কোণঠাসা মোদির নীরবতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন

বেইজিংপন্থী সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টগুলোতে হিমালয় সীমান্তে বিরোধ এলাকায় একটি হৃদের পাশের এই ছবিটি প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় সেনাদের দড়ি দিয়ে বাঁধা হচ্ছে - ডেইলি মেইল

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৪ জুন ২০২০, ১৩:৪৮

জনমত ও গণমাধ্যমের চাপে ভারতের সেনাবাহিনী অবশেষে দাবি করেছে যে লাদাখ সীমান্তে তাদের ২০ সেনাকে হত্যা করেছে চীনা সৈন্যরা। শুরুতে অবশ্য ভারতীয় বাহিনী মাত্র ৩ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছিল। তবে ভারতের গণমাধ্যমে সংঘর্ষের যে বিবরণ এসেছে তাতে মনে হচ্ছে ভারতের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি। নিকট অতীতেও দেখা গেছে, এ ধরনের ঘটনায় ভারতীয় বাহিনী নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দেখায় আর প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বাগাড়ম্বর করে থাকে।

লাদাখে চীন-ভারত সীমান্তে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ২০ সেনা নিহত হয়েছে বলে ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে প্রথমে তিন সেনা নিহত হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। পরে এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী বলেছে, সংঘর্ষে নিহত এক কর্নেল ও দুই সৈনিকের সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর আহত আরও ১৭ সেনা মারা গেছে।

সংঘর্ষে গোলাগুলি হয়নি। পাথর এবং রড নিয়ে মারামারিতেই প্রাণহানি ঘটেছে বলে এর আগের খবরে জানিয়েছিল সেনাবাহিনী। ৪৫ বছর পর পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। এমন সময় ভারতীয় বাহিনী এভাবে পর্যুদস্ত হলো যখন ক্রমবর্ধমান করোনা ভাইরাস সংকট নিয়ে নরেন্দ্র মোদির সরকার কঠিন পরিস্থিতির মুখে রয়েছে।

হিমালয় পর্বতের পশ্চিমাংশের লাদাখে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত ও চীনের সামরিক বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আছে। এর আগে দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হলেও রক্তপাতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এবারের সংঘর্ষের ঘটনাটি লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সোমবার রাতে ঘটেছে বলে বিবৃতিতে জানিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভারতকে একতরফা কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে ঝামেলা আর না বাড়াতে বলেছে। চীনের দাবি, ভারতীয় সেনারাই প্রথম হামলা চালায়। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরেও বলা হয়েছে, প্রথম উসকানি ভারতীয় বাহিনীই দিয়েছিল।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বেইজিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ১৫ জুন ভারতীয় পক্ষ দুবার সীমান্ত লঙ্ঘন করে উস্কানি দিয়েছে এবং চীনা সেনাদের আক্রমণ করেছে। এ থেকেই দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয়।

ভারতের কয়েকটি সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়, ভারতীয় সেনাদেরকে ‘পিটিয়ে মারা’ হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী কিছু জানায়নি। ৪৩ চীনাসেনা হতাহত হয়েছে বলে ভারতের দাবি।

চীনের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ঝ্যাং সুইলি ভারতীয় পক্ষকে তাদের সীমান্তের সেনাদেরকে কড়াভাবে সংযত রাখতে বলেছেন এবং সমস্যা সমাধানে আলোচনার সঠিক পথে ফিরে আসার বার্তা দিয়েছেন। ভারতকে নিয়ন্ত্রণ রেখা লঙ্ঘন এবং কোনোরকম উস্কানিমূলক কর্মকান্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চীন ভারতের গালওয়ান উপত্যকায় হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে বলে অভিযোগ দিল্লির। তাছাড়া, ভারতের অংশে ৩৮,০০০ স্কয়ার কিলোমিটার চীন দখল করে আছে বলেও অভিযোগ তাদের।

সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে হাতাহাতি লেগে থাকলেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটল ৪৫ বছর পর। ১৯৭৫ সালে অরুণাচল প্রদেশের টুলুং লা-য় আসাম রাইফেলসের টহলদার বাহিনীর চার জওয়ানকে হত্যা করেছিল চীনা সেনা। লাদাখ সীমান্তে হত্যার ঘটনা শেষবার ঘটে ১৯৬২ সালে। গত তিন দশকে ভারত ও চীনের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনাতেও সীমান্ত সমস্যার কোনো সমাধান আসেনি। দু’দেশের মধ্যে ১৯৬২ সালে একটি যুদ্ধ হয়েছে। তাতে ভারতের শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। ২০১৭ সালে দুই পক্ষ আবার সংঘর্ষে জড়ায়। ওই বছর ডোকলাম বিরোধের পর সীমান্তে দু'দেশের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বড় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

গত ৫ মে লাদাখে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনায় উত্তেজনা বাড়ে। ওইদিন ভারত ও চীনের সেনারা সংঘর্ষে জড়িয়েছিল লোহার রড, লাঠি নিয়ে। পাথর ছোড়াছুড়িও হয়েছিল। পরে বৈঠকে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও ৯ মে উত্তর সিকিমে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুপক্ষের সেনারা।

গালওয়ান উপত্যকায় চীন এবং ভারত উভয়ই বিপুল সেনা সমাবেশ করে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এরপর পর থেকে পূর্ব লাদাখ পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।

ভারতের দাবি, চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা না-মানার ফলেই লাদাখের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। দিল্লিতে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেছেন, দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, চীন তা মেনে চললে এই ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হত। তিনি বলেছেন, দু’পক্ষের আলোচনায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা মেনে চলার ব্যাপারে যে ঐকমত্য হয়েছিল, চীন তা লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের। ঘটনাচক্রে চলতি সংঘাতের আবহে এই প্রথম ভারতের তরফে সরকারিভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের কথা স্বীকার করা হল।

চীনের দাবি, সোমবার রাতের গোটা ঘটনার পেছনে ভারতের প্ররোচনা রয়েছে। গ্লোবাল টাইমস হুমকির স্বরে বলেছে ‘ভারতের ঔদ্ধত্য এবং বেপরোয়া মনোভাবই চীন-ভারত সীমান্তে লাগাতার উত্তেজনার জন্য দায়ী। চীন সংঘাত তৈরি করে না, করবেও না। কিন্তু তারা সংঘাতকে ভয়ও পায় না।

চীনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়াংয়ের হুঁশিয়ারি, সর্বশেষ ঘটনার পরে আমরা খুবই কড়া ভাবে জানাচ্ছি, ভারত যেন সংশ্লিষ্ট চুক্তিগুলি মেনে চলে। তাদের সেনাদের সংযত হতে বলে।

সীমান্তে ভারতের অবকাঠামোর নির্মাণের জেরে সাম্প্রতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন। চীন সীমান্তে গত ১০ বছরে ভারত বিমানঘাঁটিসহ বহু সামরিক স্থাপনা তৈরি করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের মাখামাখিকে সুনজরে দেখছে না চীন। আবার পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অন্যদিকে চীনের উচ্চাভিলাসী বেল্ট ও রোড প্রকল্প ভারতের জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। তারা বলছেন, চীন চাচ্ছে সীমান্ত সমস্যা জটিল করে তুলতে যাতে ভারত তিব্বতের দিকে নজর দিতে না পারে। ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেন, এই উত্তেজনা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। হাজার হাজার চীনা সেনা এখন ভারতের মাটিতে অবস্থান করছে। তারা যুদ্ধ চায়।

ভারতের সেনাবাহিনীও সোমবারের সংঘর্ষে কোনো গুলি চলেনি বলে জানিয়েছে। তাদের দাবি, ভারতের এক জন কর্নেলকে তাঁর ব্যাটালিয়নের সামনে খুকরি দিয়ে হত্যা করা হয়। সম্প্রতি লাঠি হাতে চীনা সেনারা টহল দিতে আসে সীমান্ত রেখা এলএসিতে। সেই লাঠির মাথায় বেশ কিছুটা অংশে কাঁটাতার জড়ানো থাকে। গুলি চালাতে পারবে না বলে ওই কাঁটাতার জড়ানো লাঠি দিয়ে তারা আঘাত করে ভারতীয় বাহিনীকে। রড, পাথর নিয়ে হাতাহাতিতে জড়িয়েছিলেন দু’দেশের সেনা। কিন্তু স্রেফ খন্ডযুদ্ধে এত লোকের মৃত্যু হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, সোমবার রাতে নিহত কর্নেল জনা পঞ্চাশেক জওয়ান নিয়ে চীনা তাঁবু ভাঙতে শুরু করেন। সেগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতের দিকে গালওয়ান নদীর দক্ষিণে চীনের একটি নজরদারি পোস্টও ভেঙে দেয় তারা। এর পর চীনের প্রায় ২৫০ জন সেনা ফিরে এসে ভারতীয় সেনাদের উপরে হামলা চালায়। শুরু হয় সংঘর্ষ। ভারতের সেনা সূত্রে বলা হচ্ছে, চীনা সেনাদের হাতে কাঁটা লাগানো লাঠি ছিল। তাই দিয়ে তারা ভারতীয় সেনাদের আক্রমণ করে। গালওয়ান নদীর বুকেও দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। আহত কয়েক ভারতীয় জওয়ান স্রোতে ভেসে গিয়েছেন বলে আশঙ্কা।

প্রশ্ন উঠেছে, কাটাতার লাগানো লাঠি দিয়ে ৫০ জনের ওপর ২৫০ জন হামলা চালালে চীনের কী আদৌ কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে? তাহলে ভারতীয় বাহিনী কিসের ভিত্তিতে দাবি করেছে যে চীনের ৪৩ সেনা হতাহত হয়েছে।

ভারতের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে তাই জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু ২০ সেনার মৃত্যু নয়, ভারতের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হতে পাওে অনেকেই মনে করছেন। এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনায় ভারতের সেনাবাহিনী সাধারণত নিজেদের বীরত্ব জাহির করার জন্য প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের মাটিতে ভারতের কথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরও এমন ঘটনাই দেখা গেছে। তখন পাকিস্তান ভারতের দুটি জঙ্গিবিমান ভূপাতিত ও একজন পাইলটকে বন্দি করলেও শুরুতে ভারতের বিমান বাহিনী দাবি করে যে তারা পাকিস্তানের একটি জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করেছে। পরে দেখা যায়, ভারতের ওই দাবি মিথ্যা ছিল। অবশ্য মুখরক্ষার জন্য ভারতের বিমানবাহিনী দাবি করে যে তারা নিজেদের জঙ্গিবিমান ভুল করে ভূপাতিত করেছে।

ভারতের সেনাদের মৃত্যুর পর মোদি কূটনীতি ও সামরিক নীতি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। মোদি সরকারের প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরই সাবরমতীর কাছে দোলনায় দুলেছিলেন চীন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে। ২০১৮ সালে উহানের মনোরম হ্রদের ধারে কূটনৈতিক আড্ডায় মেতেছিলেন চীনা সর্বাধিনায়কের সঙ্গেই। মাত্র আট মাস আগেও আলোচনা হয়েছিল জিনপিং-মোদির। জিনপিংয়ের আগমন উপলক্ষে মোদি নিজেই সাগর সৈকত পরিস্কার করেছিলেন। ভারতের বিরোধী রাজনীতিকরা ধারাবাহিক ভাবেই প্রশ্ন তুলছিলেন, এত করে লাভটা কী হল?

এমন অভিযোগও উঠছে, যতটা গর্জে ওঠার কথা ছিল ‘ছাপান্ন ইঞ্চি’ বুকের পাটা খ্যাত মোদি তার ধার-কাছ দিয়েও গেলেল না। কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের প্রশ্ন, ‘৫ মে-র পর থেকে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নীরব। বিদেশি সেনা ভূখন্ড দখল করে বসে রয়েছে, অথচ দেশের প্রধান চুপ, অন্য কোনও দেশে এমন হত বলে ভাবা যায়?

শুধু তা-ই নয়, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীসহ বিরোধীরা যখন ৫ মের পর থেকে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন, চীন ভারতের ভূখন্ড কতটা দখল করেছে, সরকার টুঁ শব্দ করেনি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং চীন ভারতের ভূখন্ড চীন দখল করেছে বলে বক্তব্য দেওয়ার পরে তা আবার প্রত্যাহার করে নেন। অথচ মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, চীন নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন করেছে। তা হলে এত দিন কেন তা স্বীকার করা হয়নি?

বিরোধীরা প্রশ্নও তুলেছেন, এতো সেনার মৃত্যুর পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন প্রায় ২০ ঘণ্টা পর প্রথম বিবৃতি দিল এবং তা-ও সাংবাদিকদের অবিরল প্রশ্নের পর! ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, যে প্রাণহানি হয়েছে, তার তুলনায় মোদি সরকারের জবাব অনেকটাই নরম সুরে বাঁধা।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে