লিবিয়ার আকাশের তুর্কি ড্রোনের রাজত্ব

তুর্কি ড্রোন - সংগ্রহ

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১১ মে ২০২০, ১৩:৪৪

শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষার জোরে লিবিয়ায় প্রায় এক বছর বাড়বাড়ন্ত ছিল খলিফা হাফতারের বাহিনী। তবে এখন তাদের পরাজয় পর্ব শুরু হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। হাফতারের বাহিনী রাজধানী ত্রিপোলি থেকে পিছু হটেছে। এ বাহিনীর হাতছাড়া হয়েছে আরও বহু এলাকা। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখছে তুরস্কের সামরিক সহায়তা। সিরিয়ার আকাশে তুর্কি ড্রোনের রাজত্বের পর এবার একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে লিবিয়ায়। আলজাজিরা ও নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে হঠাৎ নাটকীয় মোড় সম্পর্কে আজ তুলে ধরব বিস্তারিত।

এক বছরেরও বেশি সময় আগে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি দখলের জন্য সামরিক হামলা শুরু করেছিলেন বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতার। তবে এবার ত্রিপোলি দখলের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে। এখন নিজের পূর্বাঞ্চলীয় দুর্গ রক্ষার জন্যই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

লিবিয়ার এই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে তুরস্কের সামরিক সহায়তা। বিশেষ করে তুরস্কের ড্রোন শক্তি হাফতারের স্বঘোষিত লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এলএনএকে লিবিয়ার আকাশ থেকে উৎখাত করেছে। হাফতারের মিত্ররা দাবি করে থাকেন যে এই লৌহমানব লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। ২০১১ সালে লিবিয়ার সাবেক শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকেই দেশটিতে অরাজকতা বিরাজ করছে।

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর হাফতার সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন। গত বছরের ৪ এপ্রিল তিনি ত্রিপোলি দখলের অভিযান শুরু করেন। এরপর জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস লিবিয়া সফর করে হাফতারকে অভিযান বন্ধের অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। সে সময় তিনি অভিযান অব্যাহত রাখার জন্য আমেরিকার সবুজ সংকেত পান। গাদ্দাফি আমলের সেনা কর্মকর্তা হাফতার যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়ে সিআইএর গুপ্তচর হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন। গাদ্দাফির পতনের পর তিনি দেশে ফেরেন।

ত্রিপোলি অভিযানের শুরুতে হাফতারের মিত্ররা মনে করেছিলেন যে তার বিজয় অত্যাসন্ন। শুরুতেই ত্রিপোলির পশ্চিমের সাব্রাথা ও সারমান নামের দুটি উপকুলীয় শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় হাফতার বাহিনী। পাশাপাশি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্র্ণ গারিয়ান শহরের দখলও চলে যায় তাদের হাতে। তবে সেই সুসময় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকার বা জিএনএর সমর্থনপুষ্ট বাহিনী শক্তি সঞ্চার করে ত্রিপোলির দক্ষিণাঞ্চলের শহরতলিতে হাফতার বাহিনীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়।

ত্রিপোলির ২১০ কিলোমিটার পূবের শহর মিসরাতা থেকে হাফতার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছিলেন হাজার হাজার যোদ্ধা। এই যোদ্ধাদের একজন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন আমরা ২০১১ সালে এক স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে যুদ্ধ করেছি। এতে আমাদের বহু ভাই ও বন্ধু শহীদ হয়েছেন। আমরা হাফতারকে কখনো ত্রিপোলিতে ঢুকতে দেব না। লিবিয়াকে সামরিক রাষ্ট্র বানানোর হাফতারের স্বপ্নও পূরণ হবে না। এজন্য প্রয়োজনে আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত। এমন যোদ্ধারা যুদ্ধের পুরো চিত্র বদলে দিয়েছে।

আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত লিবিয়ার সরকারের বাহিনী তুর্কি ড্রোনের সহায়তায় আকাশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর পরিস্থিতির দ্রুত বদলে যেতে থাকে।। এর আগে আরব আমিরাতের ড্রোনের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতে হতো তাদের। ড্রোন হামলার ভয়ে পাল্টা হামলা চালানোর উপায় থাকতো না। কারণ ড্রোনের সাহায্যে প্রায় নির্ভুলভাবে তাদের ওপর হামলা চালানো হতো। হাফতারকে চীনের তৈরি ড্রোন কিনে দিয়েছিল আরব আমিরাত।

প্রশ্ন উঠছে আমিরাত কেন লিবিয়ায় যুদ্ধে জড়াচ্ছে। এর অন্যতম কারণ রাজনৈতিক ইসলাম এবং বলতে গেলে ইসলাম সম্পর্কে তাদের ভীতি। আবু ধাবি চায় লিবিয়ায় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাতে রাজনৈতিক ইসলাম সেখানে ভিত্তি গড়তে না পারে। এ কারণে তুরস্ক ও কাতারের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের বিরোধ। এই দুটো দেশ চায় উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে ইসলামপন্থীরাও জায়গা পাক। রাজনৈতিক ইসলামকে ভয় পায় বলেই মিশরের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ২০১৩ সালে উৎখাত করতে সহায়তা করে আমিরাত ও সৌদি আরব।

আমিরাতের কিনে দেওয়া ড্রোনের জোরেই আকাশ প্রতিরক্ষায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল হাফতার বাহিনী। তবে দক্ষিণ ত্রিপোলি থেকে হাফতারের বাহিনী এখন পলায়নপর অবস্থায়। গত জুনে গারিয়ানও হাতছাড়া হয় তাদের। এরপর থেকে গৃহযুদ্ধের গতিধারা বদলে যায়।

লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জিএনএ সরকারের সঙ্গে তুরস্কের নিরাপত্তা ও সমুদ্রসীমা চুক্তির পর পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। ওই চুক্তি তুর্কি পার্লামেন্টেও অনুমোদিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের লিবিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ বুইশিয়ার আলজাজিরাকে বলেন, ওই সামরিক চুক্তির পরই লিবিয়ায় সামরিক শক্তি বাড়াতে শুরু করে তুরস্ক। ফলে জিএনএ বাহিনী এখন শক্তি-সামর্থ্য, পরিকল্পনা, ও কৌশলগত দিক থেকে আগের চেয়ে আলাদা।

জিএনএ এবং এলএনএ করোনা মোকাবিলায় অস্ত্রবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও হাফতারের বাহিনী ত্রিপোলিতে হামলা অব্যাহত রাখে। এর জেরে মার্চের শেষে সামরিক অভিযান শুরু করে লিবীয় সরকার। জিএনএ সরকারের প্রধান ফায়েজ আল সারাজ এক বিবৃতিতে বলেন, বেসামরিক লোকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা বন্ধে শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছে তার সরকার। কারণ তার সরকার বৈধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কাজেই জনগনকে সুরক্ষার দায়িত্বও তাদের।

হাফতার বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই চতুর্মুখী বিমান হামলা জোরদার করে জিএনএ সরকার। তুর্কি ড্রোনের বিরামহীন হামলায় স্থলভাগে হাফতারের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ লাইন ভেঙে পড়ে। গত ১৪ এপ্রিল জিএনএ বাহিনী বিমান হামলা চালিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পশ্চিম উপক‚লের সাব্রাথা ও সারমানসহ বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নেয়। এরপর থেকেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। তিউনিসিয়ার আবু গ্রেইন থেকে পশ্চিম উপক‚লের বিশাল এলাকা এখন জিএনএ বাহিনীর দখলে।
জিএনএ বাহিনী এরপর পশ্চিম লিবিয়ায় হাফতারের দুর্গখ্যাত তারহাউনা শহরের দখল নিতে হামলা শুরু করেছে। এই শহরটি ত্রিপোলির ৭০ কিলোমিটার দক্ষিপূর্বে। পশ্চিমমুখী অভিযানের জন্য এই শহরটি হাফতারের কমান্ড সেন্টার। এটি কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ লাইন। তারহাউনার শহরতলিতে পৌছে গেছে জিএনএ বাহিনী।

পরিস্থিতি সামলে উঠতে না পেরে যুদ্ধবাজ হাফতার সম্প্রতি রমজানকে অজুহাত দেখিয়ে একতরফা অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন। তবে ত্রিপোলি সরকার তা নাকচ করে দিয়েছে। আসলে তুরস্কের সামরিক সহায়তায় লিবিয়া যুদ্ধের স্রোত পাল্টে গেছে। এটা এখন স্পষ্ট যে ত্রিপোলি দখলে হাফতারের অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। তিনি এখন পূর্বাঞ্চলে রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। অনেকেই বলছেন, লিবিয়া সংঘাতে কোনো সামরিক সমাধান নেই, দরকার রাজনৈতিক সমঝোতা। তবে হাফতারের পতন ছাড়া রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাওয়ায় হাফতার তার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সামরিক শাসন জারি করেছেন। অথচ তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন লিবিয়ায় গণতান্ত্রিক শাসনের।

তুরস্ক বলেছে, হাফতার ২০১৫ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় ঐতিহাসিক সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে লিবিয়ায় সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তুরস্ক ত্রিপোলির বৈধ সরকারকে রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। লিবিয়ার সব বৈধ প্রতিষ্ঠান রক্ষায় দেশটির ভ্রাতৃপ্রতীম জনগণের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে আনকারা।

স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং সেক্যুলার লিবিয়া নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন খলিফা হাফতার। তবে সাংবাদিকরা তার এলাকায় কার্যত নিষিদ্ধ। নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা তার শাসন এলাকা সফর করেছিলেন। তারা সেখানকার চিত্র তুলে ধরেছিলেন। যা অনেকাংশে দেশটির সর্বশেষ স্বৈরশাসক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির সময়কার গোঁড়া আর অরাজক অবস্থার মতই।

হাফতারের শক্ত ঘাঁটি বেনগাজি শহরটি দুর্নীতির কারণে এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এখানে হাফতারের গোয়েন্দারা বিদেশি সাংবাদিকদের অনুসরণ করে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দারা মর্জিমাফিক গ্রেফতারের ভয়ে শঙ্কিত থাকেন। সরকার সমর্থক মিলিশিয়ারা জবাবদিহির উর্ধে।

স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে উপজাতীয় নেতা ও গাদ্দাফির সাবেক কর্মকর্তারা সম্পদশালী হচ্ছেন। হাফতারের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় রহস্যজনক বোমাবাজি, অপহরণ ও বিচার ছাড়াই আটক রাখার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

বেনগাজি রক্ষার কথা বলে তিনি ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু করেন। বেনগাজিতে এখন আর কোনো যুদ্ধ নেই। তবু সেখানে সহিংসতা চলছেই। গত আগস্টে গাড়ি বোমায় জাতিসংঘের তিন কর্মীসহ ৫জন মারা যান। এরপর জাতিসংঘ তার কূটনীতিকদের ওই শহর থেকে সরিয়ে নেয়। জাতিসংঘ বলছে, বেনগাজিতে অহরহ অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যা ঘটছে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন