আসাদের পতন কি আসন্ন

দ্রোজদের বিক্ষোভ - সিরিয়াএইচআর ডটকম

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৯ জুন ২০২০, ২৩:২৭

আরব বসন্তের জেরে সিরিয় স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধেও প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল। তবে তাকে নিমর্মভাবে দমন করেন তিনি। বর্তমানে সিরিয়ায় দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। সিরিয় জনগণ আবার রাজপথে নেমে এসেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার ক্ষমতায় থাকা আসাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

‘আমরা শান্তি বজায় রাখতে চাই... তবে তুমি যদি বুলেট চাও, আমাদের তাও আছে।’

সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের উদ্দেশ্যে এমন কঠোর স্লোগান দিয়েছে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের সুয়েদা প্রদেশের দ্রুজ সম্প্রদায়ের লোকজন। সেখানে গত সপ্তাহে টানা নজিরবিহীন বিক্ষোভ চলেছে। দিনদিনই বিক্ষোভ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আসাদপন্থীরাও পাল্টা বিক্ষোভ করেছে। সরকারি কর্মীরা যাতে বিক্ষোভে অংশ না নেয় সেজন্য হুমকিধামকি দিচ্ছে আসাদের গোপন পুলিশ বাহিনী। তাদের হুমকি উপেক্ষা করেই চলছে লাগাতার বিক্ষোভ। অনেকে সিরিয়ায় বিপ্লবেরও ডাক দিচ্ছেন।

দ্রুজ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এতোদিন পর্যন্ত অনেকাংশে সিরিয়ায় নয় বছরের গৃহযুদ্ধের প্রভাবমুক্ত ছিল। তবে দেশটি চরম অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হওয়ায় তারা রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে। তারা সরাসরি আসাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন। বলছেন, ‘তোর ওপর অভিশাপ, আমরা তোর পতন ঘটাতে আসছি।’

তারা ইদলিবে আসাদ বিরোধীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। ইদলিব এখনো আসাদ বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি।

সুয়েদার এই বিক্ষোভ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটা বৃহত্তর সংকটের লক্ষণ। আসাদের ক্ষমতায় থাকার ভিত্তি এই সম্প্রদায়ের বিক্ষোভে তার ক্ষমতায় থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে আসাদ তার প্রধানমন্ত্রী ইমাদ খামিসকে নাটকীয়ভাবে সরিয়ে দিয়েছেন। এতে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে নতুন এই বিক্ষোভ আসাদের বৈধতাকে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

একজন বিক্ষোভকারী বলছিলেন, আমরা বাচতে চাই না। আমরা মর্যাদার সঙ্গে মরতে চাই। যে শাসক তার জনগণকে উপোস রাখে সে একজন বিশ্বাসঘাতক।

একজন অধিকারকর্মী বলেন, আপনার সন্তান যখন ক্ষুধার্থ থাকবে তখন একজন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে আপনার বুক কাঁপবে না। রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা ইরান অথবা আঞ্চলিক শক্তিগুলো কী ভাবছে তা এখন আর আসাদের জন্য বড় ঝুকি নয়। প্রেসার কুকারে বসে থাকা জনগণই এখন তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

কিছুদিন আগেও মনে করা হতো যে নয় বছরের গৃহযুদ্ধে স্বৈরশাসক আসাদ জয়ী হয়েছেন। তিনি রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতায় ভিন্নমতকে নির্মমভাবে দমন করে অগ্নিগর্ভ দেশে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। তবে সিরিয়ায় এটাই শেষ কথা ছিল না। আসাদ তার দেশের ৬০ ভাগ এলাকায় হয়তো বিরোধীদের দমন করে তার স্বৈরশাসন বজায় রাখতে পেরেছেন তবে ২০২০ সালে এসে সিরিয়ায় এখনো ২০১১ সালের আরব বসন্তের সব উপাদান বিদ্যমান। বরং পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আসাদের টিকে থাকা দেশের প্রতিটি প্রান্তেই চ্যালেঞ্চ করা হচ্ছে। প্রায় এক দশকের মধ্যে এই প্রথম সিরিয়ায় আসাদের অনুগত লাখ লাখ লোক তার বিদায় নিয়ে কানাঘুষা করতে শুরু করেছে। ২০২০ সালে এসে অনেকেই মনে করছেন আসাদ কার্যকরভাবে এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার দেশ ও দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছেন।

আসাদ এখন বহুমুখী সংকটে। তার দেশে অর্থনীতি ধসে পড়েছে। করোনাভাইরাসের উত্থান হচ্ছে। খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সিরিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির সঙ্গে তার বিরোধ প্রকট আকার ধারণ করেছে। ইরান ও রাশিয়াও তার বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী লেবাননে অর্থনৈতিক সংকট ও গণবিক্ষোভ তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।

আসাদের যারা পতন চান তাকে উৎখাতের এটাই মোক্ষম সময়। তার এই বিপন্ন অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তাকে সরিয়ে দিতে হবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো একত্রে কাজ করতে পারে। দেশটিতে পরিবর্তন এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

আসাদের সামনে এখন বিপজ্জনক সব বিকল্প বিরাজ করছে। তিনি সিরিয়াকে উত্তর কোরিয়ার মত একটি বিচ্ছিন্ন দেশে পরিণত করে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে আলাদা হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করতে পারেন। আসাদ এতোদিন কার্যত এই চেষ্টাই করেছেন। এজন্য দেশে তিনি সংখ্যালঘুদের মধ্যে অনুগত বাহিনী গড়ে তুলেছেন। সিরিয়ায় নজিরবিহীন সংকটও দেখা দিতে পারে। দেশটি ভেঙে টুকরো হয়ে যেতে পারে। দেশটিতে দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতা শুরু হতে পারে। এতে সিরিয়া একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। এক সময়ের সমৃদ্ধ দেশটির ৮০ ভাগ নাগরিকই এখন দরিদ্র সীমার নীচে বাস করছে। দেশ ছেড়ে শরণার্থী জীবন বেছে নিয়েছেন লাখ লাখ সিরীয়।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় আবার চরমপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এবং এতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস হতে পারে। ইসলামিক স্টেট অথবা আইএসের বড় ঘাঁটি ছিল এই সিরিয়া।

আসাদের দীর্ঘদিনের অনুগতরাই ব্যক্তিগত আলোচনায় বলছেন যে আসাদ সরকার ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ সংকটে নিপতিত হয়েছে। আসাদবিরোধীরা এতোদিনে তার জন্য যত বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারেনি, অভ্যন্তরীণ এই সংকট তার চেয়েও ভয়াবহ। এই সংকট কাটিয়ে আসাদের টিকে থাকা দুরূহ হয়ে উঠতে পারে। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে রাশিয়া আসাদকে সরিয়ে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসাতে পারে।

সিরিয়ার বর্তমান অবস্থা আসাদের পৃষ্ঠপোষক রাশিয়া ও ইরানের জন্য গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। মস্কোতে আসাদবিরোধীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। অনেকেই মনে করছেন সিরিয়া একটি তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সিরিয়াকে আরো বিচ্ছিন্ন করা গেলে আসাদের টিকে থাকা কঠিন হবে। এতে রাশিয়া ও ইরান বিপাকে পড়বে এবং তারা সিরিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনায় বাধ্য হবে যাতে দেশটির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা যায়। আসাদের এই বিপন্ন অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তাকে উৎখাতে চেষ্টা করতে পারে আমেরিকা, ইউরোপ ও তাদের মধ্যপ্রাচ্যের মিত্ররা।

আসাদপন্থীরাও পাল্টা বিক্ষোভ করেছে-এপি
আসাদপন্থীরাও পাল্টা বিক্ষোভ করেছে-এপি

 

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সিরিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড় ছুটছেই। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বেকারত্ব লাগামহীন। এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে সাড়ে তিন হাজার সিরীয় পাউন্ড। চলতি বছরের শুরুতেও এক ডলারের বিনিয়ম মূল্য ছিল ৭০০ সিরীয় পাউন্ড। সিরিয়ায় এক মাসের বেতন দিয়ে একটি তরমুজও কেনা যাচ্ছে না। খাদ্য মজুদও শেষ পর্যায়ে। এর অর্থ হলো খাদ্য সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। অনেক বেসরকারি সংস্থা চলতি বছরের শেষ নাগাদ অথবা আগামী বছরের শুরুতে সিরিয়ায় দুর্ভিক্ষের আশংকা করছে। এতো সব সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশটিকে করোনাভাইরাসে উত্থান।

অর্থনেতিক এই দুরাবস্থার মধ্যেও আসাদের ইনার সার্কেলের লোকদের বিলাসিতার কোনো শেষ নেই। এ কারণে আসাদের ঘাটিতেও লোকজন এখন তার সমালোচনায় মুখর। সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী নেতা এমনকি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারাও আসাদ সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

এদিকে সিরিয়ার উত্তর আলেপ্পোর অর্থনীতি রূপান্তরে তুরস্ক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাও সিরিয়ার অর্থনীতির ওপর চরম আঘাত হেনেছে। সিরিয়ার বিরোধীদের সহায়তায় এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে তুরস্ক। সিরিয়ার ১০ ভাগ লোকই এখন দেশটির নিজস্ব মুদ্রা ছেড়ে তুর্কি লিরা ব্যবহার করছে। ইদলিবেও লিরা ব্যবহার শুরু হচ্ছে। সিরিয়ার ১৮ ভাগ জনসংখ্যার বাস এই ইদলিবে। সেখানে লিরা ব্যবহার শুরু হলে দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষই নিজেদের মুদ্র ত্যাগ করবে। এটা হবে সিরীয় অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেক। আসাদের দুই ঘনিষ্ট মিত্র রাশিয়া ও ইরান সিরিয়ার এই অর্থনৈতিক সংকটে কিছুই করতে পারবে না।

আসাদের যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন টাকাকড়ি তখন তিনি দেশে নতুন রণাঙ্গন খুলেছেন। তিনি সিরিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি তার চাচাতো ভাই রামি মাখলুফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রকে লেলিয়ে দিয়েছেন। আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের সদস্য রামি গত বছর আসাদ সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বড় সহযোগিতা দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে এখন গোয়েন্দা সংস্থা মরিয়া হয়ে উঠেছে।

সিরিয়ার সবচেয়ে বড় মোবাইল অপারেটর সিরিয়াটেলের মালিক রামি। আসাদ সরকার এই কোম্পানি দখল করেছে। রামিকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। তবে রামিও কম যান না। তিনি একের পর ফেসবুক পোস্টে আসাদ সরকারের কড়া সমালোচনা করছেন। রামির কোম্পানি দখল করে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে চায় আসাদ। তবে এতে দেশটির ব্যবসায়ী সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।

আসাদ সরকার নিজ জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তার পরিণতিতে আজকের এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। একদিকে নির্মম শাসন আরেকদিকে ভয়াবহ দুর্নীতিতে জড়িয়েছে আসাদ সরকার। এরফলেই আজকে সুয়েদায় অভ্যুত্থান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আসাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু হয়েছিল ডেরা এলাকায়। সেখানে এখন আবার সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে।

সিরিয়ায় আবার আইএসের উত্থান হচ্ছে। তুরস্ক সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিরোধীদের সহায়তায় গত মার্চে সামরিক অভিযান চালিয়ে আসাদ বাহিনীর পাশাপাশি রাশিয়াকেও নাকানিচুবানি খাইয়ে সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। উত্তর আলেপ্পোতে স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে যাচ্ছে তুরস্ক।

সিরিয়ার এতোসব সংকটের কোনো জাদুকরি সমাধান হয়তো নেই। তবে বিশ^কে এ সংকটে হাত ঘুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। যেমন সিরিয়ায় শরণার্থী সংকটের জেরে ইউরোপে উগ্রপন্থার রাজনীতি শক্ত আসন পেতে বসেছে। আইসিসের উত্থানেও সংকট ছিল বহুমাত্রিক। তাই আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জোরালো ভ‚মিকা নিতে পারে।

আসাদ একজন ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধী। তিনি ৩৫০ বার রাসায়নিক হামলা চালিয়েছেন। আসাদের বাহিনীর বর্বরতার কারণে সিরিয়ায় এখন পর্যন্ত সাত লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। দেশটি ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ হয়েছে উদ্বাস্তু।

পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থায় আসাদকে উৎখাতের জন্য রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে গোপন আলোচনা কার্যকর পন্থা হতে পারে। মনে রাখতে হবে আসাদ এখন গত নয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। তাকে উৎখাতের এটাই সবচেয়ে ভালো সময়।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে