স্বৈরাচার সিসির ঘাড়ে এরদোয়ান

মিশরের সামরিক স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির ঘাড়ে চেপে বসেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৩ জুন ২০২০, ২০:৪৫

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ ঘটছে। মিশরের সামরিক স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির ঘাড়ে চেপে বসেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। লিবিয়ায় সিসির মিত্র খলিফা হাফতারের পতন হলে সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে পারে তুরস্ক। এতে সিসির বাড়ির পাশেই শক্ত আসন হবে তুরস্কের। ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।

মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দুনিয়ায় গণতান্ত্রিক শক্তিকে কোনঠাসা করতে মরিয়া সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও মিত্রদেশগুলো। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ও ইসলামপন্থীদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান তুরস্ক সরকারের। এর সর্বশেষ বহিপ্রকাশ দেখা গেছে লিবিয়ায়। সেখানে যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারকে ক্ষমতায় বসাতে সৌদিআরব, আমিরাত ও মিশর নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তবে তুরস্কের সামরিক ও ক‚টনৈতিক সক্ষমতার কাছে তারা হেরে যাচ্ছে।

খলিফা হাফতারের বাহিনী এখন পলায়নপর। সৌদি, আমিরাত ও মিশরের পাশাপাশি রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্যর সহযোগিতা নিয়েও হাফতারের বাহিনীকে পিছু হটতে হয়েছে। লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতীয় ঐকমত্যের সরকার বা জিএনএ সরকার প্রতিদিন হাফতার বাহিনীকে বিভিন্ন এলাকা থেকে উৎখাত করছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সিসি হাফতারকে নিয়ে একতরফা অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করেছেন। তবে সেটি ছিল নেয়াতই দুই পরাজিত সৈনিকের মুখরক্ষার চেষ্টা। রাশিয়া আমিরাত ও সৌদি আরব এই অস্ত্রবিরতিকে স্বাগত জানায়। তবে তুরস্ক এবং লিবিয়ায় তাদের সমর্থিত জিএনএ সরকার সিসির এ ঘোষণাকে আমলে নিচ্ছে না।। তারা হাফতার বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, লিবিয়ায় হাফতার বাহিনী এবং তাদের সহযোগী সৌদি, আমিরাত ও মিশরের পরাজয় এখন অবধারিত। তুরস্ক এর আগে জিএনএ সরকারের সাথে লিবিয়ায় উপক‚লে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি করে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মধ্যসাগরে কার্যত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এতে সৌদি ও মিশর জোটের ভ‚মধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে গ্যাস রফতানির একটি পাইপলাইন প্রকল্প ভেস্তে যেতে বসেছে।

লিবিয়ায় জিএনএ সরকারের পুরো কর্তৃত্ব প্রতিষ্টিত হলে সেখানে তুরস্ককে সামরিক ঘাটি তৈরির অনুরোধ করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা বলছেন। কারণ লিবিয়ার প্রতিবেশী মিশরের সামরিক একনায়ক সিসির সামরিক হটকারিতা থেকে বাঁচতে এটাই হতে পারে তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। লিবিয়ায় তুরস্ক সামরিক ঘাঁটি তৈরি করলে সিসির জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। ফলে লিবিয়া নিয়ে সিসি সামরিক উচ্চাভিলাস পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। লিবিয়ায় সামরিক ঘাঁটি হলে উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপে তুরস্কের প্রভাব বেড়ে যাবে বহুগুণ।

উপনাগরীয় ছোট দেশ কাতারের মতো তুরস্কের সামরিক সহযোগিতা নিতে পারে লিবিয়া। কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাটি স্থাপনের পর সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় দেশগুলো তিন বছর আগে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তখন সৌদি জোট ক্ষুদ্র দেশ কাতারে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। তুরস্কের সামরিক ঘাঁটির কারণে সৌদি আরবকে সে পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। এতে রক্ষা পায় কাতারের সার্বভৌমত্ব। তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি না থাকলে কাতারের সার্বভৌমত্ব রক্ষা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ত।

এদিকে লিবিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনও তুরস্ককে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ায় তুরস্কের অবস্থানকে দৃঢ় সমর্থন দিতে শুরু করেছে। এর আগে খলিফা হাফতারকে সমর্থন দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে গত ৯ জুন এরদোয়ানের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে তিনি তুরস্কর্কে সমর্থন দেন। এরদোগায়ান জানিয়েছেন, লিবিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। এতে লিবিয়ায় নতুন যুগের সূচনা ঘটবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান সিসির জন্য বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করেছে।

মিশরীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামজা জাওবা মনে করেন , লিবিয়ার বৈধ সরকার হাফতারের আগ্রাসন থামিয়ে দিয়ে দেশের বাকি অংশও মুক্ত করতে শুরু করেছে। এটা সৌদি, আমিরাত ও মিশরের শাসকদের জন্য দুঃসংবাদ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, লিবিয়ায় হাফতারের পতন সিসির জন্য বিপর্যয়কর হলেও তাকে রক্ষার জন্য বেশি কিছু করার ছিল না মিশরের। এ কারণ মিশরের সামরিক বাহিনী যদি লিবিয়ায় অন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যায় তা হবে চূড়ান্ত বিপর্যয়কর। মিশরের সামরিক বাহিনী জানে যে সেখানে বড় ধরনের পরাজয়ের স্বীকার হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে এই কার্টুনটি করেছেন হাসান ব্লেইবেল। -পলিটিক্যাল কার্টুন ডটকম
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে এই কার্টুনটি করেছেন হাসান ব্লেইবেল। -পলিটিক্যাল কার্টুন ডটকম

