চীন না আমেরিকা : মধ্যপ্রাচ্যে উভয় সঙ্কট

আমেরিকার কাছে চীন এখন প্রতিযোগি দেশ থেকে শত্রু দেশে পরিণত হয়েছে - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০১ জুলাই ২০২০, ২৩:৪১

গ্রামবাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ''গরীবের বৌ সবার ভাবী''। সবার ভাবী যখন, তখন সবাই তার সাথে ঠাট্টা-মস্করা করার 'অধিকার'ও রাখে। তা নিয়ে কিছু মনে করার বা মন খারাপ করার অধিকার অবশ্য তার নেই। গরীবের বৌ যে! মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ঠিক গরীব বলা চলে না, যদিও তাদের মনের দারিদ্র্য বেশ দেখার মতোই। আমেরিকার কাছে তাদের হাত-পা যেভাবে বাঁধা, তা দেখলে যে কারো মনেই করুণার উদ্রেক হবে। কিভাবে এসব দেশকে আমেরিকা ব্যবহার করছে তার কিছু দিক আমরা তুলে ধরবো।

আমেরিকার কাছে চীন এখন প্রতিযোগি দেশ থেকে শত্রু দেশে পরিণত হয়েছে। এই যখন অবস্থা তখন আমেরিকা চাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে তার বন্ধু দেশগুলো চীনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুক। কিন্তু এসব দেশের সাথে চীনের রয়েছে বহুমাত্রিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক, যা ছিন্ন করতে বললেই হলো না। আবার অলিখিত মুরব্বী আমেরিকার কথাও ফেলা যায় না। এমন এক অবস্থা এটা, যাকে বলা যায় অনেকটা ফাটা বাঁশের মাঝখানে আটকে পড়ার মতো। চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে আমেরিকার পারস্য উপসাগরীয় বন্ধুদের অবস্থা আজ এমনই।

ইসরাইল-চীন বন্ধুত্বের বিষয়টি কিছু দিন ধরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তবে উপসাগরীয় দেশগুলোতে চীনের পদচারণা আমেরিকা কতোটা ঠেকাতে পারে তার লিটমাস টেস্ট হবে সামনের দিনগুলোতে।

মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পরম মিত্র হচ্ছে ইসরাইল। গত মে মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে বৈঠকে ইসরাইলের নেতারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন যে, চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করার জন্য তারা দীর্ঘ দিনের বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করার ঝুঁকি নেবেন না। আমেরিকা শুধু যে ইসরাইলের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ মিত্রই নয়, ইসরাইলের বিতর্কিত স¤প্রসারণবাদী রাজনীতিরও অন্ধ সমর্থক। স্বাভাবিকভাবে ইসরাইল এই সর্ম্পক খারাপ করার ঝুকি নেবে না।

পম্পেওর ইসরাইল সফরের ক'দিন যেতে-না-যেতেই এর ফল দেখা গেল। ইসরাইলে বিশ্বের বৃহত্তম লবণাক্ততামুক্তকরণ প্রকল্পের কাজটি বাগিয়ে নিলো ইসরাইলেরই একটি কম্পানি। অথচ কাজটি পেতে চাচ্ছিল চীনের একটি কম্পানিও। একইভাবে ইসরাইল জানিয়ে দিয়েছে, নিজ নিরাপত্তাহানির আশঙ্কা থাকায় তারা চীনের টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্ট হুয়াওয়ের ফাইভ-জি সরঞ্জামও কিনতে অপারগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন থেকেই তার মিত্রদের নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ের সরঞ্জাম যুক্ত না-করার পক্ষে প্রচারনা চালিয়ে আসছে।

ইসরাইলের আসল পরীক্ষাটি হবে আগামী বছর, যখন তাদের হাইফা সমুদ্রবন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটি চলে যাবে চীনের হাতে। মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহরের জাহাজ এ বন্দরে সারা বছর অবাধে আসে-যায়। এমন একটি বন্দরের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে যাওয়া মেনে নিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র? মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেনও সে-কথা যে, মার্কিন নৌবাহিনী ইসরাইলের হাইফা বন্দর ব্যবহারে ইচ্ছুক। কিন্তু চীনের উপস্থিতি ওই ইচ্ছায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।

এদিকে ইসরাইলের ব্যাপারে যতটা না, উপসাগরীয় দেশগুলোর চীন-সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে আমেরিকা তার চাইতেও বেশি কঠোর অবস্থানে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে, বিশেষ করে হুয়াওয়ের বিষয়ে। অথচ উপসাগরীয় এলাকার দেশগুলোতে হুয়াওয়ে ইতিমধ্যেই ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

মার্কিন বন্ধুত্বের প্রশ্নে ইসরাইলের মতোই অনুভুতি ব্যক্ত করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতও, যদিও চীনের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে এখনও পরীক্ষায় বসতে হয়নি তাদের। তবে আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনওয়ার গারগাশের বক্তব্যে বোঝা যায়, দেশটি আমেরিকাকে কতোটা সমীহ করে। তিনি বলেন, আমেরিকা হচ্ছে আমাদের সিঙ্গল মোস্ট ইম্পরট্যান্ট স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। লোকজন অনেক সময় আমাদের বন্ধুত্বকে কেবল রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বিচার করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর ব্যাপ্তি আরও অনেক, অনেক বেশি।

তিনি আরও বলেন, এ বন্ধুত্ব ছড়িয়ে আছে তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসাবাণিজ্য, বিনিয়োগ, সফট পাওয়ার বা আর্থ-সাংস্কৃতিক সুসম্পর্ক, এন ওয়াই ইউ আবুধাবীর-র মতো প্রতিষ্ঠানসমূহের উপস্থিতি এবং আমার মতো অনেকের মধ্যে, যারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলোর কিছুটা কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

আমীরাতী মন্ত্রীর এসব কথাকে একটু বেশিই তৈলাক্ত মনে হচ্ছে কি? হবেই তো! পম্পেওর ইসরাইল সফরের পর নিকট প্রাচ্য বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড শেঙ্কার উপসাগরীয় দেশগুলোকে কড়া ধমক দিয়ে বলেন, এসব দেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার হওয়ার গুরুত্ব বুঝতে হবে। আমরা চাই, আমাদের অংশীদাররা বিষয়টি যথাযথ গুরুত্বের সাথে বোঝার চেষ্টা করুক।

সংযুক্ত আরব আমিরাত, সউদি আরব ও বাহরাইনের চুক্তি রয়েছে চীনের টেলিকমিউনিকেশন জায়ান্ট হুয়াওয়ের। এ প্রসঙ্গে ডেভিড শেঙ্কার হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, উপসাগরীয় দেশগুলোতে হুয়াওয়ের ফাইভ-জি অবকাঠামো মার্কিন এবং উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশের বাহিনীগুলোর মধ্যে যোগাযোগকে কঠিন করে তুলবে। অনেক ধমকাধমকির পর সুর একটুখানি নরম করে মার্কিন সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেষে বলেন, আমরা অবশ্য কোনো দেশকে বলছি না যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্য থেকে যে-কোনো একটিকে বেছে নাও। যে-কোনো দেশই এ দু' দেশের সাথে সুস্থ সম্পর্ক রাখতে পারে এবং তেমনটিই হওয়া উচিত। তবে কোনো-কোনো ক্ষেত্রে চীনের সাথে সম্পর্ক রাখার যে চড়া মূল্য দিতে হবে, আমরা সে-বিষয়টিই কেবল তুলে ধরতে চাইছি।

উপসাগরীয় দেশগুলোতে চীনের পদচারণা আমেরিকা কতোটা ঠেকাতে পারে তার লিটমাস টেস্ট হবে সামনের দিনগুলোতে। ছবি : ইন্টারনেট
উপসাগরীয় দেশগুলোতে চীনের পদচারণা আমেরিকা কতোটা ঠেকাতে পারে তার লিটমাস টেস্ট হবে সামনের দিনগুলোতে। ছবি : ইন্টারনেট

 

এরও আগে অপর এক সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা একই রকম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, উপসাগরীয় দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক নষ্ট করার ঝুঁকি নিচ্ছে।

মার্কিন পঞ্চম নৌবহর যখন কাজ করছে বাহরাইনের বাইরে, কাতার তখন মার্কিন সেনাবাহিনীর সেন্ট্রাল কম্যান্ড বা সেন্টকমকে ঘাঁটি গড়ার জায়গা দিয়েছে।

তারপরেও মার্কিনীদের উদ্বেগ কমে না। তারা ইসরাইল এবং উপসাগরীয় দেশগুলোকে বারবার বলতে থাকে, আমরা এতোই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমরা একে অপরের অনেক গোপন খবরই রাখি, এর মাঝে তৃতীয় কোন পক্ষ যেন ঢুকে পড়তে না-পারে। তৃতীয় পক্ষ মানে চীন। তারা কেমন করে ঢুকবে? আমেরিকার মতে, চীন ঢুকে পড়তে পারে ফাইভ-জি'র ছিদ্রপথে।

আমেরিকার সাথে যতই দোস্তি থাক, হুয়াওয়ের ফাইভ-জি অবকাঠামো না-নেয়ার জন্য তাদের কখনও হুমকিধমকি, কখনও নাকিকান্না উপসাগরীয় দেশগুলোতে অনেকের মনে সৃষ্টি করেছে তীব্র বিরক্তির। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপসাগরীয় কর্মকর্তা তাই বলেন, ফাইভ-জি তো হচ্ছে ভবিষ্যৎ। ঠিক আছে, আমরা হুয়াওয়ে নিলাম না, আমেরিকাকে তো এর একটা বিকল্প আমাদের দিতে হবে। এখন পর্যন্ত তারা তো ওই কাজটা করতে পারেনি।

খেলাটা জমেছে এখানেই। আমেরিকা যেমন হুয়াওয়ের বিকল্প দিতে পারছে না, তেমনিভাবে উপসাগরীয় দেশগুলোকে নিরাপত্তা দেয়ার প্রশ্নে আমেরিকার সাথে পাল্লা দিতে পারছে না চীন-রাশিয়াও।

অপরদিকে উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতি সচল রাখার জন্য চীনের সাথে সর্ম্পক ঘনিষ্ট করার কোনো বিকল্প পথ নেই। এখন পর্যন্ত উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রধান জ্বালানী তেলের ক্রেতা হচ্ছে চীন। শুধু তাই নয় এসব দেশে নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মানে চীনের বিনিয়োগের পরিমানও কম নয়। সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স কিংবা আরব আমিরাতের ডিফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন জায়েদ বিভিন্ন সময় চীন সফর করেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে দেয়া হয়েছে উষ্ঞ সংবর্ধনা।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অব্যাহতভাবে বাড়ছে চীনের বিনিয়োগ। স্বাভাবিকভাবে চীনকে আমেরিকার কথায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারছে না এসব দেশ। এমন পরিস্থিতিতে কি করা উচিত - এ প্রশ্নে উপসাগরীয় এলাকার এক বিশ্লেষক বলেন, এটা এমন এক অবস্থা, যেখানে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রয়োজন খুবই সতর্কতার।

কিন্তু মুশকিল হলো, বৃহৎ শক্তিগুলোর নেতারা মধ্যপন্থা অবলম্বনে একেবারেই অনিচ্ছুক। ইসরাইলকে যেমন সরাসরি বলে দিতে হয়েছে চীনের ফাইভ জি প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ তারা দিবেন না। বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রস্তাব থেকে চীনকে সরে দাড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। তেমনি উপসাগরীয় দেশগুলোকেও তা করতে হবে। কিন্তু এর অর্থনৈতিক ঝুকি অনেক। এ অবস্থায় উপসাগরীয় দেশগুলোকে নিজেদেরই নিজেদের পথ খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু সেই পথ উভয় দিক দিয়ে ঝুকিপূর্ণ।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে