করোনার লাগাম টেনে ধরেছে মালয়েশিয়া

ছবি - সংগৃহীত -

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ২৮ এপ্রিল ২০২০, ১৩:৪৪

করোনার সংক্রমণে নাজুক পরিস্থিতিতে বিশ্ব। কবে এই সঙ্কট কাটবে, সে ব্যাপারেও ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এর মধ্যেই কয়েকটি দেশ দেখাতে পেরেছে আশার আলো। এদের একটি মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ায় কমে এসেছে করোনার প্রকোপ। এই প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত দেশটিতে মোট আক্রান্তর সংখ্যা পাঁচ হাজার ৩৮৯। এদের মধ্যে সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন তিন হাজার ১৯৭ জন। আর মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ৮৯ জন। যেখানে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা শ’ ছাড়িয়েছে। গত ২০ এপ্রিল মালয়েশিয়ায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজনের।

এপ্রিলের শুরুর দিকে মালয়েশিয়াকে নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা জানিয়েছিলো, মধ্য এপ্রিলে দেশটিতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে মধ্য এপ্রিলে শুকরিয়া আদায় করছেন মালয়েশিয়াবাসী। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সরাসরি সম্প্রচার করেন, তখন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে শুকরিয়া আদায় করতে দেখা যায় নাগরিকদের। কী করে সম্ভব হলো এই অসাধ্য সাধন?
এর পেছনের কৃতিত্ব দেশটির নীতিনির্ধারকদের। সংক্রমণের শুরু থেকেই নীতিনির্ধারকরা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছিলেন। প্রতিরক্ষা নয়, নীতিনির্ধারকরা নিয়েছিলেন আক্রমণাত্মক ভ’মিকা। অর্থাৎ যেখানেই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যাবে, সেখানেই চলবে নির্মূল অভিযান। এর জন্য চাই ভাইরাসের অবস্থান নির্ণয়। আর অবস্থান নির্ণয় করতে হলে পরীক্ষা করাতে হবে বেশি।

অর্থাৎ ব্যাপকভাবে পরীক্ষার হার বাড়িয়ে দিয়েছিলো মালয়েশিয়া। সেইসঙ্গে নতুন সংক্রমণ এড়াতে মানুষকে আহ্বান করা হয়েছিলো ঘরের ভেতর থাকতে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ার নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ নীতিটি ছিলো সময়ের কাজ সময়ের মধ্যেই করে ফেলা। দেশটির করোনাবিরোধী অভিযান শুরু হয় মূলত মার্চের প্রথম দিন থেকে। এর আগে কয়েকজনের শরীরে ভাইরাসের খোঁজ মিললেও সেটা থেকে সামাজিক সংক্রমণের শঙ্কা ছিলো না।
পয়লা মার্চ, মালয়েশিয়াজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। দিনটি দেশটির রাজনীতির জন্যও ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিতে দুই সপ্তাহের নাটকীয় উত্তেজনা শেষে পয়লা মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। একই দিনে রাজধানীর উপকণ্ঠে শ্রী পেটালিং মসজিদে ঘটে যায় তুলকালাম। এই মসজিদটিতে ছিলো তাবলিগ জামায়াতের চারদিনব্যাপী আয়োজন। এতে অংশ নিয়েছিলেন দেশ ও বিদেশের ১৬ হাজার তাবলিগের সদস্য। এদের মধ্যে বিদেশির সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। ওইদিন আয়োজন শেষে সদস্যরা বাক্স-পেটরা গুছিয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা করেন। এই জমায়েতে অংশ নেওয়া বিদেশিরা ফিরে যান নিজেদের দেশ ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে।

ওই সময়টাতে বিশ্বজুড়ে চলতে থাকে করোনা ভাইরাস নিয়ে তোলপাড়। সারা পৃথিবীতে মৃত্যুর সংখ্যা তখন তিন হাজারের বেশি। কিছু কিছু দেশ বিদেশিদের প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করো। এর মধ্যেই মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের কয়েকজন প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এরা তাবলিগের ওই জমায়েতে অংশ নিয়েছিলেন।

শুরুতেই সতর্ক হয়ে যান নীতিনির্ধারকরা। সব ধরণের সমাবেশ এড়িয়ে চলার আহ্বান জানানো হয় নাগরিকদের। পেটালিং মসজিদকে ঘিরে চলতে থাকে তদন্ত। জানার চেষ্টা করা হয়, কারা এতে অংশ নিয়েছিলেন, এরা এখন কোথায় আছেন। ওই মসজিদটিতে প্রবেশ সীমিত করে দেওয়া হয়। মসজিদের ভেতরে থাকা তাবলিগের কয়েক সদস্যকে রাখা হয় কোয়ারেন্টাইনে। নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় বিভিন্ন জনসমাগমের ওপর। ধর্মীয় মাহফিলে দেওয়া হয় কঠোর বিধিনিষেধ। তাবলিগ দেশটিতে তাদের সকল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। সরকার বন্ধ করে দেয় সীমান্ত।
খোঁজ চালানো হয় ওই সমাবেশে অংশ নেওয়া সদস্যদের। সরকারের আহ্বানে তাবলিগ সদস্যদের অনেকেই নিজেদের তথ্য দিতে এগিয়ে যান। যারা ওই সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন, তারা স্বেচ্ছায় এসে সরকারকে সহযোগিতা করেন। এতে সরকারের জন্যও কাজটি সহজ হয়ে যায়। তবে এসবে সংক্রমণ থেমে থাকেনি।

বিশ্বের অন্য দশটা দেশের মতোই মালয়েশিয়াতেও আক্রান্তর সংখ্যা বাড়তে থাকে। দেশটির সংক্রমণের ভ’ত-ভবিষ্যৎ নিয়ে আসতে থাকে অনেক বিশ্লেষণ। করোনার আক্রমণ মালয়েশিয়াকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে বলে অনেক বিশ্লেষক শঙ্কা প্রকাশ করেন।
এই যখন অবস্থা, তখন আরো শক্ত হয়ে মাঠে নামেন নীতিনির্ধারকরা। দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসিন জানান, পরিস্থিতির অবনতির অপেক্ষা না করেই পদক্ষেপ নিয়েছে তার সরকার। করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতেও পিছপা হবেন না তারা।
দেশটিতে এখন তৃতীয় মেয়াদে লকডাউন চলছে। এটি শুরু হয় গত ১৫ এপ্রিল থেকে। মার্চের শুরু থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত স্বাস্থ্য সতর্কতায় অনেক ধকল সামলাতে হয়েছে মালয়েশিয়াকে। এখনো ঘরে অবস্থান করতে হচ্ছে নাগরিকদের। এক পার্লামেন্ট মেম্বারের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়ার পরপরই স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টাইনে চলে যান দেশ গড়ার কারিগর মাহাথির মোহাম্মদ। সচেতন হয়ে যান অন্য রাজনীতিবিদরাও। দেশটিতে চলতে থাকে কঠোর ‘মুভমেন্ট কন্ট্রোল’। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াতের ওপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

মালয়েশিয়ায় ফিরতে শুরু করেছে স্বস্তি। প্রতিদিন কমছে মৃত্যুর সংখ্যা। কমছে আক্রান্তর হার। ইতিবাচক এই পরিসংখ্যান পেয়ে স্বস্তিতে হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি মালয়েশিয়া। চলাচলে নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানানো হলেও গত কিছুদিনের অভিজ্ঞতা বলছে, অনেকেই এই আহ্বানে কান দিচ্ছেন না। এ কারণেই আরো কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব। তিনি জানান, কিছু লোক একেবারেই আইনের তোয়াক্কা করছে না। এক হাজার রিঙ্গিত জরিমানা যেন তাদের কাছে কিছুই না।

মন্ত্রী হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, এর পর থেকে পুলিশ কাউকে সতর্ক করবে না। যারাই লকডাউন নীতিমালা অমান্য করবে তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হবে। পরে আদালত তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কেউ একবার এই অপরাধ করলে তাকে আদালত দুই বছরের কারাদ- দিতে পারে। দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে আরো পাঁচ বছরের দ- দিতে পারবে। দেশটিতে মানুষকে ঘরে রাখতে পুলিশের পাশাপাশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে তল্লাশি চৌকি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ‘মুভমেন্ট কন্ট্রোল’ এবং ‘ব্যাপক পরীক্ষা’ ভালো ফলাফল এনে দিচ্ছে মালয়েশিয়াকে। মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েই দায় সারেনি সরকার। দেশটিতে কর্মরত বিপুল দেশি এবং বিদেশি কর্মীদের ব্যাপারেও কার্যকর কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশটির সরকার সকল কোম্পানিগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে, কাজ বন্ধ থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে কর্মীদের তহবিলে বেতন পৌঁছে দিতে হবে। কোনো কোম্পানি সেটা না করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থায় যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে, তারা শুধু পাসপোর্ট ও বিমানটিকেট কিনে দেশে যেতে পারবেন। আর যাদের ছুটিতে থাকা অবস্থায় ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে, তারা লকডাউন শেষ হওয়ার ৩ মাসের মধ্যে মালয়েশিয়া প্রবেশের অনুমতি পাবেন।
এছাড়া দেশটিতে বসবাসরত বিদেশি অভিবাসীদের জন্য ভিসা ফি (লেভি) ২৫ শতাংশ মওকুফ করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে নাগরিকদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সহায়তা দিয়ে নাম কুড়িয়েছেন এভিট লিউ নামের একজন। তিনি বিভিন্ন প্রকল্পে দেশি-বিদেশি শ্রমিকদের জন্য খাবার দিচ্ছেন।

করোন সঙ্কটে দেশটিতে কারা বৈধভাবে কাজ করছেন, আর কারা অবৈধ সেসব বিবেচনা করা হচ্ছে না। এখন দেশি-বিদেশি, বৈধ-অবৈধ এমনকি শরণার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কড়াকড়ি নির্দেশনা রয়েছে। বেশি বেশি পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে উদ্বোধ্য করা হচ্ছে। পরীক্ষার জন্য নেওয়া হচ্ছে না কোনো ফি।
কেবল মালয়েশিয়া সরকার নয়। দেশটিতে অবস্থানরত দূতাবাসগুলোও নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক করে দিচ্ছে। তাদেরকে চিকিৎসা নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে। সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ধৈর্য্যরে সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ হাই কমিশন। দেশটিতে মোট ৬৩ জন বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এই প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত বাংলাদেশি কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে অনেকেই রয়েছেন সঙ্কটে। এদেরে পাশে দাঁড়ানোর জন্য বড় ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত প্রবাসীদেরকে অনুরোধ করেছে হাই কমিশন।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। কুয়ালালামপুরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাংলাদেশি কর্মীদের খাবার দেওয়া হচ্ছে।

করোনা পরিস্থিতি সারাবিশ্বকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিলেও মালয়েশিয়া এখন এগুচ্ছে স্থিতিশীলতার দিকে। আশা করা হচ্ছে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে লকডাউন।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মালয়েশিয়ার এই চমক কৌতুহলী করে তুলেছে বিশ্বকে। এর প্রেক্ষিতেই আরো ১০ দেশের সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা আলোচনা করেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা নিয়ে এক ভিডিও কনফারেন্সে এই সফলতার কথা উল্লেখ করেন তিনি। এই সফলতার পেছনে যার ভ’মিকা সবচেয়ে বড় তিনি দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ডা. দাতো নূর হিসাম আব্দুল্লাহ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি ভাসছেন প্রশংসায়।