 

এরপরও ব্যাপকভাবে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে মিশর হাফতারকে রক্ষায় লিবিয়ায় সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। লিবিয়া সীমান্তে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে বলে মিশরের গণমাধ্যমেও খবর আসে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন সিসি। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে মিশরের প্রভাব কমে এসেছে এবং মিশরের অর্থনীতিও বেহাল দশায়। আরেকটি দেশে উন্মুক্ত রণাঙ্গনে যুক্ত করার জন্য মিশরীয় সামরিক বাহিনী এখন আর প্রস্তুত নয়। মিশরের অভ্যন্তরে সিনাইয়েই বহু বছর ধরে মিশরীয় সেনারা মার খাচ্ছে। সিনাইয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেনাবাহিনীর অভিযান এতো বছরেও শেষ হলো না। তাহলে চিন্তা করুন লিবিয়ায় এ ধরনের অভিযানে কী পরিণাম হতে পারে। এছাড়া মিশরে আরো বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে

মিশরের আভ্যন্তরিন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে নীল নদে ইথিওপিয়ার বিশাল বাধ নির্মান। এতে মিশর অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এই বাধ ঠেকাতে সিসি তেমন কিছু করতে পারেনি। বাধটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে নীল নদের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে ইথিওপিয়া। এতে পানি সংকটে পড়বে মিশর। নীল নদ ছাড়া তো মিশরের অস্তিত্বই তো চিন্তা করা যায়নি। মিশরের একমাত্র গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি এই বাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। এমনকি সামরিক অভিযান চালিয়ে বাধটি গুড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামজা বলেন, তুরস্ক কিন্তু লিবিয়ায় সেনা পাঠায়নি। তারা পাঠিয়েছে কারিগরি ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের। সঙ্গে অত্যাধুনিক ড্রোনসহ উন্নত সমরাস্ত্র। এ কৌশল বেশ কাজে দিয়েছে। লিবিয়ায় মিশর, আমিরাত ও রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান সাফল্য পাচ্ছে।

উপায় না দেখে সিসির মতো সামরিক একনায়কও এখন শান্তির কথা বলছেন। অথচ সে চায় টাকা, ক্ষমতা আর রক্তপাত। হামজা বলেন, মিশর, আমিরাত ও রাশিয়া এখন শান্তি শান্তি করতে বাধ্য হচ্ছে। হাফতারের পতনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তারা এখন মুখ রক্ষা করে লাশটি দাফন করতে চায়।

অথচ কয়েক মাস ধরে হাফতার বাহিনীর ত্রিপোলি দখলের অভিযানে শত শত বেসামরিক লোক নিহত হলেও তখন অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানায়নি মিশর, আমিরাত ও রাশিয়া।

জিএনএ সরকার হাফতারের অস্ত্রবিরতির ঘোষণা উপেক্ষা করেই লিবিয়ার গুরুত্বর্পূণ এলাকা সির্তে দখলে নেওয়ার অভিযান শুরু করেছে। সেখান থেকে হাফতারের বাহিনীর বড় অংশ চলে গেলেও কিছু ভাড়াটে সেনা এখনো রয়ে গেছে। ধারনা করা হচ্ছে সহসাই সির্তেও দখলে নিতে সক্ষম হবে জিএনএ সরকার।

ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এই শহরটি দখলে নিতে সক্ষম হলে দেশটির বড় বড় তেলক্ষেত্র গুলোর নিয়ন্ত্রণ পাবে জিএনএ সরকার। এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে হাফতারের বাহিনীকে সরিয়ে দিয়ে লিবিয়ার বৃহত্তম তেলক্ষেত্র পুনরায় দখল করে নিয়েছে জিএনএ সরকার। এই খনি থেকে দৈনিক ৩ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করা সম্ভব।

রাশিয়া ও মিশরের অস্ত্রবিরতি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জিএনএ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফাতি বাশাঘা বলেছেন, সির্তে ও আল জুফরা বিমানঘাটি দখলের আগে কোনো রাজনৈতিক সংলাপ হবে না। জিএনএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সারাজও তার সেনাদের সির্তে দখলে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

আরব বসন্তেরর পর মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে শুরু করলে উত্থান ঘটতে শুরু করে ইসলামপন্থীদের। মিশরে ক্ষমতায় আসে মুসলিম ব্রাদারহুড। তিউনিসিয়ায় ক্ষমতা পায় ব্রাদারহুডের সহযোগী আন নাহাদা পার্টি। পরে সৌদি ও আমিরাতের সমর্থনে মিশরে ক্ষমতা দখল করেন সিসি। এরপর থেকে আবার উল্টোধারায় বইতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি।

ইসলামপন্থীরা চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। লিবিয়ায় ইসলামপন্থী সরকার টিকে গেলে সমীকরণ আবার পাল্টাতে শুরু করবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তুরস্ক, কাতার ও লিবিয়ায় সঙ্গে যুক্ত হবে তিউনিসিয়ার সংসদে সবচেয়ে বড় দল আন নাহাদা। আরব বসন্ত শুরু হয়েছিলো তিউনিসিয়ায়। গন আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার বেন আলীর পতন হলে ক্ষমতা এসেছিল আননাহাদা। পরের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে আন নাহাদা প্রেসিডেন্ট পদে জিততে না পারলেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। আন নাহাদার নেতা রশিদ ঘানুচি হন সংসদের স্পিকার। তিনি লিবিয়ায় তুর্কি অভিযানকে সমর্থন দিচ্ছেন।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে