয় এলাকার ছোট দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবার আমাদের সেই ছবিটাই দেখিয়ে দিল।

সারা পৃথিবীর মানুষকে অবাক করে দিয়ে ২০ জুলাই সংযুক্ত আরব আমিরাত মঙ্গলগ্রহে পাঠালো এক মানুষবিহীন মহাকাশযান, যার আরবী নাম 'আমাল', বাংলায় 'আশা'। এটা আমিরাতের জন্য, এবং আরব দুনিয়ার জন্যও নতুন এক ইতিহাস। এ ইতিহাস তরুণ আরব বিজ্ঞানীদের নবতর চেতনায় উদ্দীপ্ত করবে, আর সংঘাতক্ষুব্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলে আমিরাতকে পরিচিত করাবে একটি বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রযুক্তিবান্ধব দেশ হিসেবে।

এতদিন মহাকাশে একচেটিয়া যাতায়াত ছিল কেবল আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি উন্নত দেশের। এবার ছোট দেশ আমিরাত দেখিয়ে দিল, 'আমরাও পারি'। অবশ্য মহাকাশে আমিরাতের এটাই প্রথম পদক্ষেপ নয়। এর আগে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার জন্য একটি রকেট পাঠিয়েছিল দেশটি। আর ২০১৯ সালে প্রথম বারের মতো আমিরাতের এক নাগরিক রাশিয়ান একটি মহাকাশযানে করে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে গিয়েছিলেন।

জাপানের প্রত্যন্ত দ্বীপ তানেগাশিমা থেকে মহাকাশযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাকমতো চললে পৃথিবী থেকে ৪৯৩ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মঙ্গলগ্রহে পৌঁছাতে মহাকাশযানটির সময় লাগবে আনুমানিক সাত মাস। আশা করা হচ্ছে, ২০২১ সালের ফেব্রæয়ারি নাগাদ ওটি লাল গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছে যেতে পারে, যখন সংযুক্ত আরব আমিরাত তার প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে। মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথ একবার ঘুরতে মহাকাশযানটির সময় লাগবে ৫৫ ঘণ্টা। গ্রহের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করবে ওটি।

জাপানী 'রকেট' দ্বারা চালিত মহাকাশযানটিতে তিন ধরনের 'সেন্সর' থাকবে, যার কাজ হবে মঙ্গলগ্রহের জটিল বায়ুমন্ডল পরিমাপ করা। মহাকাশযানটিতে খুব শক্তিশালী 'রেজুলুশন' সম্বলিত একটি 'মাল্টিব্যান্ড' ক্যামেরা থাকবে, যা সূক্ষ্ম বস্তুর ছবি তুলতে সক্ষম। গ্রহটির বায়ুমন্ডলের উপরিভাগ ও নিম্নভাগ পরিমাপ করার জন্য থাকবে একটি 'ইনফ্রারেড স্পেকটোমিটার'। এটি তৈরি করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি। তৃতীয় আরেকটি সেন্সর গ্রহটির অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের মাত্রা পরিমাপ করবে।

আমিরাতের এই মিশনের অন্যতম লক্ষ্য হলো, পানি তৈরিতে দরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কেন মঙ্গলগ্রহের বায়ুমন্ডলে থাকতে পারছে না, তা বোঝার চেষ্টা করা। এর আগে যত মহাকাশযান মঙ্গলগ্রহে পাঠানো হয়েছে সেগুলোর মনোযোগ ছিল ভূতত্ত্বের দিকে। এবার মঙ্গলগ্রহের জলবায়ু সম্পর্কে একটি সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

'লাল গ্রহ' নামে পরিচিত মঙ্গলগ্রহে আমিরাতের এই অভিযান নিয়ে আরবী ও ইংরেজি ভাষার সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ মাতামাতি চললেও অনেকের জানা নেই, এ প্রকল্প যখন গ্রহণ করা হয় তখন সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার প্রকল্পের টিমকে বলেছিল যে তারা কোনো বিদেশী কোম্পানি থেকে এই মহাকাশযান কিনতে পারবে না, তাদের নিজেদেরকেই এটি তৈরি করতে হবে।

এ কারণে প্রজেক্ট টিমকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পার্টনারশিপে যেতে হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও আমিরাতের প্রকৌশলীরা এজন্য একসঙ্গে কাজ করেছেন। স্যাটেলাইটটি তৈরির বেশিরভাগ কাজ করা হয়েছে ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডোর ল্যাবরেটরি ফর এটমোসফিয়ারিক অ্যান্ড স্পেস ফিজিক্সে। পাশাপাশি দুবাইর মোহাম্মদ বিন-রশিদ স্পেস সেন্টারেও উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হয়েছে।

মোহাম্মদ বিন-রশিদ স্পেস সেন্টারের প্রকল্প পরিচালক ওমরান শারাফ বলেন, আমিরাতের মঙ্গল মিশন সফল হওয়ার মূলে রয়েছে সহযোগিতা ও জ্ঞান হস্তান্তর। তিনি মিশনকে ''অসাধারণ-সব সরঞ্জাম'' সরবরাহ করায় অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি ও নরদার্ণ অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। একটি প্রাইভেট কার-এর সমান আকৃতির মহাকাশযানটি নির্মাণ করা হয়েছে কলরোডো বিশ্ববিদ্যালয়ের বোল্ডার ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়টি স¤প্রতি গর্বের সাথে ঘোষণা করেছে, মিশনটিকে সর্বোতভাবে সফল করে তোলার লক্ষ্যে ২০১৪ সাল থেকে আমিরাতের তরুণ বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদলও।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো একটি ক্ষুদ্র উপসাগরীয় দেশের এই অভাবনীয় কাজের পেছনে রয়েছেন এক নারী। বলা যায় তিনি এই অভিযানের অন্যতম রুপকার। মধ্যপ্রাচ্যে নারীরা যে বিজ্ঞান চর্চায় একেবারেই পিছিয়ে নেই তার প্রমান হিসাবে হাজির হয়েছেন এই নারী।

এই নারীর নাম সারাহ আল-আমিরি। মঙ্গল অভিযানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম শুনে যেমন সবাই অবাক, তার চেয়েও অবাক করা ঘটনা একটি আরব দেশে একজন নারীর এরকম একটি মহাকাশ অভিযানে নেতৃত্ব দেয়ার ঘটনা।
সারাহ আল-আমিরি ‘হোপ মিশনের’ বৈজ্ঞানিক দলের প্রধান। একই সঙ্গে তিনি দেশটির এডভান্সড সায়েন্স বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। যিনিএরই মধ্যে আরব বিশ্বের নারীদের জন্য এক বড় অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। সারাহ আল-আমিরি ১৯৮৭ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে জন্ম গ্রহন করেন । এখন তার বয়স মাত্র ৩২। কিন্তু মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন একেবারে ছোটবেলা থেকে।

সারাহ আল-আমিরি পড়াশোনা করেছেন কম্পিউটার সায়েন্সে, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহতে। তার বরাবরই আগ্রহ ছিল এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। কিন্তু তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোন মহাকাশ কর্মসূচীই ছিল না।

পড়াশোনা শেষে তিনি যোগ দেন এমিরেটস ইনস্টিটিউশন ফর এডভান্সড সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে। সেখানে তিনি কাজ করেছেন দুবাইস্যাট-১ এবং দুবাইস্যাট-২ প্রকল্পে। এরপর যোগ দেন আরব আমিরাতের পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। ২০১৬ সালে তাকে এমিরেটস সায়েন্স কাউন্সিলের প্রধান করা হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মঙ্গল অভিযানের শুরু থেকে তিনি এর সঙ্গে জড়িত। এখন এই মিশনের বৈজ্ঞানিক দলের প্রধান। ২০১৭ সালে তাকে একই সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এডভান্সড সায়েন্স বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী করা হয়।

এই নারীর নাম সারাহ আল-আমিরি। ছবি : ডিডব্লিও
এই নারীর নাম সারাহ আল-আমিরি। ছবি : ডিডব্লিও

 

মহাকাশ প্রযুক্তির সাম্প্রতিক উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক মহাকাশ খাতের বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকিকরণের সুবিধাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি বিভিন্ন স্পেস এজেন্সি, করপোরেশন ও একাডেমিক ইন্সটিটিউশনের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে তেলসমৃদ্ধ ছোট এ দেশটি এ ক্ষেত্রে তার সক্ষমতাকে বহু গুণ উপরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। মনে করা যায়, এ মিশনের সাফল্যের জন্য যা-কিছু করা প্রয়োজন, সবই করতে প্রস্তুত আমিরাতের শাসকরা।

ওই অঞ্চলে মহাকাশ মিশনে আমিরাত একা নয়, কাছের দুই দেশ ইসরাইল ও ইরানও আছে। ১৯৬০ সালে লেবানীজ রকেট সোসাইটি এ ধরনের কাজে বেশ এগিয়ে গিয়েছিল। বৈরুতের হাইগাযিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী এ দলটি তৈরি করেছিল। তারা প্রায় স্যাটেলাইট লেভেলে একটি রকেট উৎক্ষেপণ করতে সমর্থ হয়। কিন্তু পরে আঞ্চলিক রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ ও অস্থিতিশীলতার চক্করে পড়ে পুরো প্রকল্পটিই ভেস্তে যায়। আমিরাতের মঙ্গল মিশন নিয়েও সে-রকম কোনো খেলা চলে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা আছে।

তবে আশার দিক হচ্ছে এটা আরব আমিরাতের কোনো শৌখিন প্রকল্প নয়। এর পেছনে আছে প্রকল্প টিমের সদস্যদের অদম্য মনোবল, যদিও তাদের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা বলতে গেলে ছিলই না। আর ছিল শাসকদের দৃঢ়সঙ্কল্প। তারা প্রজেক্ট টিমকে সাফ বলে দিয়েছিলেন, ''বিল্ড ইট, নট বাই ইট''। মহাকাশযান কিনতে যেও না, নিজেরা বানাও।

আমিরাত সরকারের উদার পৃষ্ঠপোষকতা আর বিদেশী কারিগরী সহযোগিতায় অবশেষে সফল হয়েছে সাতটি ছোট ছোট আমিরাত নিয়ে গঠিত ছোট দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই। সাবাশ আমিরাত, সাবাশ!!

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে