সৌদি -আমিরাতি - ইসরাইলি বলয়ে ভারত

মোদিকে দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ বেসমারিক সম্মাননা অর্ডার অব জায়েদ - সংগৃহীত

  • আলফাজ আনাম
  • ২৬ আগস্ট ২০১৯, ১০:১২


মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে ভারত কখনো গুরুত্বপূর্ন ছিলো না। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে । মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের প্রভাব বাড়ানোর নানা চেষ্টা করছে আরব সাগরের তীরের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরব আমিরাত সফর করছেন। তাকে দেয়া হয়েছে দেশটির সর্বোচ্চ বেসমারিক সম্মাননা অর্ডার অব জায়েদ। এই পদক এর আগে দেয়া হয়েছে যুক্তরাজ্যের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপেং কে। এরপর বাহরাইন নরেন্দ্র মোদিকে দেশটির বেসমারকি পদক কিং হামাদ অর্ডার অব দ্য রেনেসা পদকে ভূষিত করেছে।


ভারতের সাথে আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সৌদি আরবের ঘনিষ্টতা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু কেন? এটা কী শুধুই অর্থনৈতিক কারনে না এর পেছনে রয়েছে কৌশলগত কারন। তা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো। মধ্যেপ্রাচ্যে ভারতের দুয়ার খুলে দেয়ার কাজটি শুরু করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।


ভারতের সাথে আরব আমিরাতের সর্ম্পক বেশ পুরানো। দুদেশের মধ্যে ১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সর্ম্পক প্রতিষ্টিত হয়। এরপর থেকে তেল সমৃদ্ধ দেশটিতে ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আরব দেশগুলোতে ৭০ লাখ ভারতীয় অভিবাসী আছে। এরমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছে ৩০ লাখের বেশি। ২০১৮ সালে ভারতে বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিটেন্স এসেছে ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে ১৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে।


সংযুক্ত আরব আমিরাতকে বলা হয় মিনি ইনডিয়া। দেশটির ব্যবসায় বানিজ্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ভারতীয়দের একছত্র প্রভাব। ভারতীয়দের পরে আছে পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি অভিবাসী। যারা ভারতীয়দের চেয়ে অনেক কম সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। ভারতের সবচেয় বড় বানিজ্য অংশীদার ভারত। দুদেশের মধ্যে বানিজ্য সম্প্রতি ৬০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম ছুয়েছে। আরব আমিরাতে ভারতের বানিজ্যিক প্রভাব কতটা সুদৃঢ় তার প্রমান পাওয়া যায় দুবাই চেম্বারে ৩৮ হাজার ভারতীয় কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবাসন খাত, বন্দর, পরিবহন ও গনমাধ্যমের বড় অংশ নিয়ন্ত্রন করে ভারতীয়রা। ভারতের জ¦ালানী চাহিদার ৬৩ শতাংশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো থেকে। এরমধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম জ¦ালানী সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে আরব আমিরাত। আবুধাবি ন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানি ও সৌদি আরামকো যৌথভাবে ভারতের রতœাগিরিতে একটি তেল পরিশোধনাগারে ৪৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।


আরব সাগরের দুই তীরের দেশ ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক সর্ম্পক অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এই সর্ম্পকের কী কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে ? এই সহযোগিতার সর্ম্পক আরব দেশগুলোর সাথে ভারতের সর্ম্পকের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে তা এখন আলোচনার বিষয়। ভারতের সাথে ইরানের সর্ম্পক অনেক পুরানো হলেও ভারত ঝুকে পড়ছে সুন্নি আরব দেশগুলোর দিকে। অপরদিকে ইসরাইলের নতুন মিত্র হিসাবে পরিচিত আরব দেশগুলো ভারতের সাথে সর্ম্পক বাড়ানোর দিকে মনোযোগি হয়েছে। কিছুদিন থেকে ভারতকে আর্ন্তজাতিক ফোরামে নানা ভাবে সমর্থন করছে আরব আমিরাত, একই সাথে সৌদি আরবের সাথেও বাড়ছে ভারতের ঘনিষ্টতা ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যখন আবুাধিবেতে বর্নাঢ্য অনুষ্টানে অর্ডার অব জায়েদ পদকে ভুষিত করা হয়, তখন আমিরাতের যুবরাজ ও ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান মোদিকে ভাই ডেকে তাকে সোনার মেডেলটি পড়িয়ে দেন। আরব আমিরাত সফর শেষ করে মোদি বাহরাইন সফর করেন। ভারতের সরকার প্রধান হিসাবে মোদি প্রথম বাহরাইন সফর করেন। বাহরাইনের বাদশাহ হামাদ বিন ইসা আল খলিফা মোদিকে কিং হামাদ অর্ডার অব দ্য রেনেসা পদকে ভূষিত করেন। এর আগে ২০১৬ সালে সৌদি আরবের সর্ব্বো” বেসামরিক সম্মাননা কিং আব্দুল আজিজ পদক দেয়া হয় নরেন্দ্র মোদিকে। একজন সরকার প্রধানকে এ ধরনের রাষ্ট্রীয় সব্বোর্চ্চ সম্মাননা প্রদানের প্রতীকী গুরুত্ব একেবারেই কম নয়।


আরব দেশগুলো বিশেষ করে আরব আমিরাতের সাথে ভারত কৌশলগত সর্ম্পক গড়ে তুলতে আগ্রহী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময় দেশটির প্রভাবশালী সংবাদপত্র খালিজ টাইমসের সাথে সাক্ষাতকারে বলেছেন, আরব আমিরাতের সাথে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যর ভিত্তিতে ভারতের কৌশলগত সর্ম্পক গড়ে উঠেছে। আরব আমিরাতের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগতার সর্ম্পক বাড়াতে ভারত উদগ্রীব। ২০১৬ সালের মে মাসে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন।


ওআইসিতে ভারতকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাত খুবই আগ্রহী। এর আগে এমন একটি সম্মেলনে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছিলো। ভারতের গনমাধ্যমে বলা হয়েছে মোদির আরব আমিরাত ও বাহরাইন সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে কাশ্মীর ইস্যুতে এই দুই মুসলিম দেশের সমর্থন আদায় করা। কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার হরন করার পর ভারতের অবস্থানের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নেয় আরব আমিরাত। দিল্লিতে নিযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত বলেন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হরন ভারতের আভ্যন্তরিন বিষয়।


এমন এক সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দুই প্রভাবশালী আরব দেশে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হলো যখন কাশ্মীরে ভারতের সেনা অভিযান চলছে। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওআইসি সদস্যভুক্ত দেশগুলো কাশ্মীর নিয়ে শুরু থেকে ভারতের অবস্থানের সমালোচনা করে আসছে। এ ব্যাপারে আরব দেশগুলোর অবস্থান ছিলো ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতির বিপরীতে। এমন পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদির আরব আমিরাত ও বাহরাইন সফর ও বিশেষ মর্যাদা প্রদান ভারতের বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসাবে দেখা যেতে পারে। আরব আমিরাত ও বাহরাইন সফরকে স্বাভাবিক ভাবে ভারত সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। মোদি বাহরাইনে শ্রনাথজি বা শ্রীকৃষ্রে নামে একটি মন্দির পুর্ননিমান উদ্বোধন করেন।


মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের গুরুত্ব বাড়াতে সৌদি, আমিরাতি এই উদ্যেগের পেছনে এ অঞ্চলে যে জটিল রাজনৈতিক সমীকরন তাতে কোনো ভুমিকা আছে কিনা সে প্রশ্ন অনেক বিশ্লেষক তুলেছেন। কারন হিসাবে তারা বলছেন , ভারতের ব্যাপারে এসব দেশের আগ্রহ হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। অতীতে এসব দেশের কূটনীতিতে ওআইসি বা মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের দিকটি যতটা গুরুত্ব পেতো এখন তা আর পাচ্ছে না। আরব উপদ্বীপের দেশগুলো পারস্পরিক বিরোধকে কেন্দ্র করে নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন দেশের সাথে সর্ম্পক ঘনিষ্ট করছে।


অনেক বিশ্লেষক মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যে ভারতকে আরো সক্রিয় দেখতে চায় ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্রের পর ইসরাইলের সাথে যে দেশটির সবচেয়ে ঘনিষ্ট সর্ম্পক সেটি হচ্ছে ভারত। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ এখন ইসরাইল। অপরদিকে আরব দেশগুলোতে ইসরাইলের সাথে পরোক্ষ কূটনৈতিক সর্ম্পক বজায় রেখে চলছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর জানিয়েছেন মোদি হচ্ছে তার সবচেয়ে বিশ^স্ত বন্ধু। অপরদিকে দুবাইয়ের শাসক জায়েদ নরেন্দ্র মোদিকে ভাই হিসাবে সম্বোধন করেছেন। আবার নেতানিয়াহুর আর্ন্তজাতিক পর্যায়ের বন্ধুদের সাথে মোহাম্মদ বিন জায়েদের আছে ঘনিষ্টতা। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের জামাই জ্যারেড কুশনারের সাথে নেতানিয়াহুর রয়েছে পারিবারিক সর্ম্পক। কুশনার সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ও আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদের বন্ধু। সার্বিয়ার নেতা আলেকজান্ডার ভুসিস মোহাম্মদ জায়েদের ঘনিষ্ট বন্ধু। যিনি বসনিয়া যুদ্ধে মুসলিম গনহত্যার একজন জোরালো সমর্থক। ভুসিস আবার নেতানিয়াহুর অত্যন্ত পছন্দের ব্যক্তি। নরেন্দ্র মোদির সাথে মোহাম্মদ জায়েদের এই ভাইয়ের সর্ম্পকে ইসরাইলের ভুমিকা থাকা খুবই স্বাভাবিক। অনেকে বিশ্লেষক মনে করেন সৌদি আমিরাতি ও ইসরাইলি বলয়ের মধ্যে ভারত ঢুকে গেছে। এ কারনে ভারতের পুরানো মিত্র ইরানের সাথে সর্ম্পক অনেকটা শীতল পর্যায়ে এনেছে।


মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন , ভারতের কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামীদের দমনে ইসরাইলের কাছ থেকে নানা ভাবে সহযোগিতা পেয়ে আসছে ভারত। এছাড়া পাকিস্তানকে কোনঠাসা করতে এবং পাকিস্তানের ভেতরে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রেও ইসরাইলের মদদ আছে। অরুন্ধতী রায়সহ ভারতের অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার হরন করে জনবিন্যাস পাল্টে দেয়ার পরিকল্পনা এসছে ইসরাইলের কাছ থেকে। ইসরাইল তার ঘনিষ্ট মিত্রকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিশেষ অবস্থান তৈরিতে কাজ করছে বলে মনে করা হয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতিতে ইসরাইলের মিত্র হিসাবে ভারত কতটা ভুমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আলফাজ আনাম : সাংবাদিক